শাহবাগে বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দ্রুত বিচার দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

সহিংসতার প্রতিবাদে গতকাল শাহবাগে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হয় ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির, বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর লুটপাটের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়াসহ সাত দফা দাবি জানানো হয়েছে। গতকাল রাজধানীর শাহবাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী স্বামীবাগ আশ্রমের ভক্তদের এক প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে দাবি জানানো হয়। সময় দাবি পূরণে সরকারকে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়া হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে আরো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার কথাও জানানো হয়।

গত কয়েকদিনে ঘটা সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ সাধারণ শিক্ষার্থী স্বামীবাগ আশ্রমের ভক্তরা গতকাল সকাল থেকে শাহবাগ মোড়ে জড়ো হতে শুরু করেন এবং পরে সড়ক অবরোধ করেন। এতে বেশকিছু সময় ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে। বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে সাত দফা দাবি ঘোষণা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদের সাবেক সাহিত্য সম্পাদক আন্দোলনের সমন্বয়ক জয়দীপ দত্ত।

কর্মসূচি থেকে ঘোষিত দাবিগুলো হলো সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার মন্দিরগুলো সংস্কারের ব্যবস্থা করা, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বসতবাড়ি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিকাণ্ড এবং লুটপাটের ক্ষতিপূরণ, হামলায় জড়িতদের গ্রেফতার করে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা, জাতীয় সংসদে আইন করে মন্দির ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেয়া, সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় কমিশন গঠন, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের আধুনিকায়ন করে ফাউন্ডেশনে উন্নীত করা এবং জাতীয় বাজেটে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখা।

দাবি মেনে নিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন তারা। জয়দীপ দত্ত বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি সাত দফা দাবি মেনে নেয়া না হয় বা সরকারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করে, তাহলে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। সে কর্মসূচি আরো কঠিন হবে বলেও জানান তিনি। তার বক্তব্য অনুযায়ী, দাবি আদায় না হলে আজ বিকালে তাদের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করার কথা।

এছাড়া সন্ধ্যায় সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে মশাল মিছিল বের করা হয়। টিএসসির পায়রা চত্বর থেকে শুরু হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান ঘুরে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মিছিলটি শেষ হয়। সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য দেন ডাকসুর সাবেক সদস্য ছাত্রলীগের সমাজসেবা বিষয়ক উপসম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত। তিনি বলেন, দেশের যেকোনো সংকটে সবসময় এগিয়ে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। চলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতার আর অসাম্প্রদায়িক চেতনার অস্তিত্বের সংকটের সময়ে আমরা এসব হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এগুলো প্রতিরোধেও নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করছি। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মীমাংসিত, সংবিধান স্বীকৃত রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষায় আমাদের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ অব্যাহত থাকবে। প্রশাসন দ্রুততম সময়ে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা না নিলে আমরা আবারো মাঠে নামব।

সময় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পেছনের সম্মুখের কুশীলব, ষড়যন্ত্রকারী, আক্রমণকারীদের দ্রুততম সময়ে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়।

এর আগে গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লা শহরের একটি মন্দিরে কথিত কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে স্থানীয় কয়েকটি মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর চালানো হয়। এরপর চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনীসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলার মন্দিরে হামলা হয়, প্রতিমা ভাঙচুর চালানো হয়। কোথাও কোথাও হিন্দু ব্যক্তির মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর লুটপাটের অভিযোগও পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছেন। সবশেষে রোববার রাতে রংপুরের পীরগঞ্জের মাঝিপাড়া জেলেপল্লীতে এক তরুণের বিরুদ্ধে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ২৯টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়।

পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায় হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজন ৪২ জনকে আটক করা হয়েছে। গতকাল তাদের আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে পুলিশ।

গতকাল রোববার রাত ১০টার দিকে পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া-বটতলা বড়করিমপুর গ্রামে হামলার ঘটনা ঘটে। রাত ১টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। ঘটনার পর থেকে এলাকাগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন রংপুরের পুলিশ সুপার বিপ্লব বিশ্বাস, র্যাব ১৩-এর অধিনায়কসহ জেলা উপজেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

হামলার ঘটনায় ৪২ জনকে আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেন রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য। তিনি জানান, আটককৃতরা সন্দেহভাজন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তবে কারো নাম পরিচয় জানাননি তিনি। রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল ওয়াহাব ভুঞা জানান, হামলায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পুনর্বাসনসহ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।

এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব বা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। সেখানে বলা হয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে চক্রান্তকারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট কিংবা বিভিন্ন তথ্য বিকৃত বা অপব্যাখ্যা করে তা ছড়িয়ে সংঘাতমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে। বাংলাদেশ পুলিশের সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব বা বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। সময় বিভ্রান্তি না ছড়াতে এবং যাচাই করা হয়নিএমন সংবাদ বিশ্বাস না করতে সাধারণ মানুষের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়। পাশাপাশি যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় জনগণের সার্বিক সহযোগিতাও কামনা করা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন