উন্নয়ন ভাবনায় পানি ও নদী সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে

২৭ মার্চ ২০২১ তারিখে এএলআরডি, বেলা, পানি অধিকার ফোরাম বণিক বার্তার উদ্যোগে জীবনের অপরিহার্য পানি সম্পদ নদী-জলাশয় সুরক্ষা: রাষ্ট্র নাগরিকের করণীয় শীর্ষক অনলাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচকদের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে ক্রোড়পত্র।

 


দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

সম্পাদক

বণিক বার্তা

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সময়ে আমাদের আলোচ্য বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যথোপযুক্ত। দুই-আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি, পানিকে ঘিরেই অঞ্চলের সভ্যতা গড়ে উঠেছে। এখনো পানি আমাদের উন্নতি সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে। অনেক দিক থেকে আমরা এটা বুঝতে পারি। উন্নয়নের কেন্দ্রীয় জায়গায় দীর্ঘদিন ধরে আমাদের পানিকেন্দ্রিক পরিবহন ব্যবস্থা, নদী পানি অবহেলিত ছিল। তবে বিলম্বে হলেও সরকার একটি ডেল্টা প্ল্যান প্রণয়ন করেছে। কিছু তর্কবিতর্ক থাকলেও ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনায় পানিকেন্দ্রিক বিশেষ দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে যাওয়ার যে সংকল্প, সেখানে পানি নদীকে প্রধান জায়গা হিসেবে দেখা উচিত। নইলে দুটি বিষয়ই সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে আমাদের সামনে আবির্ভূত হবে।

 



খুশী কবির

চেয়ারপারসন, এএলআরডি

সমন্বয়কারী, নিজেরা করি

আমাদের দেশ বদ্বীপ। বদ্বীপে নদী, খাল জলাশয়গুলো সবসময় স্থায়িত্বশীলভাবে থাকবে তাও নয়। তবে পানির উৎসগুলোকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, উন্নয়নের নামে প্রকৃতির ভারসাম্য যেন হারিয়ে না যায়, সেটিও ভাবা উচিত। জলাশয়, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, নদ-নদী আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ। সাহিত্য, কবিতা লোকসংগীতে পানি একটি বিশাল স্থান নিয়ে আছে। অনেক দেরিতে হলেও বদ্বীপ পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা যেন সঠিকভাবে করা হয়, সেখানে সংশ্লিষ্ট সবার স্বার্থ মতামত যেন বিবেচনায় থাকে। এটি যেন কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণী বা গোষ্ঠীর স্বার্থে না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তথাকথিত উন্নত দেশগুলো উন্নয়নের নামে ধরিত্রীকে যে ঝুঁকিতে ফেলেছে, আমরা যেন সেটা না করি। আমাদের দেশে যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখে কাজ করতে হবে।

 



এনামুল হক শামীম

উপমন্ত্রী

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়

আজকের আলোচনার বিষয়টি খুবই প্রাসঙ্গিক। শিল্পায়নের কারণে প্রকৃতির ভারসাম্যের ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতির ভারসাম্য আসলে নষ্ট হচ্ছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সরকার ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ হাতে নিয়েছে। এর ৮০ শতাংশ বাস্তবায়ন হবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। ডেল্টা প্ল্যানের বাইরেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জেলাভিত্তিক বরাদ্দ দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ছে। ১৬ হাজার ৭০০ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় সাত হাজার কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। ডুবো বাঁধ রয়েছে আড়াই হাজার কিলোমিটারের মতো। নদীভাঙনের কবল থেকে বাঁচাতে স্থায়ী প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। নদীর তীর সংরক্ষণের পাশাপাশি ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর প্রবাহ ঠিক রাখার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। রাষ্ট্রের পাশাপাশি জনগণেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। পানির  অপচয় রোধ করতে হবে। এটিকে সম্পদ হিসেবে ভেবে যতুটুক দরকার ততটুকুই কাজে লাগাতে হবে। কোথাও যেন পানির অপচয় না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

 


সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

প্রধান নির্বাহী, বেলা

এবারের পানি দিবসের প্রতিপাদ্য হলো পানির মূল্যায়ন করা (ভ্যালুয়িং ওয়াটার) আজকের প্রবন্ধে আমরা কিছু আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার, কিছু আন্তর্জাতিক বাস্তবতা আর কিছু দেশীয় বাস্তবতার দিকে মনোনিবেশ করব। আন্তর্জাতিক দলিল যেমন ইন্টারন্যাশনাল কভন্যান্ট অন সোস্যাল, কালচারাল অ্যান্ড ইকোনমিক রাইটসের অনুচ্ছেদ ১১ ১২-তে সুস্থ জীবনযাপনের অধিকার এবং খাদ্যের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এর সঙ্গে বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার অধিকার ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। এটি পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের মানবধিকার কাউন্সিল কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করেছে। মানবাধিকার কাউন্সিল বলেছে, পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি পাওয়ার অধিকার তার মানবিক মর্যাদাই হলো মানবধিকার। ২০০২ সালে জাতিসংঘের কমিটি ফর ইকোনমিক, কালচারাল অ্যান্ড সোস্যাল রাইটসে গৃহীত ১৫নং সাধারণ মন্তব্যে বলা হয়েছে, পানির অধিকার এককভাবেই একটি আলাদা অধিকার। এককভাবেই অধিকারকে আমাদের সম্মান করতে হবে। আমাদের জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান নির্ধারণ করতে গেলে পানির অধিকারকে অন্যতম মৌলিক পূর্বশর্ত হিসেবে মানতে হবে। বেঁচে থাকার জন্য এটিকে একটি মৌলিক পূর্বাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। বলা হচ্ছে, ২০৩০ সালে বিশ্বে পানির চাহিদা বাড়বে ৪০ শতাংশ। এখন যে পরিমাণ পানি আছে, তাতেই আমাদের প্রচণ্ড হাহাকার। ফলে নতুন করে বিশুদ্ধ পানি কোথা থেকে আসবে, তা কেউ জানে না। বিদ্যমান পানির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার আর পানির অপচয় রোধ করেই আমাদের এগোতে হবে। বলা হচ্ছে, দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোয় ৯০ শতাংশের বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্য ভূ-উপরস্থ পানিতে ফেলা হয়। এর অর্থ আমাদের ভূ-উপরস্থ পানি শিল্পবর্জ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের শহর এলাকায় অর্ধেকের বেশি মানুষ বস্তিতে বসবাস করবে, যেখানে বিশুদ্ধ পানির সুবিধা থাকবে না। বিশ্বের ৮৮৪ মিলিয়ন মানুষ নিরাপদ খাওয়ার পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দশমিক মিলিয়ন লোক বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পানির অধিকার এবং পানির কথা আমরা বলি। এখানে সাম্য প্রতিষ্ঠা একটি বড় ব্যাপার, যা বাংলাদেশ এবং বিশ্ব বাস্তবতায় একইভাবে প্রযোজ্য। বলা হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশে একজন দরিদ্র নাগরিককে প্রতি লিটার পানির জন্য অবস্থাসম্পন্নদের তুলনায় ১২ গুণ বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়। এটি বৈশ্বিক পরিসংখ্যান। বলা হচ্ছে, বিশ্বে প্রতি বছর দশমিক ট্রিলিয়ন গ্যালন পানির অপচয় হয়।

আমরা নদ-নদীর ওপর নির্ভরশীল। ভূগর্ভস্থ পানি চোখে দেখা যায় না বলে পানি বললেই মানুষ সাধারণত নদ-নদীর পানিকে বোঝে। কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানির ওপর আমাদের অনেক বেশি নির্ভরতা পানি রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা সুরক্ষার কথা বলতে গেলে সবাই শুধু নদী রক্ষার কথা বলে। দৃশ্যমান হওয়ায় নদীর পানির বিষয়টি দ্রুত আমাদের সামনে আসে সত্য। কিন্তু কৃষি, সুপেয় পানি শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর আমাদের নির্ভরতা অনেক। অথচ ভূগর্ভস্থ পানি সংরক্ষণে আমরা একেবারেই মনোযোগী নই। এগুলো সংরক্ষণে নাগরিক আন্দোলনের অভাব রয়েছে। আন্তর্জাতিক নদী বিশ্বের ৬০ শতাংশ মিঠা পানির চাহিদা পূরণ করে। ১৪৫টি আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠী নির্ভরশীল। বিশ্বের জলরাশির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত হয় ফসল উৎপাদনে, শিল্প-কারখানায় এবং পানীয় জল হিসেবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যও আমরা পানি ব্যবহার করি। 

এবার বাংলাদেশের পরিসংখ্যানে আসি। শুধু ঢাকাতেই ওয়াসার গভীর নলকূপ আছে এক হাজার। আর বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের রয়েছে সাত হাজার। প্রতি বছর তিন মিটার করে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। খরায় আক্রান্ত ভূমির পরিমাণ প্রায় ৫৫ লাখ হেক্টর। ঢাকায় প্রতিদিন পানির চাহিদা প্রায় ২৫০ কোটি লিটার এবং এটি বাড়ছে। ঢাকার সঙ্গে পাহাড়ি এলাকা বা উপকূলীয় অঞ্চলের তুলনা করলে দেখা যায়, উপকূলীয় এলাকায় একজন মানুষকে পানি সংগ্রহের জন্য গড়ে ঘণ্টা হাঁটতে হয়। আর মোট আয়ের ২৫-৩০ শতাংশ খরচ হয় শুধু পানির জন্য। তার পরও উপকূলীয় এলাকার ২৩ শতাংশ মানুষ লবণাক্ত অনিরাপদ পানি পান করে। জাতিসংঘের এক গবেষণায় উঠে এসেছে ৭৪ শতাংশ পানি সংগ্রহের কাজ নারীরা করেন। ৬৩ শতাংশ মানুষের খাওয়ার পানি পেতে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। ৭৫ শতাংশ মানুষ হ্যান্ড টিউবওয়েলের ওপর নির্ভর করে, যদিও অনেক এলাকায় সেগুলো থেকে ঠিকমতো পানি মিলছে না। প্রায় ৪১টি জেলায় আর্সেনিকের প্রভাব রয়েছে। আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, পয়োবর্জ্য দিয়ে দূষিত পানি পান করে ৪১ শতাংশ জনগোষ্ঠী। কেবল ৩৪ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পায়। কোটি ৯৪ লাখ মানুষ আর্সেনিক দূষিত পানির মুখোমুখি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় পানি একটা সাম্যের বিষয়। খুব রক্ষণশীলভাবে হিসাব করলেও দেখা যায়, উপকূলের মানুষ পানি পেতে ঢাকার মানুষের চেয়ে চার গুণ বেশি খরচ করে। ৭০ শতাংশ বস্তিবাসীর পানি পাওয়ার বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। একজন নগরবাসী হিসেবে আমি ১৪০ লিটার পানি পেলেও সেই অনুপাতে একজন বস্তিবাসী পায় ২০ লিটার পানি। সরকার পানির জন্য যত অর্থ ব্যয় করে, তার ৮০ শতাংশই খরচ করে শহরের মানুষের জন্য। মাত্র ২০ শতাংশ খরচ করে গ্রামের মানুষের জন্য। কৃষি খাতে পানি বেশি অপচয় হয়। বাংলাদেশে পানি প্রাপ্যতার আরেকটি উদীয়মান সমস্যা জলবায়ু পরির্তনের চ্যালেঞ্জ প্লাস্টিক দূষণ। সমুদ্রের আগ্রাসনের জন্য আমাদের সুপেয় পানির অনেক আধারই লবণাক্ত হয়ে গেছে, ভবিষ্যতে এটি আরো বাড়বে। আমাদের জলাশয়গুলোয় প্লাস্টিক দূষণ মারাত্মকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে এখনো বিভ্রান্তি রয়েছে। কেউ বলছে, বাংলাদেশে নদ-নদীর সংখ্যা ৭৭০। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে ৪০৫টি।  নদনদীর সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ খুবই জরুরি। 

দূষণ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুপেয় পানির বড় সংকট তৈরি হচ্ছে। এশিয়া প্যাসিফিকের নদীর পানির মধ্যে বাংলাদেশের নদীর পানি সবচেয়ে বেশি দূষিত বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। এর মধ্যে ২৯টি নদী মারাত্মকভাবে দূষণের শিকার। তাছাড়া বাংলাদেশে জলাভূমি হারানোর হার বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আমাদের সংবিধানে জলাশয় রক্ষাসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষার কথা রয়েছে। জীবনের অধিকার পানি অধিকারের সমার্থক। পানি সুস্থ বাতাসের অধিকার না থাকলে জীবনের অধিকার অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। পানি সরবরাহের জন্য শহর এলাকায় ওয়াসা আছে এবং স্থানীয় পর্যায়ে রয়েছে স্থানীয় সরকারের সংস্থাগুলো। পানি নিয়ে কায়কারবার করে এমন প্রতিষ্ঠানের তালিকা বেশ দীর্ঘ। নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে উচ্চ আদালতে রায় হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি করে নদ-নদী জলাশয়ের ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণয় করতে হবে। ভূমি দখলকে ফৌজদারি অপরাধ ঘোষণা করা হয়েছে রায়ে। তার পরও নদী দখল থেমে নেই। দখলের কারণে মেঘনা থেকে ঢাকা শহরে পানি আনার প্রকল্প থেকে দাতা সংস্থা অর্থ প্রত্যাহার করছে। মেঘনায় দখলদারদের উচ্ছেদে সরকারের দৃশ্যত উদ্যোগ নেই। উপকূলীয় এলাকা, দক্ষিণাঞ্চল বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি সংকট প্রকট। তিন অঞ্চলের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাণিজ্যিক বনায়ন করার কারণে সব ঝরনা শুকিয়ে যাচ্ছে। এসব প্লান্টেশনের একটি সামাজিক অর্থনৈতিক প্রভাব সমীক্ষা করে এগুলো বন্ধ করে সেখানে প্রাকৃতিক বনায়ন নিশ্চিত করতে হবে। পার্বত্য এলাকার নদীগুলো থেকে বালি পাথর উত্তোলনে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে। এগুলো নদীর পানি প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। উপকূলীয় এলাকার জন্য অবশ্যই বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের কথা ভাবতে হবে। গোটা দেশের পানি প্রাপ্যতা ম্যাপিং করে সেই তথ্যগুলো জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। নইলে মানুষ সচেতন হবে না। ডিপ টিউবওয়েল নিরুৎসাহিত করতে হবে। জলাধারের ব্যবস্থা করতে হবে।

মারাত্মক দূষণের শিকার ২৯টি নদীকে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া ঘোষণা করতে হবে। দূষণকারী দখলদারদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এখন পর্যন্ত একটি নদীও সরকার পূর্ণ দখলমুক্ত করতে পারেনি। দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ করতে হবে, প্রয়োজনে প্রণোদনা দিয়ে হলেও নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে। নদী দূষণ দখলের শিকার হলে কীভাবে প্রাণবৈচিত্র্য হারিয়ে যায়, তার একটা মূল্যায়ন করা এখন সময়ের দাবি। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। দূষণ দখল বন্ধে সোচ্চার হতে হবে। পানি ব্যবহারে রেশনিং করতে হবে।

 

. মো. মনজুরুল কিবরিয়া

অধ্যাপক সমন্বয়ক হালদা রিসার্চ সেন্টার

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের হিসাব অনুযায়ী নদীর সংখ্যা ৭৬৭। এর মধ্যে যদি বাংলাদেশে কোনো নদীর সাফল্যের গল্প থাকে, তাহলে সেটি হলো হালদা নদী। নদীতে আমাদের সমন্বয়ের অভাবে কীভাবে কিছু আত্মঘাতমূলক সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে, সেটিই আমি তুলে ধরব। প্রথমত, হালদা আমাদের এখানকার নদী। এটি বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী, যেখানে মাছের ডিম সংগ্রহ করা হয়। মত্স্য প্রজননক্ষেত্র হিসেবে এরই মধ্যে দেশব্যাপী প্রশংসিত। ঢট্টগ্রাম শহরবাসীর পানির একমাত্র উৎস এটি। এজন্য এটিকে আমরা বলি লাইফলাইন। এটি একটি প্রাকৃতিক ব্রিডার। চারটি প্রজাতির মাছরুই, কাতলা, মৃগেল কালবাউশ প্রজাতি মাছের মৌলিক ভ্যারাইটি নদীতে আছে। কোনোভাবে হালদা নদী বিপন্ন হলে চার প্রজাতির মাছের আসল ভ্যারাইটি পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য এটিকে আমরা প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক বলি। এছাড়া একটি বিরল ডলফিনের সবচেয়ে বড় পপুলেশন মুহূর্তে হালদা নদীতে আছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এটি একটি অনন্য নদী। দীর্ঘদিন ধরে নদীকে শুধু একটা নদী হিসেবে সংরক্ষণ না করে এটিকে একটা হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করার দাবি করে আসছি।  ২০ বছর ধরে আমরা কাজ করছি। ২০১৬ সালে এখানে ডিম সংগ্রহ প্রায় শূন্যের কোটায় পৌঁছে গিয়েছিল। ২০১৬ থেকে ২০২০ সালে হালদা নদী একটা ইউটার্ন নিয়েছে। এটা হালদা নদীর আগের অবস্থানে ফিরে আসার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এর পেছনে অনেক কারণ কাজ করেছে। প্রশাসনিক সাপোর্ট, সামাজিক আন্দোলন গবেষণা মিলিয়ে আজকের এই ভালো অবস্থাটা শুরু হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মত্স্য হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়েছে। নদী সংরক্ষণের জন্য স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে আমরা যারা নদী নিয়ে কাজ করি, তাদের মধ্যে একটা আশার সঞ্চার হয়েছে। সরকার নদী সংরক্ষণের জন্য এগিয়ে আসছে, এটি ইতিবাচক। এর মধ্যে আরেকটি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে যে এলজিডিইর অধীনে চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রায় ১৪ কোটি লিটার পানি তুলে মিরসরাই শিল্পনগরীতে সরবরাহের জন্য পরিকল্পনা করছে। এটা হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মত্স্য হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করে সংরক্ষণের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। ডিসেম্বর থেকে মার্চে ফটিকছড়িতে সরাসরি নদীতে একটা রাবার ড্যাম দেয়া হয়েছে। এছাড়া ১৮টি খালের মধ্যে স্লুইস গেট দিয়ে পানিশূন্য করে ফেলা হয়েছে। ধুরুং নামে একটা খালে বাঁধ দিয়ে পুরো পানিশূন্য করে ফেলা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হালদা প্যারালাল ক্যানেল প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতিদিন পানি উত্তোলন করা হচ্ছে হাটহাজারী এলাকার সাতটি ইউনিয়নের চাষের জন্য। এছাড়া প্রায় প্রতিদিন নয় কোটি লিটার পানি উত্তোলন করে চট্টগ্রাম শহরে সরবরাহ করা হচ্ছে। বিশেষ করে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি মার্চে বিপুল পরিমাণ পানি উত্তোলন করে ফেলা হয়, এর সঙ্গে মিরসরাইয়ে শিল্পনগরীর জন্য যে ১৮ কোটি লিটার পানি উত্তোলনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, তা আরো বিধ্বংসী পরিণাম বয়ে নিয়ে আসবে। এই যে শুষ্ক মৌসুমে এত বিপুল পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে, সেই পানিটা কোথা থেকে আসবে। পানি আসবে সম্পূর্ণ কর্ণফুলী নদী থেকে। অর্থাৎ কর্ণফুলী নদী থেকে যে পানিটা আসবে, সেটি ব্যাপকভাবে লবণাক্ত দূষিত পানি। এটি হালদা মত্স্য প্রজননকেন্দ্র এবং ডলফিনের আবাসস্থল ধ্বংস করে দেবে। সব মিলিয়ে শুষ্ক মৌসুমে পানি তুলে ফেলা হলে পরিস্থিতি কতটা বিপন্নকর হবে, তা সহজেই অনুমেয়।

এপ্রিল, মে, জুন তিন মাস হালদার মাছের প্রজননের সময়। এক্ষেত্রে দুটি বিষয় দরকার। এক. পানির গুণগত মান রক্ষা দুই. পানির পরিমাণ ঠিক রাখা। দুটো বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে মাছের খাদ্যের প্রাচুর্য নিশ্চিত হবে। এখন মাছের খাদ্য পর্যাপ্ত না থাকলে পোনার গঠন পর্যাপ্ত হবে না। যদি দূষিত পানি ঢোকে এবং পানির পরিমাণ কম হলে মাছের খাদ্যের প্রাচুর্য কমে যাবে। এমনকি মত্স্য প্রজনন খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে ব্যাহত হবে।

 

একেএম মাসুদ আলী

নির্বাহী পরিচালক

ইনসিডিন বাংলাদেশ

কোনো একটি নদীকে নিয়ে চিন্তা করলে সেটিকে সংরক্ষণে আমাদের অনেক বিকল্প ভাবনা থাকে। কিন্তু সব নদী বা সমগ্র পানিসম্পদের দিকে যখন তাকাই তখন কোনো নদীকে এককভাবে রক্ষা করার উদ্যোগ, তা হয়তো অনেক জলসম্পদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কারণ আমরা যে ধরনের পানি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি নিয়ে এগোচ্ছি, যে শিল্পায়ন নগর সৃষ্টির ভাবনা আমাদের সাথি, যে ধরনের কৃষির সঙ্গে আমরা অভ্যস্ত, তার সবকিছুর সঙ্গে বর্তমান পানিসম্পদের একটি সাংঘর্ষিক অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এই মূল জায়গায় যদি আমরা পরিবর্তন না এনে পানি ব্যবস্থাপনার চেষ্টা করি, তবে হয়তো আমাদের সাফল্য আসবে। কিন্তু সামগ্রিক যে লড়াই, তাতে আমরা সাফল্য পাব না। এটি আমার প্রারম্ভিক বক্তব্য। রাষ্ট্রীয়ভাবে পানিসম্পদ সুরক্ষার ক্ষেত্রে আমরা দুটো উপায় বারবার দেখি। একদিকে রাষ্ট্র সরকারি দায়দায়িত্ব নাগরিক অধিকারের কথা বলছে। একই সঙ্গে বাণিজ্যিক স্বার্থ বেসরকারি খাত তার অধিকার স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করছে। নীতিতে যা- থাক, বাস্তবে আমরা দেখছি যে বিশেষ করে চিংড়ি খাত লবণাক্ততা বৃদ্ধি করেই চলেছে, বড় ধরনের ঘেরের বদলে ছোট ঘের সৃষ্টি হয়েছে। একটা দীর্ঘ সময় কিন্তু আমাদের জলসম্পদের ওপর এর প্রভাব চলবে। বর্তমানে রফতানিমুখী উন্নয়ন আমাদের বড় হাতিয়ার। রফতানিমুখী উন্নয়নের সূত্র ধরে পোল্ডার এসেছে। আমরা সবাই এখন জানি, পোল্ডার আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা পানি অধিকারকে বিঘ্নিত করে চলেছে। কাজেই উন্নয়ন প্রচেষ্টার সঙ্গে যদি প্রাকৃতিক স্থানীয় জ্ঞানকে আমরা সম্পৃক্ত করতে ব্যর্থ হই তাহলে দীর্ঘমেয়াদে তা কখনই বেশিদূর এগোতে পারবে না। পানি অধিকারের ক্ষেত্রে আমরা কৃষি সুপেয় পানির কথা বলি। সুপেয় পানির অনেক মানদণ্ড রয়েছে, যা আমাদের এখানে খুব বেশি সংরক্ষিত হচ্ছে না। কৃষি প্রসঙ্গে আমাদের দুটো দিক নিয়ে আলোচনা করতে হয়। এক. কৃষিতে আমরা পানি অপচয়ের কথা শুনেছি। দুই. সেচের জলকে ঘিরে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিগত অবস্থান না থাকায় কৃষকের কাছে পানি এখনো দুর্লভ। কৃষির ক্ষেত্রে জল শুধু শস্যের জন্য প্রয়োজন তা নয়, কৃষিপণ্যকে বাজারে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে, ভোক্তার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে জলের ভূমিকা রয়েছে। আমরা জল বলতে নদী বুঝি। কিন্তু ভূগর্ভস্থ জল আমাদের বড় ধরনের হুমকিতে ফেলে দিতে পারে।

মানুষকে সচেতন করতে হবে এবং জলসম্পদের দস্যুতার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। পানি ব্যবস্থাপনা নগরায়নের যে ভাবনা নিয়ে সরকার এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে উন্নয়ন প্রচেষ্টার সঙ্গে প্রাকৃতিক স্থানীয় জ্ঞানকে সম্পৃক্ত করতে পারলে সেটি দীর্ঘমেয়াদি মানবিক হবে।

. ইনামুল হক

সাবেক মহাপরিচালক

পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা

আমাদের সুপেয় পানির উৎসগুলো ক্রমে নিঃশেষ হচ্ছে। হালদাকে অনেকে সাফল্যের গল্প বললেও ক্রমে এটি ব্যর্থতার গল্পে পরিণত হচ্ছে। কারণ ক্রমে আমরা ক্ষতির দিকে যাচ্ছি। বাংলাদেশ পরিবেশ আইন, ১৯৯৫- বলা হয়েছে, পানির অপব্যবহার কিংবা দূষণ ইত্যাদি কারণে যদি কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে যে পরিবেশ আদালত রয়েছেন, সেখানে মহাপরিচালক হতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির লিখিত অভিযোগ ছাড়া কোনো আদালত এই আইনের অধীন কোনো মামলা বিচারের জন্য গ্রহণ করিবেন না। নদীদূষণকারী, দখলকারী লাখ লাখ দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে একক একজন মহাপরিচালক কীভাবে ব্যবস্থা নেবেন। সর্বশেষ ২০১০ সালে যে সংশোধন আনা হয়েছে, সেখানে ১৭ নম্বর ধারাটাকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে যে কোনো বিধি লঙ্ঘনের ফলে ব্যক্তি গোষ্ঠী জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হলে উক্ত ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ অথবা তাহাদের পক্ষে মহাপরিচালক পরিবেশ আদালতে মামলা দায়ের করিতে পারিবেন। এখন হালদা নদী যদি দূষিত হয় তাহলে জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত জেলেরা কি সহজে মামলা করতে পারবেন? তাছাড়া তাদের পক্ষ হয়ে কে মামলা করবেন। মামলার অর্থ কোথা থেকে আসবে। আমি সংশোধনটাকে যথেষ্ট মনে করি না। আমি বলব, স্থানীয় যারা জনপ্রতিনিধি রয়েছেন, তারা কেন ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে মামলা করতে পারবেন না এবং স্থানীয় সরকারের যে বাজেট আছে, তা থেকে মামলা পরিচালনা করা যেতে পারে। আমাদের ইউনিয়ন ওয়ার্ড পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। তাদের যদি নদী পরিবেশ দূষণকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার দায়বদ্ধতার মধ্যে ফেলা হয়, তাহলে তা ফলপ্রসূ হতে পারে।


শামসুল হুদা

নির্বাহী পরিচালক

এএলআরডি

পানিসম্পদের সুরক্ষা আমাদের জীবনের অপরিহার্য বিষয়। এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা প্রধান। আমাদের নদীগুলো ভয়াবহ রকমের দূষণের শিকার। দূষণ একদিন বা এক বছরে হয়নি। অনেক বছর ধরে হচ্ছে। অনেকবারই সতর্কবার্তা প্রদান করা হয়েছে।  কভিড-১৯-কে অনেকেই বলছে সারা পৃথিবীর জন্য একটা ওয়েকআপ কল। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বিরূপ আচরণের ফলাফল কত ভয়াবহ হতে পারে, কভিড-১৯ সে সতর্কবার্তা নিয়ে এসেছে। বিজ্ঞানীরাই বলছেন, কভিডের মতো আরো অনেক ভয়াবহ মহামারী আসার অবস্থায় আছে। পরিবেশ, প্রতিবেশ, জীবনের ক্ষেত্রে পানি হচ্ছে অপরিহার্য একটি বিষয়। কিন্তু তা রক্ষার জন্য আমাদের সুনির্দিষ্ট করণীয় ঠিক করা প্রয়োজন। অনেক আইন আছে। আমাদের নদী রক্ষা আইন হয়েছে। নদী রক্ষা কমিশন রয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাহীন কমিশন হিসেবে এটিকে রেখে দেয়া হয়েছে। সে শুধু রিপোর্ট দিতে পারবে, সুপারিশ দিতে পারবে। আমরা স্বাধীন একটি কার্যকর কমিশন চেয়েছি যেন তারা ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে, রক্ষার ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে। অথচ সে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার ক্ষমতা কমিশনকে দেয়া হয়নি। আলোচকরা আইন সংশোধনের কথা বললেন, আগেও অনেকবার তা বলা হয়েছে। মামলা করতে গেলে আমাকে অনুমতি নিয়ে তা করতে হবে। আমার অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, আমি সাধারণ একজন নাগরিক হয়ে কেন আদালতে যেতে পারব না! আমাদের আইন অনেক আছে কিন্তু সেগুলো জনবান্ধব নয়, প্রকৃতিবান্ধব নয়, পরিবেশ-প্রতিবেশবান্ধব নয়, নদীবান্ধব নয়। এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। রাষ্ট্র যদি এখানে উদ্যোগী না হয় তাহলে একটা পর্যায়ে গিয়ে তা আর সম্ভব হবে না। রাষ্ট্রকে স্বচ্ছ ভূমিকায় আসতে হবে এবং সবার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয়, আঞ্চলিক জেলা পর্যায়ে নাগরিক সমাজের সহযোগিতা প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে আমরা যদি যৌথ মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারি তাহলে তা কার্যকরী হবে। প্রশাসন আমাদের সহযোগিতা চায়। আমারও সহযোগিতা করতে চাই।


শারমীন মুরশিদ

নির্বাহী পরিচালক, ব্রতী

সদস্য, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন

পানি উন্নয়ন বোর্ড ৪০৫টা নদী চিহ্নিত করে থাকলেও নদী রক্ষা কমিশন কিন্তু তথ্য স্যাটেলাইট ছবির মাধ্যমে ৭৭৬টি নদী চিহ্নিত করেছে। আমি মনে করব, এটিকেই আমাদের হালনাগাদ তথ্য হিসেবে বিবেচনা করা দরকার। ৭৭৬টি নদী চিহ্নিত করার পরও আমি বলব না যে আমরা সব নদী চিহ্নিত করতে পেরেছি। আইনের শক্তি, আইনের বাস্তবায়ন না হওয়া ইত্যাদি অন্তরায়ের সম্মুখীন আমরা হচ্ছি। কোথায় আমরা আটকে আছিপ্রতিটির একটি প্রতিফলন আমাদের আলোচনায় আসছে। নদী রক্ষা কমিশন একটি কার্যকরী প্রতিষ্ঠান হতে পারত, কিন্তু যেখানে কোনো মন্ত্রণালয় কার্যকরী নয়, যেখানে কোনো কাঠামো কাজ করে না, সেই কাঠামোর ভেতরে কোনো কিছুই কাজ করবে না। নদী রক্ষা কমিশনের ব্যাপারে আমি শুধু এটুকু বলতে চাই, কমিশন ততখানি শক্তিশালী হবে যতটুকু শক্তিশালী তার নেতৃত্ব। সেখানে নদী রক্ষা কমিশনের গতি অনেক মন্থর হয়ে গেছে। আমি সেখানে খুব বেশি হলে মাস দুয়েক আছি। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে আমার কাজটি করি। বর্তমানে মুহূর্তে আপনারা লক্ষ করে থাকবেন, নদী রক্ষা কমিশনের কাজের গতি খুবই মন্থর হয়ে গেছে। সেখানে যারা এখন হাল ধরেছেন, তারা অঙ্গনের মানুষই নন। অর্থাৎ তাদের বিষয়ে জানতে-বুঝতে, অনুধাবন করতে এগিয়ে যেতে তিনটা বছর কেটে যাবে। আমি ছয় বছর এখানে আছি। আমরা যতটুকু শিখেছি, তাদের আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। আমাদের চাওয়া-পাওয়ায় ঘাটতি থেকে যাবে। দুর্ভাগ্যবশত এটাই আমাদের বাস্তবতা।

তুরাগ নদকে আমরা দখলমুক্ত করেছিলাম, কিন্তু আজ নদটি ঠিক আগের জায়গায় চলে এসেছে। বুড়িগঙ্গার একই অবস্থা, সেখানে মারাত্মক দূষণ হচ্ছে। নদী রক্ষা কমিশন যদিও অনেক দখলদারকে সরাতে পেরেছে, মুহূর্তে দখলদারমুক্ত করার কাজের গতিও স্থবির হয়ে গেছে। কভিডের কারণে একটা অচলাবস্থা চলছে। দখলদারদের মুহূর্তে কেউ ঠেকাতে পারছে না। আমাদের নদী রক্ষা কমিশনের গবেষণালব্ধ তথ্যই বলছে, ৯০ শতাংশ দূষণকারী দখলদারই হচ্ছে প্রশাসনের মদদপুষ্ট কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতাধর দলের সদস্য। এমনটা যদি হয় তাহলে এদের বিচারের আওতায় আনবেন কোন শক্তিতে। আমরা যদি সে ধরনের উন্নত দেশ হতাম, যারা আইনকে শ্রদ্ধা করি বিচার বিভাগের ওপর আস্থা রাখতে পারি, তাহলে রাষ্ট্রকেও আমরা জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারতাম।

 

. আইনুন নিশাত

ইমেরিটাস অধ্যাপক

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

ভূগর্ভস্থ, ভূ-উপরস্থ, পরিমাণ গুণগত মান, খাওয়ার পানি-শিল্পের পানি, খাওয়ার পানির নলকূপ-শিল্পের নলকূপের পানি আলোচনায় ধরনের বিভিন্ন সাংঘর্ষিক বিষয় রয়েছে। ডেল্টা প্ল্যান নিয়ে সবাই ধন্য ধন্য করছে, কিন্তু আমার আপত্তি আছে। আমার প্রস্তাব হচ্ছে, আসুন আজ থেকে ডেল্টা প্ল্যানের বাইরে নতুন করে কাজ শুরু করি। আমাদের এমন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে, যা টেকসই হয়। সমাধান টেকসই করতে গেলে প্রথম প্রয়োজন নীতিনির্ধারণ। ১৯৯৯- যে পলিসি তৈরি হয়েছিল, তার সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম। চমত্কার পলিসি। কিন্তু সে সময় আমরা অনেক কিছু বুঝতাম না। একটা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। ২০০২ সালে জাতীয় পানি পরিকল্পনায় কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, আমরা পরিবেশের বিষয়টিও বুঝতাম না। আমাদের এখন স্থায়িত্বের বিষয়টা বুঝতে হবে। এখানে দুটো বিষয় রয়েছে। এক. তত্ত্বাবধান মূল্যায়ন। দুই. পরিচালন রক্ষণাবেক্ষণ। এগুলো কে করবে, সে দায়িত্বটা ঠিক করতে হবে। আমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী ছিলাম। একসময় তাদের লোকবল ছিল ২২ থেকে ২৪ হাজার। কিন্তু কোনো বিবেচনা যাচাই-বাছাই ছাড়াই হঠাৎ করে লোকসংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। এমন সিদ্ধান্তে কার্যক্রম পরিচালনা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নির্ধারিত লোকগুলোর চাকরি রাতারাতি নাই হয়ে গেল। একটা প্রকল্প তৈরির পর তা রক্ষণাবেক্ষণ তদারকির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে হবে। পানি অনেক ভাগে বিভক্ত। নৌ-চলাচল, খাওয়ার, কৃষি, শিল্প প্রকৃতির জন্য পানি লাগে। এগুলোর মধ্যে সমন্বয় কে করবে। নদী নিয়ে এখানে ছোটখাটো একটা আলোচনা হয়ে গেল। আমাকে নদীর সংজ্ঞাটি কি কেউ বলতে পারবেন? নদী রক্ষা কমিশন যে সংজ্ঞা ব্যবহার করেছে, এটা ভুল। প্রাকৃতিকভাবে সিলেটের পাবর্ত্য চট্টগ্রামের ছড়া যেমন একটা নদী, তেমনি চট্টগ্রামের খালগুলোও নদী। খাল বলে এটার গুরুত্ব কমিয়ে দেয়া হয়। কত ছোট হলে নদী না বলে ছড়া বা খাল বলবেন, এটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। সুন্দরবনে কয়টি নদী আছে, জার্মানি থেকে বিশেষজ্ঞ এসে প্রায় ৩৫৩টি নদী চিহ্নিত করে গেছেন। আমরা তো তিন-চারটি বড় নদী ছাড়া অন্যগুলোকে নদী বলে মানতে রাজি না। যেটা প্রাকৃতিকভাবে স্রোতস্বিনী এবং সারা বছর কিংবা বছরের কিছু সময় পানি প্রবাহিত হয়, সেটাই নদী। আমরা নদী বুঝি না, আমাদের এখানে অতি ছোট নদী আছে, মাঝারি নদী আছে, বড় নদী আছে। নদীকে আলাদাভাবে বুঝতে হবে। ভারতের সঙ্গে আলোচনার প্রসঙ্গে বলব, এটা কি অববাহিকাভিত্তিক আলোচনা হয়েছে? তাহলে অববাহিকাভিত্তিক আলোচনার জন্য পটভূমি তৈরি কে করেছে? আমার জানামতে কেউ করেনি। তাহলে ভারতের সঙ্গে আমরা কোনো প্রস্তুতি ছাড়া আলোচনা করতে যাব? এটা কি হয়? কিছুদিনের মধ্যে শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় পানি নিয়ে সংকট তৈরি হবে। তখন কী করব? গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে নতুন কারখানার জন্য ডিপ টিউবওয়েল বসিয়ে পানি তোলা হচ্ছে। ঢাকায় একদিকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে, অন্যদিকে আমরা আরো ডিপ টিউবওয়েল বসাচ্ছি। রাষ্ট্রের  প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে খাদ্যনিরাপত্তা। কাজেই খাদ্যনিরাপত্তা, জীবিকার নিশ্চয়তা, জলবায়ু পরিবর্তন জীববৈচিত্র্যের মতো বিষয়গুলো সমন্বয়পূর্বক একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। সেটির ভিত্তিতে একটি কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। পরিমাণের সঙ্গে গুণের বিষয়টিও দেখতে হবে। প্রতিটি নদী অববাহিকার জন্য আলাদা কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে সে কৌশলের সঙ্গে মিল রেখে। এসব ক্ষেত্রে একটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আরেকটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের বেশ অভাব রয়েছে। সেটি দূর করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা বাড়াতে হবে।

শ্রুতলিখন: হুমায়ুন কবির রুহিনা ফেরদৌস

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন