প্রসারিত হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম মুক্ত কর্মক্ষেত্রের পরিধি

মো. আকতারুল ইসলাম

‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ এটি মঙ্গলকাব্যের বিখ্যাত চরিত্র ঈশ্বরী পাটনির অনন্য চাওয়া।পাটনী নিঃস্বার্থভাবে সন্তানের মঙ্গল ও সুখ-সমৃদ্ধির চিন্তা করেই দেবীর কাছে উক্তিটি করেন। এ আকাঙ্ক্ষা, এ স্বপ্ন প্রতিটি মা-বাবার চিরন্তন। নিজের নাড়ি ছেঁড়া ধন এই পৃথিবীতে নিজের থেকেও ভালো থাকবে সেটিই সব মা-বাবার স্বপ্নের সর্বোচ্চ চূড়া। আবহমানকাল থেকে দেখা যায়, গ্রাম প্রধান এদেশের কৃষক বাবার সাথে তার শিশুটিও জমিতে নিড়ানি দিবে, মাথায় করে ধানের আটিটা বাড়ি নিয়ে আসবে, বাবার কোমর ধরে মইয়ের পিছনে উঠবে কিংবা বিকেলে  গরুর দড়ি ধরে আইল চরাবে। এভাবেই চলতে চলতে শিশুদের মধ্যে কেউ কেউ স্কুলমুখি হয়েছে কেউ বা বাবার সাথে হয়েছে কৃষক, হয়েছে কামলা,হাল ধরেছে সংসারের।আর যে স্কুলে গেছেহয়েছে সে শহরমুখি। মাঝখানে পৃথিবী বদলে গেছে, সারা বিশ্বব্যাপী শিল্পবিপ্লব ঘটেছে। বদলে গেছে বাংলাদেশের চিত্রও।

জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসার ঘটেছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, শিল্প বিপ্লবের ফলে সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্মিত হয়েছে,মানুষের চাহিদা বেড়েছে, জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। কলকারখানার সংখ্যা বেড়েছে, বিগত চার দশকে শিল্প কারখানার বিস্ময়কর উন্নয়ন ঘটেছে। কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। বর্তমানে শুধু গার্মেন্টস শিল্পেই ৪০/৪৫ লাখ শ্রমিক কাজ করে। শহরের পরিধি বেড়েছে,জীবনের চাহিদাবৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষ শহরমুখি হয়েছে। শিল্প কারখানার প্রসারে শহরে কর্মজীবী মানুষের পরিমাণ বেড়েছে। সাথে সাথে কর্মের খোঁজে কর্মহীন মানুষ ও শহরমুখি হয়েছে । জীবন যাত্রার খরচের সাথে তাল মেলাতে জীবনের ঝুঁকি আছে এমন কাজেও সন্তানকে পাঠাতে দ্বিধা করেনি, ঝুঁকিপূর্ণ কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ নয় এমন সকল কর্মক্ষেত্রে শিশুশ্রম বেড়েছে। যদিও কোন বাবা-মা চায় না তার সন্তান শ্রমে নিযুক্ত হোক। সব বাবা-মা সন্তানের উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে।

১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার পরে জাতির পিতা সোনার বাংলা গড়তে বাঙালির জীবনমানের উন্নয়ন, কর্মের স্থিতিশীলতা, শ্রমজীবী মাসুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন  টেকসই করার জন্য সকল শিল্প কারখানাগুলো রাষ্ট্রীয়করণ করেন।স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণ এবং অধিকার সংরক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে ১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওতে যোগদেনএবং জাতির পিতার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আইএলও এর সদস্যপদ লাভ করে। বঙ্গবন্ধু জানতেন, দেশের স্বাধীনতা লাভের পর দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। নতুন নতুন শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠিত হবে। শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা বাড়বে। বাড়বে শিশু শ্রমের সংখ্যাও। তাই তো তিনি শিশুদের অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালেই শিশু নীতি প্রণয়ন করেন। শিল্প কারখানা বৃদ্ধির সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ খাতের পরিমাণ। সরকার শিশুদের সুস্থ পরিবেশে মানুষ হওয়ার সুযোগ দিতে তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ  শিশুশ্রম সংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন অনুস্বাক্ষর করেছে। নানা কারণে শিশুরা শিশুশ্রমে নিযুক্ত হয়। যেমন- দরিদ্রতা, পরিবারের অতিরিক্ত সদস্য সংখ্যা,অতিরিক্ত আয় করার চাপ, শিক্ষার ব্যয় বহনে ব্যর্থতা, শিক্ষার তুলনায় শ্রমের বিনিময়ে আয়ের বেশি মূল্য, অভিবাসন, পূর্ণবয়স্ক সদস্যদের বেকারত্ব বাবা-মায়ের বিচ্ছিন্নতা, ঋণগ্রস্থতা এবং শিশুদের হাত খরচের চাহিদা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস-এর ২০০৩ সালের এক জরিপে দেখা যায়,বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ৩৪ লাখ শিশুশ্রমে নিযুক্ত। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্প গ্রহন, বাবা-মা এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে পরের দশ বছরে শিশুশ্রমের সংখ্যা নেমে আসে অর্ধেকে।

২০১৩ সালের বিবিএস জরিপে দেখা যায় শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুর সংখ্যা ১৭ লাখ। এর মধ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ২০১০ সালে জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি প্রণয়ন করে এবং ২০১৩ সালে এ্যালুমিনিয়াম ও এ্যালুমিনিয়াম জাতীয় দ্রব্যাদি তৈরি, অটোমোবাইল ওর্য়াকসপ, ব্যাটারি রি- চার্জিং, বিড়ি ও সিগারেট তৈরি, ইট বা পাথর ভাঙ্গা, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ বা লেদ মেশিন, কাচ বা কাচের সামগ্রী তৈরি, ম্যাচ তৈরি, প্লাস্টিক বা রাবার সামগ্রী তৈরি, লবণ তৈরি, সাবান বা ডিটারজেন্ট তৈরি, স্টিল ফার্নিচার বা গাড়ি বা মেটাল ফার্নিচার রং করা, চামড়াজাত দ্রব্যাদি তৈরি, ওয়েল্ডিং বা গ্যাস বার্নার, কাপড়ের রং ও ব্লিচ করা, জাহাজ ভাঙ্গা, চামড়ার জুতা তৈরি, ভলকানাইজিং, মেটাল কারখানা, জিআই শিট বা চুনাপাথর বা চক সামগ্রীর কাজ, স্পিরিট বা অ্যালকোহলজাত দ্রব্যাদি প্রক্রিয়াকরণ, জর্দা ও তামাক বাকুইবাম তৈরি, কীটনাশক তৈরি, স্টিল বা মেটাল কারখানা, আতশবাজী তৈরি, সোনার সামগ্রী বা ইমিটেশন বা চুড়ি তৈরির কাজ, ট্রাক বা টেম্পো বা বাস হেলপার, স্টেইনলেস স্টিল সামগ্রী তৈরি, ববিন ফ্যাক্টরিতে কাজ, তাঁতের কাজ, ইলেকট্রিক মেশিনের কাজ, বিস্কুট বা বেকারির কাজ, সিরামিক কারখানার কাজ, নির্মাণ কাজ, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে কাজ, কসাইয়ের কাজ, কামারের কাজ এবং বন্দরে মালামাল হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ, এই ৩৮টিকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধিত-২০১৮) অনুযায়ী ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে শ্রমে নিযুক্ত করা যাবে না, তবে ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ নয় এমন হালকা কাজ করতে পারবে। বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত শিশুশ্রমের সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। শিশুশ্রম নিরসনে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে ২২টি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জাতীয় শিশুশ্রম কল্যাণ পরিষদ গঠন করা হয়। বিভাগীয় কমিশনার জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা পর্যায়ে ইউএনওদের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিগুলো শিশুশ্রম নিরসনে সামাজিক আন্দোলনএবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। মাঠ পর্যায়ে কলকারখানাও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কল-কারখানায় শিশুশ্রমের বিষয়টিকে শ্রম পরিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত করেছে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্পের মাধ্যমে উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং জন সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম গ্রহণ, বিভাগীয় এবং জেলা পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার অংশগ্রহণে সচেতনতামূলক সভা অনুষ্ঠান এবং শ্রম পরির্দশনের কারণে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে। তাই প্রতিদিনই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রমের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে ।

প্রসারিত হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম মুক্ত কর্মস্থলের পরিধি। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ৩৮টি ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে ২০১৭-২০১৮ সালে তৈরি পোশাক শিল্প এবং চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প সেক্টরে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম মুক্ত করা হয়েছে এবং ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে আরো ২২টি সেক্টরকে ঝুঁকিপূণৃ শিশুশ্রম মুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ইতোমধ্যে ট্যানারি, চামড়াজাত দ্রব্য, জাহাজ ভাঙ্গা, সিল্ক, সিরামিক ও কাঁচ শিল্প সেক্টরের মালিক সমিতির সভাপতি/চেয়ারম্যানগণের কাছ থেকে শিশু শ্রমিক নিয়োগ করা হয় না মর্মে প্রত্যয়ন পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে একটি জাতীয় মনিটরিং কোর কমিটি গঠন করে নিয়মিত পরিদর্শন ও ফলোআপ পরিদর্শনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হচ্ছে। গত ঈদুল আযহার পরে কোরবানির চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে কোনো পর্যায়ে যাতে শিশুদের নিয়োগ না দেয়া হয় সেজন্য শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে প্রথমবারের মতো উদ্যোগ নেয়া হয়এবং শ্রম পরিদর্শকগণের মাধ্যমে মনিটরিংজোরদার করা হয়। ফলে এ সময় চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে শিশুশ্রম চোখে পড়েনি। এসকল শিল্প সেক্টরে সফলতাধরে রেখে বাকি ঝুঁকিপূর্ণ শিল্প সেক্টরে শিশুশ্রম নিরসনে সরকার বদ্ধ পরিকর। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্পের চতুর্থ পর্যায়ের কার্যক্রম বাস্তবায়ন চূড়ান্ত অবস্থায় রয়েছে। চতুর্থ পর্যায়ে এক লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে আনা হবে। তাদের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং কর্মমুখি প্রশিক্ষা দেয়া হবে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের এসময়ে শিশুর বাবা-মাকে মাসিক সম্মানী দেয়া হবে। সেই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে জনসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রমের গতি বৃদ্ধি করা হবে। এ বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, শিশুশ্রম নিরসনে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। শিশুশ্রম নিরসন নীতির আলোকে জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় ৯টি কৌশলগত ক্ষেত্র চিহ্নিত করে ১০টি মন্ত্রণালয়/বিভাগকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী শিশুশ্রম মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহ, অধীনস্থ দপ্তর-সংস্থায় শিশুশ্রম নিরসন সংক্রান্ত কাজের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে, সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়ে বাবা-মায়ের সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি বাস্তব ভিত্তি পাচ্ছে এবং ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম মুক্ত কর্মক্ষেত্রের সংখ্যা প্রসারিত হচ্ছে যা অবশ্যই উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের হাতছানি। 

আশা করা যায়, জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ৮.৭ অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমসহ সকল প্রকার শিশুশ্রমের অবসান ঘটবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সফলতার সিঁড়ি বেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রূপকল্প -২০৪১ এর আগেই শিশুশ্রম মুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়া সম্ভব হবে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন