বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি : আইনি সফলতার নব উন্মোচিত দ্বার

তামান্না-ই-নূর

ভূমিকা
আইন ও বিচার বিভাগ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকল্পে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বিধিমালা প্রণয়ন করে এবং দেশের প্রচলিত আইনগুলোর মধ্যে একে সংযুক্ত করে আইনব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, যা ন্যায়বিচার প্রাপ্তিকে আরো বেগবান ও ত্বরান্বিত করেছে।

বিরোধ নিষ্পত্তির ধারণা
`Peace can't be kept by force, it can only achieved by understanding’-(Albert Einstein).  আইনস্টাইনের এই উক্তির সঙ্গে একমত হয়ে আমরা বলতে পারি, পারস্পরিক সমঝোতায় একটি জটিল সমস্যাও সহজে সমাধান করা যায়। মূলত, আইনসিদ্ধ পদ্ধতি মেনে ও সহমত পোষণ করে আদালত বা সাধারণ আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে বিকল্পভাবে পক্ষগণের বিরোধ বা সমস্যার নিষ্পত্তিকরণই বিকল্পবিরোধ নিষ্পত্তি, যাকে ইংরেজিতে Alternative Dispute Resolution (ADR) বলা হয়। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিকে ‘রেস্টোরেটিভ জাস্টিস’-এর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যেখানে পক্ষগণকে পরস্পরের সম্মুখে বসিয়ে ঘটনার আর্থসামাজিক ও মানসিক কারণ খোঁজা হয়। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত কী প্রতিকার চায়, তার ওপর গুরুত্বারোপ করা এবং ভবিষ্যতে যেন অপরাধ সংঘটিত না হয়, সেদিকে নজর রাখা। সার্বিক দিক বিবেচনায়, একটি বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তিকল্পে উক্ত পদ্ধতি দিন দিন জনগণের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

বিভিন্ন ধরনের বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান

বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মূল লক্ষ্য মামলায় জটিলতা এবং দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করা। আমাদের দেশে তিন ধরনের বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে- 

(১) আলাপ-আলোচনা বা নেগোসিয়েশন : উক্ত পদ্ধতিতে পক্ষগণ কারো সাহায্য ছাড়াই নিজেরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় উপনীত হয়।

(২) মধ্যস্থতা বা মিডিয়েশন : এ পদ্ধতিতে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি মধ্যস্থতাকারী নিযুক্ত হন এবং কোনো ধরনের জোরারোপ বা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া ব্যতীত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দুই পক্ষকে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করেন।

(৩) সালিশ বা আরবিট্রেশন : এ প্রক্রিয়াটির ধরন মধ্যস্থতার মতো হলেও কিছুটা নিয়মনিষ্ঠাভাবে সম্পাদিত হয়, যেখানে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আদালত বা কোনো আরবিট্রেশন বডি থাকে, যেখানে পক্ষগণকে সমঝোতায় এনে সমাধান প্রণয়ন করা হয়।

বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির সূচনা এবং এর অগ্রযাত্রা
আমাদের প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় দীর্ঘকাল ধরে মধ্যস্থতার বিধান রয়েছে। সালিশ, গ্রাম আদালত এবং মুসলিম পারিবারিক আইনে পূর্বেই এ বিধানের প্রচলন ছিল। ১৯৪০ সালে আরবিট্রেশন অ্যাক্ট, ১৯৬৯ সালে শিল্প সম্পর্ক অধ্যাদেশ, মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ এবং ১৯৮৫ সালে পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রথম এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫তে মামলার বিচারের শুনানিপূর্ব (প্রি-কেস) পর্যায়ে আদালতের উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর আপস বা সমঝোতার মাধ্যমে পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি করার এমনকি বিচার শেষ হবার পরও রায় প্রদানের পূর্বে (পোস্ট-কেস) উক্ত প্রক্রিয়ায় মীমাংসাকরণের বিধান নিশ্চিত করা হয়েছে। এ অধ্যাদেশের ১০ ও ১৩ নম্বর ধারায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির উল্লেখ আছে। এই নবজাগরণে উদ্বুদ্ধ হয়ে মধ্যস্থতা ও সালিশের মাধ্যমে দেওয়ানি মোকদ্দমা নিষ্পত্তির লক্ষ্যে দেওয়ানি কার্যবিধি (সংশোধনী) ২০০৩ বলে এই আইনে ৮৯(ক) ও ৮৯(খ) দুটি ধারা সংযোজিত হয়েছে, যার ফলে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এরই সূত্র ধরে পরবর্তী সময়ে অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩-এ ধারা ২১-২২-এর মাধ্যমে ফয়সালামূলক বিধান ও মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিকল্পবিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়াও শ্রমিক আইন, ২০০৬-এর ধারা-২১০ (১, ২, ৪, ৬, ১৬)-এ এই বিধান রাখা হয়েছে। অন্যদিকে ২০০০ সালের আইনগত সহায়তা আইনে ২০১৩ সালে ২১(ক) ধারা সংযোজন করে মধ্যস্থতার বিধান আনা হয়। সর্বোপরি ২০১৫ সালে আইনগত পরামর্শ বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বিধিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র নীতি প্রণীত হয়, যার মাধ্যমে এর গুরুত্ব ফুটে ওঠে।

বিচারক তথা মধ্যস্থতাকারী কর্তৃক বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে পক্ষগণকে সমঝোতায় আনা
আমরা জানি, ফৌজদারি মামলার বিরোধ নিষ্পত্তি কখনোই সম্ভব নয়। কারণ দ-বিধি স্বীকৃত অপরাধগুলো এভাবে সমাধান করা হলে তা সমাজে একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। তবুও ৩৪৫ ধারায় বর্ণিত সমঝোতায় প্রত্যাহারকৃত অপরাধসমূহ তথা কম্পাউন্ডিং অফেন্সকে কমপ্রোমাইজ অর্থাৎ আপস বা সমঝোতায় রাখা হয়েছে এবং যার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়, তার মুক্তির বিধান (শর্তসাপেক্ষে) দেয়া হয়েছে। অবশ্যই তা আবেদনকারীর মাধ্যমে প্রত্যাহার করতে হবে।

বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির সুবিধা
চার্লি চ্যাপলিনের ভাষায় ‘এ বিশ্বে স্থায়ী কিছুই নয়, এমনকি আমাদের সমস্যাগুলোও না।’ সমস্যা যতই গুরুতর হোক না কেন, তা সমাধানের উত্তম পন্থা হলো সমঝোতা অর্থাৎ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি যথোপযুক্ত সিদ্ধান্তে আসা। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মূল উদ্দেশ্য মামলা-মোকদ্দমার জটিলতা পরিহার করা, মামলার অযাচিত ব্যয়ভার হ্রাস করা, পক্ষগণের মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টি করা। পূর্র্বে জমিজমা-সংক্রান্ত বা পারিবারিক বিষয়ক মামলাসমূহ বছরের পর বছর আটকে থাকত এবং মীমাংসাই অসম্ভব হয়ে যেত। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধানের নিয়মানুসারে ৬০ দিনের মধ্যে মধ্যস্থতা নিষ্পত্তি করতে হবে। তার মধ্যে না হলে ৩০ দিন আদালত কর্তৃক বর্ধিত করা যাবে অর্থাৎ ৯০ দিনের মধ্যে একটি মামলার নিষ্পত্তি সম্ভব হচ্ছে। মধ্যস্থতা কার্যক্রমের গোপনীয়তা বিষয়েও সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। এটি প্রকাশ করা যাবে না এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এ ধরনের আপস নিষ্পত্তি অনুযায়ী আদালতের দেয়া কোনো ডিক্রি বা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা বা পর্যালোচনার আবেদন করা যাবে না। উক্ত প্রক্রিয়ায় মামলার সমাধান হলে আদালত সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে কোর্ট ফির টাকা ফেরতের আদেশ দিবেন। সার্বিক দিক বিবেচনায় বর্তমান সমাজব্যবস্থায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইনি সমস্যার কার্যকরী সমাধানের মাধ্যমে জনগণের দুর্ভোগ কমিয়ে এনেছে।

তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান 
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি মামলার ঝামেলা এড়িয়ে সফলতা পেতে জনগণকে অনুপ্রাণিত করছে এবং তারা উৎসাহিত হয়ে এ পদ্ধতির ওপর ভরসা পাচ্ছে। এটি আমাদের বিচারব্যবস্থার একটি যুগান্তকারী দিক। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার দেয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী (সর্বশেষ হালনাগাদ ৫ অক্টোবর, ২০২০) ৬৪টি জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে প্রাপ্ত সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৩৪ হাজার ৩৭৩ জন এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম শ্রমিক আদালত সহায়তা সেলে ২০৪১ জন এ পদ্ধতিতে সুবিধা লাভ করেছে। এ ছাড়াও ১ জানুয়ারি ২০২০ - ৩১ অক্টোবর ২০২০ পর্যন্ত এ সংস্থা ৯১৬৬টি মধ্যস্থতা করেছে। দিনদিন সুবিধাভোগীর সংখ্যা ক্রমহারে বাড়ছে, যা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে সাফল্যের বিষয়।

উপসংহার 
দীর্ঘদিন একটি মামলা আটকে থাকা শুধু জনগণের জন্যই নয়, বরং রাষ্ট্রের জন্যও যথেষ্ট ভোগান্তির। এতে রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা ব্যাহত হয় এবং তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। মামলায় দীর্ঘসূত্রতা, আর্থিক দিক এবং অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় বিকল্পবিরোধ নিষ্পত্তি এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে জনগণকে আশার আলো দেখাচ্ছে। আমাদের আইন ও বিচার বিভাগকে অবশ্যই বিষয়টিকে আরো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার পাশাপাশি সর্বত্র প্রচার ও প্রসারকল্পে এগিয়ে আসতে হবে, যাতে দেশের আপামর জনগণের মধ্যে এই পদ্ধতির বিস্তৃতি ঘটে। একই সঙ্গে আমাদেরও উচিত মামলা-মোকদ্দমার ঝামেলা পরিহার করে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির সুবিধা গ্রহণ করা এবং নিজেদের মধ্যে সম্প্রতির বন্ধন সুদৃঢ় করা। আমরা এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে পারি-

‘বিকল্পবিরোধ নিষ্পত্তি গ্রহণ করি
সুষ্ঠুভাবে আইনি সমস্যার সমাধান করি।’

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন