চার দশক পর আবারো তিক্ততায় ওয়াশিংটন-রিয়াদ

বণিক বার্তা ডেস্ক

১৯৭৩ সালের অক্টোবর। গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলের অধিকৃত এলাকায় একযোগে আক্রমণ চালায় আরব দেশগুলো। যুদ্ধে বিজয় নিয়ে আরব দেশগুলোর মধ্যে কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ পশ্চিমা দেশগুলো তাদের বিজয়ের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাপক সামরিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে ইসরায়েলের পাশে এসে দাঁড়ায় পশ্চিমা বিশ্ব। এর ধারাবাহিকতায় আরব দেশগুলোর বিজয়ের নিশ্চয়তা রূপ নেয় পরাজয়ের দুঃস্বপ্নে।

বিষয়টি ক্ষিপ্ত করে তোলে আরব দেশগুলোকে। প্রতিশোধ নিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোয় জ্বালানি তেল রফতানিতে অবরোধ আরোপ করে দেশগুলো। এতে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো বিপাকে পড়ে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানি তেলের মারাত্মক সংকট দেখা দেয়। বিশ্বব্যাপী অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের গড় মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় চার গুণে।

পদক্ষেপে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানি তেলের রেশনিংয়ে বাধ্য হয় দেশটি। জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানির ওপর নির্ভরশীল ছিল দেশটি। কারণে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আকস্মিকভাবে পণ্যটির সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বেশ বিপাকে পড়ে। মার্কিন সড়কগুলোয় গাড়ি চলাচল রীতিমতো বন্ধ হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে দেশটির আর্থসামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশ।

আরব দেশগুলোর রফতানি বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা ছিল সৌদি তেলমন্ত্রী শেখ আহমাদ জাকি ইয়ামানির। তার ভূমিকায় যুক্তরাষ্ট্র সংকটে পড়ে যাওয়ার পাশাপাশি গোটা জ্বালানি নীতিতেই পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়। দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের কূটনৈতিক উত্তেজনাও তৈরি হয়।

ওই উত্তেজনা প্রশমনের পর থেকেই সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্কের উত্তরোত্তর উন্নতি হয়েছে। এর পরের সময়টুকুতে দুই দেশের মধ্যে মনকষাকষির আর কোনো নজিরই পাওয়া যায় না। বিশেষ করে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক রীতিমতো মাখামাখির পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়। এর পুনরাবৃত্তি ঘটে মার্কিন নেতৃত্বে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ইরাক আগ্রাসনের সময়েও। ইরান ইস্যুতেও সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্র এতদিন এক পথেই হেঁটেছে।

সম্পর্ক চূড়ায় পৌঁছায় কিছুদিন আগে হোয়াইট হাউজের কর্তৃত্ব হারানো ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়। পররাষ্ট্রনীতির জায়গা থেকে সৌদি আরবকে রীতিমতো ব্ল্যাংক চেক দিয়ে রাখে দেশটি। অন্যদিকে বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আবু ইভাঙ্কা খেতাব দেয় সৌদি রাজপরিবার গণমাধ্যম।

তবে ট্রাম্প নির্বাচনে হেরে ক্ষমতা হারানোর পর থেকেই রিয়াদ-ওয়াশিংটন সম্পর্ক দিন দিন তিক্ত থেকে তিক্ততর হয়ে উঠছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন শপথ গ্রহণের পর থেকেই ওয়াশিংটনের কাছ থেকে শুধু অপ্রত্যাশিত আচরণই পেয়ে চলেছে রিয়াদ। এদিক থেকে সৌদি রাজপরিবার প্রথম ধাক্কা খায় জো বাইডেন তার পররাষ্ট্রনীতি-সংক্রান্ত প্রথম ভাষণ দেয়ার সময়। ওই ভাষণে জো বাইডেন পরিষ্কার করে দেন, ইয়েমেনে সৌদি আরবের যুদ্ধে আর সমর্থন দেবে না ওয়াশিংটন। বরং মানবাধিকারের মতো ইস্যুগুলো ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে বলে ভাষণে দাবি করেন বাইডেন।

বিষয়টিতে রিয়াদের মর্মাহত হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো সৌদি সেনাদের বিরুদ্ধে ইয়েমেনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ সব অভিযোগ রয়েছে। তবে সৌদির এর চেয়েও বড় ধাক্কাটি অপেক্ষা করছিল খাসোগি ইস্যুতে।

সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে ২০১৮ সালের অক্টোবরে। তুরস্কের সৌদি কনস্যুলেটে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ওই সময়ে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী নির্দেশদাতা হিসেবে সন্দেহ করা হয় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে।

ওই ঘটনার ছয় মাস পর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর এক প্রতিবেদনেও বলা হয়, যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশেই খাসোগি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। নিয়ে মার্কিন কংগ্রেস পদক্ষেপ নেয়ারও উদ্যোগ নেয়।

তবে রাজপরিবারের বন্ধু হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প মোহাম্মদ বিন সালমানের পক্ষ নেন। ওই সময় বিষয়ে মিথ্যাচারের অপবাদ মাথায় নিয়েই মার্কিন কংগ্রেসের পদক্ষেপ আটকে দেন তিনি। গত বছরের ডিসেম্বরে মার্কিন কংগ্রেস নিয়ে আবার একটি বিল পাস করে। এতে মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালকের (ওডিএনআই) দপ্তরকে নির্দেশনা দেয়া হয়, পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে খাসোগি হত্যাকাণ্ড ইস্যুতে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। তবে ক্ষমতা ছাড়ার আগ পর্যন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

এদিকে বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের চাপে রয়েছে সৌদি আরব। মুহূর্তে সৌদি রাজপরিবারের ওপর ইস্যুতে কঠোর হয়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্র। এরই মধ্যে বিষয়ে সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আব্দুলআজিজের সঙ্গে ফোনালাপ হয়েছে জো বাইডেনের।  ফোনালাপেও বাইডেন বারবার মানবাধিকার ইস্যুটি সামনে নিয়ে এসেছেন বলে হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে। হোয়াইট হাউজের -সংক্রান্ত বিবৃতিতে খাসোগি ইস্যুটির কথা সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। তবে এতে বলা হয়েছে, আলোচনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রধানত মানবাধিকার আইনের শাসনের ওপরই জোর দিয়েছেন বেশি।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, ওডিএনআইর খাসোগি হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন পড়ার পর পরই সৌদি বাদশাহকে ফোন করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। প্রতিবেদনটি এরই মধ্যে প্রকাশ হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানই জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় অনুমোদন দিয়েছেন। পরিকল্পনার বিষয়বস্তু ছিল, খাসোগিকে হয় আটক, নয় হত্যা করতে হবে।

প্রতিবেদনের আলোকে শুক্রবার ৭৬ সৌদি নাগরিকের ওপর খাসোগি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মার্কিন প্রশাসন। সৌদি আরব এরই মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসা ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। বিষয় রিয়াদের ভাষ্য হলো, প্রতিবেদনটি ভুল, নেতিবাচক অগ্রহণযোগ্য

মোহাম্মদ বিন সালমান শুরু থেকেই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছেন। পিতা সালমান বিন আব্দুলআজিজ বাদশাহ হলেও যুবরাজকেই সৌদি আরবের প্রকৃত শাসক বলে মনে করা হয়ে থাকে। ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত কলামে মোহাম্মদ বিন সালমানের কঠোর সমালোচনা করে সৌদি রাজপরিবারের কোপানলে পড়েছিলেন খাসোগি।

৭৬ জনের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তের সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন একে উল্লেখ করেছেন খাসোগি ব্যান হিসেবে। সময় তিনি উল্লেখ করেন, বিদেশী কোনো সরকারের হয়ে ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে পা রাখতে দেয়াই উচিত নয়। যদিও মোহাম্মদ বিন সালমানকে তালিকায় রাখা হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের রিয়াদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ ভিসা নিষেধাজ্ঞাতেই সীমাবদ্ধ নেই। মার্কিন ট্রেজারি বিভাগও এরই মধ্যে মোহাম্মদ বিন সালমানের আশপাশের কয়েকজনের বিরুদ্ধে বেশকিছু নিষেধাজ্ঞামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন, যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের মধ্যে অতীতের সেই মধুর সম্পর্ক এখন আর নেই। বরং সম্পর্কে তিক্ততা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।  পরিস্থিতি সহসা বদলে যাওয়ারও সম্ভাবনা কম। ফলে সৌদি আরবও এখন কূটনৈতিক সম্পর্কের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী দেশ চীনের প্রতি ঝুঁকছে। বাইডেন প্রশাসনের ক্ষমতা গ্রহণ বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন যে মেরুকরণের সৃষ্টি করেছে, তারই অন্যতম নিদর্শন যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি আরব সম্পর্ক।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন