বিশ্বব্যাপী প্রতি
বছর খুন ও যুদ্ধে নিহতের
মোট সংখ্যাকে ছাড়িয়ে
যায় আত্মহত্যাসহ অন্যান্য
মানসিক ব্যাধির ফলে
ঘটা মৃত্যুর সংখ্যা।
বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য
নিয়ে দেশব্যাপী পরিচালিত
একটি সমীক্ষায় দেখা
গেছে প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার
১৬ দশমিক ১ শতাংশ কোনো
না কোনো মানসিক
সমস্যায় আক্রান্ত এবং
লিঙ্গভিত্তিক পর্যালোচনায় পুরুষদের
তুলনায় নারীদের মধ্যে
এ প্রবণতা অনেক
বেশি। ছোট অঞ্চলভিত্তিকভাবে
এ আক্রান্তের হার
সর্বনিম্ন ৬
দশমিক ৫
শতাংশ এবং সর্বোচ্চ
৩১ শতাংশ, আর
এখানেও নারীদের আক্রান্তের
হার ও
আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি
দুটোই বেশি। এছাড়া
শিশুদের মধ্যে আক্রান্তের
হার ১৮ দশমিক
৪ শতাংশ। গ্রাম
ও শহরের তুলনামূলক
গবেষণায় সর্বোচ্চ আক্রান্তের
হার শহরের বস্তি
এলাকায় বসবাসরত শিশুদের
মধ্যে, যেখানে ১৯
দশমিক ৫
শতাংশই কোনো না
কোনো মানসিক সমস্যায়
আক্রান্ত। সব দিক
বিবেচনায় ধারণা করা
যায় যে বর্তমানে
বাংলাদেশের প্রায় ২ দশমিক ৫ কোটি মানুষ
ছোট অথবা বড়
মানসিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যায়
আক্রান্ত। তবুও বাংলাদেশে
মানসিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যাকে
এখনো গতানুগতিক স্বাস্থ্য
সমস্যা হিসেবে ধরা
হয় না এবং
স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে
অগ্রাধিকার দেয়া হয়
না। আর এ কারণেই মানসিক
ব্যাধি সম্পর্কিত এপিডেমিওলজিকাল
এবং স্বাস্থ্যসেবা-সংক্রান্ত
তথ্যের সরবরাহ আর
গবেষণাও খুব কম।
দক্ষ লোকবল
ও অর্থের স্বল্পতার
কারণে বাংলাদেশে আধুনিক
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা অবর্তমান।
মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার
অবকাঠামো-সংক্রান্ত সর্বশেষ
জরিপ হয় ২০১৫
সালে; যাতে দেখা
যায় সারা দেশে
মাত্র ২২০ জন
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং
প্রায় ৫০ জন
প্রশিক্ষিত ক্লিনিক্যাল মনোবিজ্ঞানী
রয়েছেন। তারও আগের
২০০৭ সালে বিশ্ব
স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিওএইচও)
অ্যাসেসমেন্ট ইনস্ট্রুমেন্ট ফর
মেন্টাল হেলথ সিস্টেমস
রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী
মানসিক স্বাস্থ্য সেবাদানকারী
প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রতি এক
লাখ মানুষের জন্য
স্বাস্থ্যকর্মী আছেন শূন্য
দশমিক ৪৯ জন।
এর মধ্যে লাখপ্রতি
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন
শূন্য দশমিক শূন্য
৭৩ জন, সাইকিয়াট্রিক
নার্স আছেন শূন্য
দশমিক ১৯৬ জন,
মনোবিজ্ঞানী আছেন আছেন
শূন্য দশমিক শূন্য
শূন্য ৭
জন, সমাজসেবাকর্মী আছেন
শূন্য দশমিক শূন্য
শূন্য ২
জন, পেশাদার থেরাপিস্ট
আছেন শূন্য দশমিক
শূন্য শূন্য ৩ জন এবং
অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী (সাপোর্ট
স্টাফ, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট,
প্যারা-কাউন্সিলর ইত্যাদি)
আছেন শূন্য দশমিক
শূন্য ২৯ জন।
পরবর্তী সময়ে এ ধরনের জরিপ
বাংলাদেশে আর ঘটেনি।
জরিপ-পরবর্তী সময়ে
যদিও এতদিনে অবকাঠামোগতভাবে
অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন
হয়েছে, তবে এটাও
মনে রাখতে হবে
যে জনসংখ্যা বৃদ্ধিও
এতদিন থেমে থাকেনি,
যেমনটা থেমে থাকেনি
আনুপাতিক বিবেচনায় আক্রান্তের
হারও।
বর্তমানের কথা
বিবেচনা করলে স্বাস্থ্য
খাতে বরাদ্দকৃত মোট
বাজেটের মাত্র শূন্য
দশমিক ৪৪ শতাংশ
ব্যয় হয় মানসিক
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায়। দেশে
মাত্র একটি স্নাতকোত্তর
মানের ইনস্টিটিউট রয়েছে
ঢাকায়, যেটি হলো
আবাসিক রোগীদের জন্য
২০০ বেড সক্ষমতাসম্পন্ন
আর সীমিত বহির্বিভাগ
সেবাদানে সক্ষম জাতীয়
মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
(এনআইএমএইচ)।
এছাড়া মাত্র একটি
৫০০ বেডের মানসিক
হাসপাতাল রয়েছে উত্তরবঙ্গের
পাবনায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে
৫০টির মতো বহির্বিভাগ
ব্যবস্থা আর ৩১টি
সাইকিয়াট্রিক ইউনিট রয়েছে
এবং ১১টি আবাসিক
কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে।
এখানে মনে রাখতে
হবে এগুলোর একটাও
আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নয়।
আর সেবাদানকারী চিকিত্সক
ও অন্যান্য পেশাদার
এবং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও
রয়েছে অনিয়ম, ভুল
চিকিৎসাসহ নানা অভিযোগ।
এবার একটু
ভিন্ন আঙ্গিকে রোগীদের
বা সেবাগ্রহীতাদের দিকটা
দেখা যাক। একটি
সমীক্ষায় দেখা গেছে,
কেবল ১৬ শতাংশ
রোগী নিজের বা
পরিবারের উদ্যোগে সরাসরি
পেশাদার মানসিক স্বাস্থ্যসেবা
নিতে যায়। সবচেয়ে
বড় অংশ. যাদের জড়ি-বুটি, ঝাড় ফুঁক, শিকড়-বাকল,
তন্ত্র-মন্ত্রে আস্থা
বেশি, তারা চিকিৎসা
বা পরামর্শ নেন
দেশীয় বা স্থানীয়
বৈদ্য বা ধর্মপ্রচারক
ও নিরাময়কারীদের কাছে।
এ রোগীরাই কোথায়,
কার কাছে চিকিৎসা
বা পরামর্শ নেবে,
সেই পরামর্শ নেয়
পুরনো রোগী, আত্মীয়স্বজন
আর বন্ধুবান্ধবের কাছ
থেকে। কারণ প্রতিষ্ঠিত
চিকিৎসা ব্যবস্থা তাদের
স্বতন্ত্র রীতিনীতি, বিশ্বাস,
মান, ইতিহাস আর
সংস্কৃতিগত পার্থক্যকে আমলে
নেয় না। পাশাপাশি
সঠিক সেবার প্রয়োজনীয়তা
স্বীকারেও রয়েছে দীর্ঘ
বিলম্ব, যা সেবা
অনুসন্ধান পূর্ববর্তী ধাপকে
দীর্ঘায়িত করে। সমীক্ষায়
দেখা গেছে যে
গ্রামাঞ্চলের দুই-তৃতীয়াংশ
(৬৫.৪%)
রোগীর ক্ষেত্রে সমস্যার
সূত্রপাতের পরে সর্বনিম্ন
তিন মাস থেকে
সর্বোচ্চ একাধিক বছর
পর্যন্ত বিলম্ব হয়
হাসপাতালে বা অন্য
পেশাদারি মাধ্যমে চিকিৎসা
নেয়ার আগে। আর
শহরে এই গড়
বিলম্ব কমপক্ষে ১০
সপ্তাহের। এ বিলম্বের
সবচেয়ে বড় কারণ
হলো সমস্যা আর
সমস্যার গুরুত্ব সম্পর্কে
সচেতনতার অভাব (৬৯%)। সেই
সঙ্গে উল্লিখিত সেবার
দুষ্প্রাপ্যতা তো আছেই।
এত কিছুর পরে
বর্তমান করোনাভাইরাস উদ্ভূত
পরিস্থিতিতে সচেতনদের জন্য
আর সহজলভ্য অবস্থায়ও
সেবাগ্রহণ কষ্টকর হয়ে
দাঁড়াচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য
সংস্থার জরিপে দেখা
গেছে উন্নত দেশগুলোয়ও
গুরুতর মানসিক অসুস্থতায়
ভুগছে এমন ৩৫-৫৫ শতাংশ
রোগী গত ১২
মাসে সঠিক সেবার
দেখা পায়নি।
উল্লিখিত সবকিছু
বিবেচনায় জনসচেতনতা বৃদ্ধির
পাশাপাশি আমাদের এখনই
প্রয়োজন দেশব্যাপী অন্তত
প্রাথমিক পর্যায়ের মানসিক
স্বাস্থ্যসেবাটা নিশ্চিত করা।
বর্তমান যুগের মোবাইল
নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট, ভিডিও
কনফারেন্স ইত্যাদি প্রাথমিক
পর্যায়ের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা
নিশ্চিত করার কাজকে
অনেক সহজ করে
দিয়েছে। টেলি-স্বাস্থ্যসেবার
ধারণা এখন ভৌগোলিক
দূরত্বের সমস্যা দূর
করে সেবাদানকারী ও গ্রহণকারীকে কাছে
নিয়ে এসেছে। এর
মাধ্যমে এখন সবচেয়ে
দূরবর্তী গ্রামেও প্রাথমিক
সেবা পৌঁছানো সম্ভব।
এখানে মেডিকেলি অনগ্রসর
অঞ্চল এবং জনগোষ্ঠীগুলোকে
নিয়ে সাধারণের চেয়ে
বেশি করে ভাবতে
হবে। কারণ এ রোগীদের প্রায়
সবাই মূলত শিশু,
বয়স্ক ও
প্রতিবন্ধী।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা,
অস্ট্রেলিয়া ও
পশ্চিম ইউরোপের উন্নত
দেশগুলো টেলিসেবাকে কাজে
লাগিয়ে এর মধ্যেই
অনগ্রসর অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীগুলোর মাঝে
সেবা প্রদানে অভূতপূর্ব
সাফল্য পেয়েছে। আমাদের
দেশেও এরই মধ্যে
বেশ কয়েকটি লাভজনক
ও অলাভজনক বেসরকারি
ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান
নিজেদের উদ্যোগে টেলিসেবার
মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা
দেয়া শুরু করেছে।
এখন পর্যন্ত এ সেবাগুলোয় মানুষের
অংশগ্রহণ ও
প্রতিক্রিয়া বেশ আশাব্যঞ্জক।
এরই মধ্যে যারা
সেবা গ্রহণ করেছে,
তাদের ভৌগোলিক অবস্থান
ও অর্থনৈতিক অবস্থা
এটাই নির্দেশ করে
যে যথাযথভাবে জনসচেতনতা
বৃদ্ধির উদ্যোগ নিলে
এবং টেলিসেবার প্রচার
ও শক্ত অবকাঠামো
তৈরি হলে এর
সুবিধা গ্রহণ করার
জন্য আমাদের জনগণ
এখনই প্রস্তুত। পাশাপাশি
অবশ্যই জাতীয়ভাবে প্রথাগত
চিকিৎসা ও
স্বাস্থ্যসেবায় মানসিক স্বাস্থ্যের
অন্তর্ভুক্তি, আধুনিকায়ন এবং
চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয়
অবকাঠামো প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ
নিতে হবে।
হোসাইন মোহাম্মদ
ওমর খৈয়াম, মৃন্ময়
সমদ্দার এবং তূর্য
নিকোলাস মন্ডল
লেখকরা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত এবং বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অগ্রগতি বিষয়ে গবেষণারত