ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ

সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেনি সিটি করপোরেশন

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই নতুন করে দুশ্চিন্তা হিসেবে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু রোগ। দেড় মাস ধরে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। প্রতিদিন দুই শতাধিক রোগী মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। নগর এলাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনতে দুই বছর আগে যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছিল, তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। মূলত সিটি করপোরেশনগুলোর দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম পায়নি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন সমবায় মন্ত্রণালয়।

জানা যায়, ডেঙ্গু পরিস্থিতি যেন ২০১৯ সালের মতো ভয়াবহ না হয়, সেজন্য দেশের সব সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডকে ১০টি উপ-অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রতিটিতে একটি করে উপকমিটির মাধ্যমে নিবিড়ভাবে কার্যক্রম গ্রহণের বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেনি সিটি করপোরেশনগুলো। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত সারা দেশে মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে সব সিটি করপোরেশন অন্যান্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ সংস্থার কার্যক্রম পর্যালোচনা-সংক্রান্ত এক জরুরি সভায় তথ্য উঠে আসে। 

মূলত রাজধানীজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। নিচু জলাবদ্ধ এলাকায় এডিস মশা বাড়ায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ উত্তর সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। উত্তরের চেয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক বেশি। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নম্বর অঞ্চলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি বলে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) ফরিদ আহাম্মদ। যদিও রাজধানীর দুই নগর কর্তৃপক্ষ এডিস মশা ধ্বংসে কর্মসূচিও পরিচালনা করছে। তবে তাতে ডেক্টর বাহিত এডিস এবং এলবোপিকটাস মশা নিধন করা যাচ্ছে না।

সিটি করপোরেশনগুলো দৃশ্যমান কার্যক্রম শুরু করেনি উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, সব সিটি করপোরেশনকে বলা হয়েছে একটি ওয়ার্ডকে ১০টি সাবজোনে ভাগ করে প্রতিটি জোনে একটি করে কমিটি গঠন করতে। স্থানীয় কাউন্সিলরের নেতৃত্বে সেগুলো যেন বাস্তবায়ন হয়, সে বিষয়ে আবারো নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কার্যক্রম অগ্রগতির বিষয়ে কাউন্সিলররা তাদের মেয়রের কাছে জবাবদিহি করবেন। আর মেয়র সার্বিক বিষয় তদারকি করবেন।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সারা দেশে শক্তভাবে কার্যক্রম চলছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের সভাপতিত্বে পাঁচ সদস্যের একটি তদারকি সেল গঠন করা হয়েছে। সিটি করপোরেশন কোথায় কী ধরনের কাজ করছে, তা সেল প্রতিনিয়ত মনিটর করছে।

বৈঠকের কার্যপত্র সূত্রে জানা যায়, সিটি করপোরেশনগুলো মশা নিধনে গৃহীত দৈনিক কর্মপরিকল্পনা ওই সেলের কাছে দাখিল করবে। সিটি করপোরেশনগুলো মশা নিধন কাজে ব্যবহূত কার্যকর কীটনাশকের পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিত করতে হবে। শনাক্তকৃত ডেঙ্গু রোগীদের বাসস্থানের ব্যাপারে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সিটি করপোরেশনগুলো হটস্পট চিহ্নিত করে র্যাপিড অ্যাকশন টিম বিশেষ অভিযান পরিচালনা করবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষেত্রে কাউন্সিলররা সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন।

এছাড়া সিটি করপোরেশনগুলোর অধীন সব ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা নিজেরা আহ্বায়ক হয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও), মসজিদের ইমাম, মসজিদ কমিটির প্রতিনিধি, তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সদস্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, নারী সমাজের প্রতিনিধির সমন্বয়ে প্রতিটি ওয়ার্ডে ১০ সদস্যবিশিষ্ট ১০টি উপকমিটি গঠন করবেন। এছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডে স্বেচ্ছায় মানুষের জন্য সেবা দেয়ায় আগ্রহী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনযাতে মশা নিধন কাজ সার্থকভাবে করা যায়।

মন্ত্রণালয়ের ওই বৈঠকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রতিনিধি ছাড়া অন্য কোনো সিটি করপোরেশন পৌরসভার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন না। বৈঠকের পর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য মশা নিধন কার্যক্রমের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) ফরিদ আহাম্মদ বলেন, আমাদের পর্যাপ্ত ভলান্টিয়ার ছিল না। তবে সম্প্রতি আমরা উইং কমিউনিকেশন নামের একটা ভলান্টিয়ার সংস্থার সঙ্গে কাজ করার জন্য দায়িত্ব দিয়েছি। তারা ১০টা ভাগে বিভক্ত হয়ে এখন কাজ করতে পারছে।

মশা নিধনে কয়েকটি চিরুনি অভিযান করা হয়েছে উল্লেখ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা জানান, তারা এসব কাজ করার পাশাপাশি ৫৪টি ওয়ার্ডে মেয়র নিজে গিয়েছিলেন। বিজ্ঞাপন, লিফলেট, মসজিদে মসজিদে মাইকিং, এলাকায় এলাকায় মাইকিং, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জরিমানা আদায়ের পাশাপাশি বেশ কয়েকজনের জেলও দেয়া হয়েছে।

সরকারের ডেঙ্গুবিষয়ক তথ্য বলছে, বছর হাজার ৬৪৫ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। গত জুলাইতে সর্বোচ্চ রোগীর রেকর্ড চলতি মাসের প্রথম ১০ দিনেই ভেঙে যায়। নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য রাজধানীতে ৩০টি বেসরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি ১২টি সরকারি হাসপাতাল নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সারা দেশে সেকেন্ডারি টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতালে রোগীদের ভর্তি করা হচ্ছে।

২০১৯ সালে ডেঙ্গু রোগ ভয়াবহ বিস্তার লাভ করে। সে সময় দেশের সবকটি জেলায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। বছরটিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ছাড়ায়। আর মারা যান ১৫০ ডেঙ্গু রোগী। সে বছর আগস্টে সর্বোচ্চ ৫২ লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। গত বছরে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কম ছিল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে নয়, মার্চে ১৩, এপ্রিলে তিন, মে মাসে ৪৩, জুনে ২৭২, জুলাইতে হাজার ২৮৪ এবং আগস্টের ১৩ দিনেই হাজার ৯৮৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। রোগী বেড়ে যাওয়ার ধারা অব্যাহত থাকলে ২০১৯ সালের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

বছরের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গু সন্দেহে ২৪টি মৃত্যুর তথ্য রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে। তবে পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর পর্যালোচনার ফল জানায়নি সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।

জনস্বাস্থ্য রক্তরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু রোগের বিষয়টি করোনার কারণে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়নি। যতটুকু পর্যবেক্ষণ ছিল তা রাজধানীকেন্দ্রিক হওয়ার কারণে জেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু বিস্তার ঠেকাতে পদক্ষেপে ঘাটতি রয়েছে। ২০১৯ সালে যখন ডেঙ্গু মহামারী আকার ধারণ করে, তখন দেশের সব জেলায় ছড়িয়ে যায়। ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধিতে সে সময় ২১ বছরের মধ্যে ছিল সর্বোচ্চ সংক্রমণ।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ডেঙ্গুর সঙ্গে নগরায়ণের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। মূলত স্থানীয় সরকার বিভাগই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে। সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা অপেশাদারিত্বের সঙ্গে কার্যক্রমটি করছে। পরিকল্পনাও ঠিক হচ্ছে না। কীটতত্ত্ববিদ, রক্তরোগ, ভাইরোলজিস্টসহ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ পরামর্শক দল নিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। ২০১৯ সালের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থ হয়েছে উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, সারা দেশে একযোগে সপ্তাহব্যাপী এডিস মশা নিধনের কর্মসূচি পালন করা গেলে তা কার্যকর হতো। এখনো এর বিকল্প নেই।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বলছে, স্থানীয় সরকার বিভাগের অসচেতনতার কারণে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আসেনি। আগেই বিষয়টি দেশের সব সিটি করপোরেশন পৌরসভাকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হয়েছিল।

বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র লাইন ডিরেক্টর (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মূল কাজ করবে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিটি করপোরেশন পৌরসভা। আমরা গবেষণা জরিপসহ বিভিন্নভাবে তাদের সহযোগিতা করব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন