পর্যালোচনা

শতবর্ষ আগের ভাতের অর্থনীতি

ড. এমএ মোমেন

বাংলার রায়ত কেমন করে বেঁচে থাকবে সে প্রশ্ন করেছেন অনেকেই। বাংলার বাবু তেল-ঘি খেয়ে বাইজি নাচিয়ে শরাব গোমাংস খেয়ে আয়েশেই জীবন কাটাচ্ছেন।রায়তপত্রিকার ১৩২৬ বঙ্গাব্দের একটি সংবাদ:

চাউলের দর কী ছিল কী হইয়াছে দেখুন। প্রতি মণ ১৮৭০ সালে দেড় টাকা হইতে টাকা, ১৮৮০ সালে টাকা হইতে টাকা; ১৮৯০ সালে আড়াই টাকা হইতে টাকা; ১৯০০ সালে টাকা হইতে টাকা; ১৯১০ সালে সাড়ে টাকা হইতে টাকা; ১৯১৯ বা বর্ত্তমানে সাড়ে টাকা হইতে ১২ টাকা কোথাওবা ১৪-১৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রয় হইতেছে।

নীহারপত্রিকা সময় লিখেছে: ‘অন্নাভাবে দেশের সর্বত্রই দারুণ কষ্ট উপস্থিত হইয়াছে। নিরুপায় ব্যক্তিরা অনশনে অর্দ্ধাশনে থাকিয়া অখাদ্য-কুখাদ্য খাইয়া অতিকষ্টে জীবন বাঁচাইতেছে।

শ্রীদুর্গাকান্ত চক্রবর্তীস্বরাজপত্রিকায় লিখেছেন, সিরাজগঞ্জের চর মোছাগপুরের প্রয়াত ধনী ব্যক্তি নিঃসন্তান মনীন্দ্রচন্দ্র চৌধুরীর বিধবা পত্নী শরত্সুন্দরী চৌধুরানী অত্যন্ত দয়াপরবশ হয়ে বালক-বৃদ্ধ-যুবক, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিদিন প্রত্যেককে আধসের চাল দান করছেন। এটি তার নতুন ধরনের কার্তিক ব্রত। এই চাল গ্রহণের জন্য কার্তিকের প্রথম দিন মাত্র ২০ জন হাজির হইলেও উপস্থিতি বাড়তে থাকে। কার্তিকের ১০ তারিখে এই দয়ালু নারী অন্তত ১৪০০ দুস্থ ব্যক্তিকে এই চাল দান করেছেন। তারপর প্রতিদিন গড়ে দুহাজার ক্ষুধা ভিক্ষুক তার দানে মুখে দানা তুলতে সক্ষম হচ্ছেন।

দেশের বিত্তবানরা সকলেই যদি শরত্সুন্দরী চৌধুরানীর পদাঙ্ক অনুসরণ করতেন, তাহলে নিরন্ন মানুষের এই দুর্যোগের অমানিশা কাটানো সহজ হতো।

কিন্তু উৎপাদনকারী কৃষকের চাল কেমন করে তাদের হাতছাড়া হচ্ছে, তার একটি বিবরণ দিয়েছে রঙপুর দর্পণ পত্রিকা।

সম্প্রতি মাড়োয়ারীগণ গ্রামে গ্রামে গমন করিয়া কোথাওবা নিজেরা, কোথাওবা নিজেরা গুপ্ত থাকিয়া নির্ব্বোধ বাঙ্গালী কর্মচারীদের দ্বারা মাঠ হইতে গাছ সমেত ধান্য মাড়াই ঝাড়াই করিয়া লইবার শর্তে কৃষকগণকে টাকা দাদন দিতে আরম্ভ করিয়াছে। এইরূপ তাহারা পরোক্ষভাবে নিরীহ কৃষক দলের ভবিষ্যতের পেটের অন্ন কাড়িয়া লইবার চেষ্টায় আছে।

খরার কারণে এমনিতেই বহু স্থানে ধানের উৎপাদন কম হবে তার পরও যে যৎসামান্য শস্য কৃষকের ঘরে আসার সম্ভাবনা ছিল, তা যদিনির্দ্দয় ব্যবসাদারদের হাতে পড়িয়া দেশ-দেশান্তরে চলিয়া যায়, তাহা হইলে আমাদের দেশের অন্নাভাব কিরূপে দূর হইবে?’

একই সময় মোহাম্মদী লিখেছে, এমনিতে দুর্মূল্যের কারণে জীবন বাঁচানো দায়, এর মধ্যে শুরু হলো ইনফ্লুয়েঞ্জা, কলেরা বসন্ত। আরো ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছেঝঞ্ঝা নির্ম্মম নিষ্ঠুর অভিশাপ রূপে আসিয়া তাহাদের মাথা গুজিবার স্থান যে জরাজীর্ণ কুটির গুলি তাহাও উড়াইয়া লইয়া গিয়াসোনার বাংলায় শ্মশানদৃশ্যরচনা করিয়া দিয়া গেল।

এখন উপায় কী?

অনুভূতি যাহাদের আছে তাহাদের অর্থ নাই; অর্থ যাহাদের আছে তাহাদের অনুভূতি নাই। দেশ যাহারা শাসন করেন তাহাদের দৃকপাত নাই। রোগশাসিত লোকালয়গুলির উপরে ডাবল শাসন চড়াইবার জন্য তাঁরা লক্ষ কোটি টাকা পুলিশ বিভাগে ব্যয় করিবেন, কিন্তু তাঁহাদের শাসিত লোকগুলি যে পূর্ব্বে রোগের শাসনে চিরবিদায় লইতেছে, সেদিকে তাহারা দেখিবেন না।

এই দুঃসময়ে কিঞ্চিৎ ভালো খবরও আছে। রঙপুর দর্পণ সরকারের সম্বিত ফেরার খবর দিয়েছে। একটি বিবৃতিতে বাঙ্গালা দেশের গবর্নমেন্ট দেশবাসীকে জানিয়েছে, ‘আগামী/শান্তি উৎসব উপলক্ষে গবর্নমেন্টের বাড়িসকল আলোকমালায় সজ্জিত না করিয়া উক্ত অর্থে শহর মফস্বলের দরিদ্র ব্যক্তিগণকে কাপড় বিতরণ করা হইবে।

উদ্যোগটি শুভ সন্দেহ নেই, ক্ষুধার্ত মানুষের পোশাকের আগে খাদ্যেরই যে প্রয়োজন সরকারের অধিকর্তারা তা তখনো বুঝে উঠতে পারেননি।

জ্যোতি নামের সাময়িকী বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের আলোচনা উদ্ধৃত করে জানায়, আহারবঞ্চিত ঝঞ্ঝাবিধ্বস্ত পূর্ববঙ্গের হতভাগা মানুষকে রক্ষা করার জন্য শ্রীযুত সুরেন্দ্রনাথ রায় ভারত সরকারের কাছে ৫০ লাখ টাকার অনুগ্রহ ভিক্ষা চাইলে সরকার বিবেচনার জন্য প্রস্তাবটি গ্রহণ করে। তবে কাউন্সিল সদস্য মিস্টার কামিং প্রতিনিধিদের স্মরণ করিয়ে দেন—‘রাজকীয় সাহায্যদানকে অনুগ্রহের দান মনে করা প্রস্তাবক মিস্টার রায়ের ভ্রম, সরকার হইতে যে সাহায্য দেওয়া হয় তাহা অনুগ্রহ নহে, দুস্থ লোকদিগকে সাহায্যদান করা সরকারের কর্তব্য।

আরো কয়েকটি বিষয়ে সরকারের হুঁশ ফিরেছে মনে করা সমীচীন হবে।বীরভুমবাসীসাময়িকী বাংলা সরকারের জারি করা একটি আদেশের কথা সকলকে জানিয়েছে।

. বাঙ্গালা দেশের লোকের হিতার্থে এই নিয়ম হইল যে নির্দিষ্ট পরিমাণের অধিক চাউল রেলপথে ভারতের অন্য প্রদেশে পাঠানো হইবে না।  . ভারতের বাহিরে অপর কোনো দেশে বাঙ্গালার চাউল রফতানি হইবে না। তবে যেসব দেশের লোকে ভারতের চাউলের উপর নির্ভর করিত তাহাদের জন্য বঙ্গদেশ হইতে চাউল যাইবে।

দ্বিতীয় আদেশটি সুস্পষ্ট নয়, এতে রফতানির দায় বাংলার উপরই চলে আসে, তবে এটাও যোগ করা হয়যথাসম্ভব কম পরিমাণে চাউল রপ্তানি হইতে দেওয়া হইবে।

নবসঙ্গনামের পত্রিকা জানাচ্ছে খুলনা জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এক ধরনের দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে।প্রায় সকলেই কপর্দকশূন্য, এমনকি পুরাতন অবস্থাপন্ন গৃহস্থ ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিতে বাধ্য হইয়াছেন। স্ত্রীলোকের বস্ত্রাভাবে গৃহের বাহির হইবার উপায় নাই। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক যাহারা তাহারা অনাহারে দিন কাটাইতেছে। বালক-বালিকাগণকে অপক্ব খেজুর গাছের মেতি অন্যান্য ফলমূল খাওয়াইয়া কোনোরকমে বাঁচাইয়া রাখিতেছে।

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় স্বয়ং অনাহারক্লিষ্ট মানুষদের দেখে এসেছেন এবং তাদের সহযোগিতার জন্য ভলান্টিয়ার নিয়োগ করেছেন। তাদের হাতে সাহায্য পৌঁছাইলেই তা দুর্গত মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে। খুলনাতেচারি আনা আট আনা’- জন্য সন্তান বিক্রয়ের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রবাসী উল্লেখ করেছে।

চাল নিয়ে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের সাথে সরকার যে তামাসা করছে তার বিবরণ প্রবাসীকে জানিয়েছে একজন সচেতন নাগরিক:

শাসন পরিষদের সভ্য বর্দ্ধমানের দুর্ভিক্ষপীড়িত স্থানে ঘুরিয়া দুর্ভিক্ষের কোনো চিহ্ন পান নাই। বোধ হয় এই কারণে গবর্নমেন্ট চাল রফতানি করিবার লাইসেন্স এই বৎসরের জন্য নূতন করিয়া দিবেন বলিয়াছেন বা দিয়াছেন। চাল ব্যাপারী সভ্যদিকের চেষ্টায় এবং মগরাজা তাহাদিগের সুবিধার জন্য যে চাল বিদেশে রফতানির লাইসেন্স দেওয়া হইয়াছে বা হইবে বলিয়া কথা উঠিয়াছে, এইরূপ ভাবিবার যথেষ্ট কারণ রহিয়াছে।

যেদিন রফতানি লাইসেন্সের ঘোষণা হলো, সেদিন থেকে আটদিনের মধ্যে আতপ চালের বস্তার দর আট থেকে দশ টাকা বেড়ে যায়। দর বেড়ে যাওয়ায় ধনী মহাজন লাভবান হবে কিন্তু যে ক্ষেতমজুরকে দিনের চাল দিন কিনতে হয় তার কথা কে ভাববে। মহাজন রফতানিকারকদের যুক্তি ভিন্নদরিদ্র ভোক্তা তো আর আতপ চাল খায় না, আতপ চালের দাম বৃদ্ধিতে তাদের মাথাব্যথা কেন? অর্থনীতির সাধারণ হিসাবেই বর্ধিত অর্থ সরবরাহের প্রভাব বাজারে পড়বেই। তাছাড়া যখন আতপের রফতানি বাজার বেড়ে যাবে, অধিক লাভের আশায় সিদ্ধ চালের উৎপাদনকারী আতপের দিকে ঝুঁকবে, বাজারে সিদ্ধ চালের সংকট দেখা দেবে।

ব্যক্তিগত লাভ বৃদ্ধি যেখানে মৌল প্রেরণা, সেখানে দেশের মানুষ অনাহারে মরল কিনা তা মহাজনের বিবেচ্য নয়। রাষ্ট্র যদি নাগরিকদের খাদ্য নিরাপত্তার কথা না ভাবে, তাহলে তাকে দেখার আর কেউই থাকল না।

প্রবাসী আফসোস করেছে যে মহাজনদের কেউ কেউ ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য। তবে রফতানি বাণিজ্যটি ইংরেজের হাতে। দেশী মহাজন সাধারণ মানুষের গ্রাস ছিনিয়ে নিয়ে ইংরেজের হাতে তুলে দিচ্ছেন।

বাংলা থেকে যখন চাল রফতানি হচ্ছে তখন খুলনায় কী ঘটছে?

. শ্রীউল্লা গ্রামের গোলাম রহমান সর্দার কালারহাট থেকে দেড় টাকা মূল্যে একটি ছেলে ক্রয় করেছেন। . শ্রীউল্লা গ্রামের আবদুল আলেক সর্দার টাকা দিয়ে একজন স্ত্রী লোক তার কন্যাকে কিনে নিয়েছেন। . গিলাতলা গ্রামের মকরেজ বেপারী টাকা প্রদান করে একটি ছেলে কিনে এনেছেন। . বাঁদুল গ্রামের আবদুল গাজী টাকায় একটি ছেলে কিনেছেন। . আমাদী বিটহাউসের জমাদার বাবু রামতারণ চক্রবর্তী আনা মূল্যে একটি ছেলে কিনেছেন। . আমাদী বিটহাউসের বকসী বাবু আনায় একটি ছেলে ক্রয় করেছেন।

সন্তান আত্মবিক্রয়ের কারণ মূলত খাদ্যের অভাব। খুলনায় অবস্থা দেখেও বর্তমানের মহারাজাফ্যামিন কোড’-এর দোহাই দিয়ে বললেন, অন্নবস্ত্রের কিছু অভাব ঘটেছে বটে, কিন্তু দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়নি।

যখন মানুষের পেটে ভাত নেই সে সময় খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের দোহাই দেওয়া হচ্ছে:

. আতপ অন্ন খাও। . ভাতের মাড় ফেলো না। . মসৃণ চাল খেয়ো না।

আর তখন বরিশালের গৌরনদী থানার বরিয়ালি গ্রামের ১০-১১ বছর বয়স্ক বালক গুরুদাস তিনদিন উপবাস থেকে ওই গ্রামের তারকেশ্বরী দেবীর বাড়িতে গিয়ে ভাত চাইলে সে প্রত্যাখ্যাত হয়। পরে সে সিঁধ কেটে তার ঘরে প্রবেশ করে ভাত খায় এবং ধরাও পড়ে। তাকে পুলিশে সমর্পণ করা হয়। সেদিন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বাবু রাধিকালান তাকে আদালত চলাকালীন সময় পর্যন্ত আটকাদেশ দেন।

লঘু শাস্তির প্রশংসা হলো বটে কিন্তু বালকটির খাবারের কী ব্যবস্থা হয়েছে? প্রশ্ন রেখেছে বরিশাল হিতৈষী পত্রিকা।

এই বালক একা। কিন্তু তার মতো ৫০ জন ক্ষুধার্ত একত্র হয়ে মোদিনীপুরের কশা নদীতে ধানের নৌকা লুট করে ১২০ টাকায় ধান নিয়ে পালায়, ঝালকাঠিতে ২০-২৫ জন সংঘবদ্ধ হয়ে চালের নৌকা লুট করে।

অথচ বিবেচ্য বছর (১৩২৬ বঙ্গাব্দ) ২২ কোটি ৬০ লাখ মণ চাউল উত্পন্ন হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে কোটি ৭০ লাখ মণ বেশি। কাজেই চালের অভাব যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী দুর্বৃত্ত মহাজন, তাদের প্রভাবে থাকা সরকার এবং সেই সরকারের ভ্রান্তিপূর্ণ অর্থনীতিজ্ঞান এবং ব্যবস্থাপনা।

 

. এমএ মোমেন: সাবেক সরকারি কর্মকর্তা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন