সেরাম ইনস্টিটিউটের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার সুপারিশ

চুক্তি ও আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি অগ্রিম অর্থ পরিশোধের পরও চুক্তি অনুযায়ী করোনার টিকা সরবরাহ না করায় ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া যায় কিনা, তা পর্যালোচনার সুপারিশ করেছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি ডোজ কিনতে গত বছর চুক্তি করে সরকার। প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে টিকা আসার কথা থাকলেও প্রথম চালান আসার পর দ্বিতীয় চালানে আসে মাত্র ২০ লাখ ডোজ। গত দুই মাসে চুক্তি অনুযায়ী কোনো টিকা সরবরাহ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। এতে বাংলাদেশের টিকাদান কার্যক্রমের গতি স্থবির হয়ে পড়ে। বারবার অনুরোধ করার পরও কোনো টিকা পাঠায়নি সেরাম। সংস্থাটি ভারত সরকারের রফতানি নিষেধাজ্ঞার কথা বলছে। কিন্তু চুক্তি হয়েছে নিষেধাজ্ঞার আগে এবং টিকার জন্য আগাম অর্থও দিয়েছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতে সেরামের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ ইতিবাচক। এক্ষেত্রে ভারতের আদালত বা আন্তর্জাতিক আদালতেও যাওয়া যায় কিনা, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, চুক্তির ১২ ধারায় বিভিন্ন পক্ষের দায়দায়িত্বের বিষয়ে বলা আছে। ওই ধারায় বলা হয়েছে, চুক্তির অন্যত্র ভিন্ন কিছু বলা না থাকলে কোনো পক্ষ যদি পরোক্ষ বা বিশেষভাবে কিংবা বিশেষ কোনো পরিস্থিতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে কেউ দায়ী থাকবে না। ১৩ ধারায় কিছু অপ্রতিরোধ্য কারণের (ফোর্স মেজর) কথা উল্লেখ আছে। অপ্রতিরোধ্য কারণের মধ্যে সরকারের আরোপিত বিধিনিষেধও (রেস্ট্রিকশনস অব গভর্নমেন্ট) আছে। ধরনের অপ্রতিরোধ্য কারণে যদি চুক্তি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে প্রত্যেক পক্ষ বিকল্প উপায়ে কাজটি করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। আরো বলা আছে, কেউ যদি ওই অপ্রতিরোধ্য কারণে দায়িত্ব পালন করতে না পারে, তাহলে তা অবিলম্বে অন্য পক্ষকে নোটিস দিয়ে জানাতে হবে এবং বিলম্বটা কত দিনের হবে, তাও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। এক্ষেত্রে চুক্তির প্রতিটি ধারা বিশ্লেষণ অন্যান্য আইন পর্যালোচনাপূর্বক সেরামের বিরুদ্ধে ভারতের আদালতে বা আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার বিষয়টি যাচাই করে দেখা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেই ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ চুক্তির সাথে তারা জড়িত। আইন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। চুক্তিকে সম্মান না জানানো ছাড়াও সময়মতো টিকা সরবরাহের ক্ষেত্রে আস্থা রাখার মতো পরিকল্পনা নিশ্চিত করতে না পারার কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোম্পানিটির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেছিল। পরবর্তী সময়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে এসেছে উভয় পক্ষ।

সেরাম ইনস্টিটিউট টিকা তৈরির বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে নানা সহযোগিতা পেয়েছে। সেই হিসেবে আন্তর্জাতিক দেশগুলোর সঙ্গে টিকা রফতানিতে একটা প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার রয়েছে তাদের। সেটাকে তারা এড়িয়ে যাচ্ছে। এখন তাদের দেশের ভেতরে টিকার চাহিদা বেশি। কাজেই তারা সেই চাহিদা পূরণ করবে বলে স্থগিতাদেশ দিয়েছে। একটা দেশের সরকার সব ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মানেই তো দেশের বাইরে স্বাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। তবে এখানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইন সম্পর্কিত কোনো বিষয় থাকলে সেটা ভিন্ন কথা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কিছু আইনকানুন আছে। একটি দেশের কোম্পানির সঙ্গে যদি অন্য আরেকটি দেশের কোম্পানির চুক্তি হয়, তাহলে দেশের সরকার এটার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। যদি এখানে প্রভাব বিস্তার করতে চায় তাহলে সেটা আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধে চলে যাবে। অবস্থায় সেরাম ইনস্টিটিউটের যদি টিকা থাকে, আর যদি সেগুলো আমাদের দিতে না চায়, তাহলে সরকার বা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কোম্পানি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক আদালত চাইলে সেরামকে কালো তালিকাভুক্ত করে দিতে পারে বা ক্ষতিপূরণও পেতে পারে বাংলাদেশ।

সব মিলিয়ে বাস্তবতা হচ্ছে, বেশি টাকা দেওয়ার পরও আমরা টিকা পাচ্ছি না? এদিকে ভারতের করোনা পরিস্থিতির যে খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে খুব দ্রুত যে সেখান থেকে টিকা পাওয়া যাবে, তেমন সম্ভাবনাও নেই। বেশি বেশি মানুষকে টিকা দিতে রফতানি নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি তারা নিজেরাও বিভিন্ন দেশ থেকে টিকা আমদানি করছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকার যে ভ্যাকসিন মজুদ আছে, তাতে সবার দ্বিতীয় ডোজ পাওয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি পড়বে। এক্ষেত্রে প্রথম ডোজ গ্রহীতা দ্বিতীয় ডোজ যাতে একই ভ্যাকসিন পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। ভারতের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সেরাম ইনস্টিটিউট যদি আমাদের চুক্তিমাফিক এখন সব ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে নাও পারে, অন্তত দ্বিতীয় ডোজের জন্য যে-সংখ্যক ভ্যাকসিন প্রয়োজন, সেই ভ্যাকসিন সেখান থেকে আনার ব্যবস্থা করতে হবে উভয় দেশের সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিয়ে জিতে আসার উদাহরণ আমাদের রয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে এটি বিশেষ পরিস্থিতি। সেক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে এলে সুফল মিলবে বেশি। ভালো হয় চুক্তি অনুযায়ী টিকা দিতে না পারার ক্ষতিপূরণ আদায়ের পদক্ষেপ নিলে। বিশ্বে এমন উদাহরণ কিন্তু রয়েছে। কোম্পানি চুক্তি অনুযায়ী পণ্য দিতে না পারায় সালিশি আদালতের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ আদায়ের একাধিক ঘটনা আমাদের সামনে রয়েছে। বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কোম্পানি বা সরকার ভারতের আদালতে বা আন্তর্জাতিক আদালতেও মামলা করতে পারে কিনা, তার জন্য আইন চুক্তি অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হোক। একই সঙ্গে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের স্বার্থে চুক্তিটি জনসাধারণের সামনে উন্মুক্ত করা প্রয়োজন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন