বেসিক ব্যাংকের সঙ্গে বিডিবিএল একীভূত হচ্ছে কি

হাছান আদনান

বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিএসবি) বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থাকে (বিএসআরএস) একীভূত করে জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) কিন্তু যে উদ্দেশ্যে বিশেষায়িত ব্যাংকটির জন্ম তার কিছুই অর্জিত হয়নি গত এক দশকে। অন্যদিকে ২০০৯ সাল-পরবর্তী চার বছরে লুণ্ঠনের শিকার হয় রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সেরাপ্রতিষ্ঠান বেসিক ব্যাংক। সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির ভারে বিধ্বস্ত ব্যাংকটি এখন নিবুনিবু। অস্তিত্বের সংকটে থাকা দুটি ব্যাংককে একীভূতকরণের উদ্যোগ নিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনী প্রস্তাব পাস হলে প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।

বেসিকের সঙ্গে বিডিবিএলের একীভূতকরণের বিষয়ে খসড়া একটি পরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, সেখান থেকে দিকনির্দেশনা পেলে বিষয়টি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় পরবর্তী কার্যক্রম এগিয়ে নেবে। তবে এরই মধ্যে বেসিক ব্যাংকের জনবল কাঠামোকে (অর্গানোগ্রাম) বিডিবিএলের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে তুলতে উদ্যোগ নেয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

তবে একীভূতকরণের বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ব্যাংক দুটির শীর্ষ নির্বাহীরা। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, শূন্যের সঙ্গে শূন্য যোগ করলে ফলাফল শূন্য, আবার গুণ করলেও শূন্য। দুর্বল দুটি ব্যাংককে একীভূত করে কোনো লাভ হবে না।

বেসিকের সঙ্গে বিডিবিএলের একীভূতকরণের আলোচনা এগিয়েছে বলে জানান বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনিসুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী করতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। এরই মধ্যে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধন প্রস্তাবের খসড়া মন্ত্রিসভায় পাস হয়েছে। সংশোধন প্রস্তাব জাতীয় সংসদে পাস হলে বেসিক ব্যাংকের সঙ্গে বিডিবিএলের একীভূতকরণ প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত হবে বলে শুনেছি।

দুটি দুর্বল ব্যাংক একীভূত হলে লাভ কী হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে আনিসুর রহমান বলেন, খুব বেশি লাভ হবে এমনটি মনে করছি না। বিডিবিএলও খুব দুর্বল একটি ব্যাংক। বেসিকের সঙ্গে একীভূত না করে বিডিবিএলকে সোনালী বা অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে জুড়ে দেয়া যেতে পারে। মুহূর্তে বেসিক ব্যাংকের মূল সমস্যা হলো উচ্চসুদের আমানত। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের বরাদ্দ বেসিক ব্যাংকে আমানত হিসেবে এলে কস্ট অব ফান্ড কমত। দুই মাস হলো বেসিক ব্যাংকে যোগদান করেছি। ব্যাংকটিকে ঘুরে দাঁড় করাতে যা যা করা দরকার, সেটি এরই মধ্যে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে লিখিত আকারে জানিয়েছি।

বেসিক ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে তীব্র আপত্তি আছে বিডিবিএলের। বিষয়ে বিডিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী আলমগীর বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে এত ভালো ব্যাংক থাকতে বেসিকের সঙ্গে কেন একীভূত হতে হবে। বিডিবিএলকে যদি একীভূত করতেই হয়, সেটি রাষ্ট্রায়ত্ত বড় কোনো ব্যাংকের সঙ্গে করা যেতে পারে। তবে মুহূর্তে বিডিবিএল বেশ ভালো আছে। আমাদের ব্যাংক মূলধন কিংবা সঞ্চিতি ঘাটতিতে নেই। গত বছরও আমরা মুনাফা করেছি। ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিডিবিএলে যোগ দিয়েছে। বেশকিছু নতুন প্রডাক্ট আমরা চালু করেছি। বিদ্যমান ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থাকলে বিডিবিএলের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।

ঋণ শৃঙ্খলায় ঘাটতি থাকলেও দেশের অসংখ্য শিল্পোদ্যোক্তা বেড়ে ওঠার সিঁড়ি ছিল বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিএসবি) এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা (বিএসআরএস) ২০০৯ সালে দুটি প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করে দিয়ে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) গঠনের উদ্যোগ নেয় সরকার। সব প্রক্রিয়া শেষে ২০১০ সালের জানুয়ারি যাত্রা করে বিডিবিএল। কিন্তু যাত্রাকালেই ঋণ বিতরণে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে ব্যাংকটির তত্কালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা। ফলে বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেকের বেশি খেলাপি হয়ে যায় ব্যাংকটির। তবে গত দুই বছরে পুনঃতফসিলসহ বিভিন্ন মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমিয়ে এনেছে বিডিবিএল।

গত ডিসেম্বর শেষে বিডিবিএলের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৯৫ কোটি টাকাই ছিল খেলাপি ঋণ। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৩৩ দশমিক ৮৮ শতাংশই খেলাপি। বর্তমানে বিডিবিএলের কাছে জমা আছে গ্রাহকদের হাজার ৫০০ কোটি টাকার আমানত। একই সঙ্গে হাজার ২৫০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। ছয়টি আঞ্চলিক কার্যালয়, ৪৭টি শাখা ৭২৩ জন কর্মী নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে বিডিবিএল।

বাংলাদেশ স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কমার্স (বেসিক) ব্যাংক লিমিটেডের যাত্রা ১৯৮৯ সালে। প্রতিষ্ঠার পরের দুই দশক দেশের সেরা ব্যাংক হিসেবেই বিকাশ হয়েছিল বেসিক ব্যাংকের। ২০০৯ সাল পর্যন্ত বেসিক ব্যাংককে তুলনা করা হতো বৈশ্বিক জায়ান্ট স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের সঙ্গে। কিন্তু আবদুল হাই বাচ্চুর নেতৃত্বে লুটপাটের শিকার হয়ে দেউলিয়া হওয়ার মুখে ব্যাংকটি।

লুণ্ঠনের শিকার হওয়ার পর গত আট বছরে বেসিক ব্যাংক নিট লোকসান দিয়েছে হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। সময়ে ব্যাংকটিকে বাঁচিয়ে রাখতে রাজস্ব থেকে হাজার ৩৯০ কোটি টাকা জোগান দিয়েছে সরকার। তার পরও হাজার ৮০০ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে ব্যাংকটি। পাশাপাশি হাজার ২৮৮ কোটি টাকা সঞ্চিতি ঘাটতিও রয়েছে বেসিক ব্যাংকের। গত ডিসেম্বরে বেসিক ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে হাজার ৫০২ কোটি টাকাই ছিল খেলাপির খাতায়। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৫১ শতাংশের বেশি খেলাপি, যা মন্দমানের হওয়ায় আদায়ের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। দেশজুড়ে ৭২টি শাখা হাজার ১০০ কর্মী নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে বেসিক ব্যাংক।

বেসিক ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব . নাহিদ হোসেন। বেসিক ব্যাংকের সঙ্গে বিডিবিএলের একীভূতকরণ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। তবে এখনো বলার মতো কিছু হয়নি। ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনী প্রস্তাব পাস হওয়ার পর্যায়ে রয়েছে। আইনের সংশোধনী প্রস্তাবে দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণের বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা প্রক্রিয়া তুলে ধরা হয়েছে।

দেশের ব্যাংক খাতের ভিত শক্তিশালী করতে মার্জার-অ্যাকুইজিশনের নীতি প্রণয়নের দাবিটি দীর্ঘদিনের। পরিস্থিতির বিচারে ১৯৯১ সালের ব্যাংক কোম্পানি আইনে আবারো সংশোধনীর উদ্যোগ নেয় সরকার। বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে গত ১৭ মে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনী প্রস্তাব পাস হয়। সংশোধনী প্রস্তাবে আইনটিতে অন্যান্য বিধানের পাশাপাশি ষষ্ঠ- খণ্ড নামে একটি অধ্যায় যুক্ত করা হয়। দুর্বল ব্যাংক-কোম্পানির ব্যবস্থাপনা শীর্ষক অধ্যায়ে দুর্বল সংকটাপন্ন ব্যাংকের পুনরুদ্ধার বা বিলুপ্তির বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান তুলে ধরা হয়েছে।

প্রস্তাবিত আইনে দুর্বল ব্যাংকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে কোনো ব্যাংককে অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দিতে পারবে। আবার দুটি ব্যাংকের স্বতঃপ্রণোদিতভাবে একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়াও সহজ করা হয়েছে।

তবে বেসিকের সঙ্গে বিডিবিএলের একীভূত হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, দুটি ব্যাংককে একত্র করে কোনো লাভ হবে না। বরং বিদেশী উদ্যোক্তাদের ব্যাংক দুটিতে বিনিয়োগ করার জন্য আহ্বান জানানো যেতে পারে। তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করেও কোনো লাভ নেই। কারণ সরকারি খাতের কোনো ব্যাংকই ভালো নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন