চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশটি থেকে ১ হাজার ৩৬৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এর বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে রফতানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৮৩ কোটি ডলারের। সম্প্রতি দেশটি বাংলাদেশকে ৯৭ শতাংশ বা ৮ হাজার ২৫৬টি পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত বাণিজ্য সুবিধা দিয়েছে। যদিও দেশের প্রধান রফতানি খাত পোশাক শিল্পের মালিকরা বলছেন, এক-তৃতীয়াংশ পোশাক পণ্য এখনো চীনের শুল্ক সুবিধার বাইরেই রয়ে গেছে।
দীর্ঘ সমঝোতার পর গত ১৬ জুন বাংলাদেশকে ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা প্রদান করে আদেশ জারি করে চীন। চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় একপক্ষীয়ভাবে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে এ সুবিধা প্রদান করায় বাংলাদেশকে এর বিপরীতে কোনো ছাড় দিতে হবে না। ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া এ বাণিজ্য সুবিধার আওতায় থাকা পণ্যগুলোর একটি তালিকাও সম্প্রতি প্রকাশ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের রফতানির ৮৫ শতাংশই পোশাক পণ্য। চীনে যেসব পণ্য বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয় তার সিংহভাগই পোশাক। এ অবস্থায় চীনে প্রবেশে শুল্ক সুবিধার কার্যকারিতা সম্পর্কে পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুবিধাটি পোশাক রফতানিকারকদের জন্য কতটা কার্যকর তা এখন দেখার বিষয়। কারণ চীনে রফতানি হওয়া পোশাক পণ্যের বড় একটি অংশ সুবিধার বাইরে রয়ে গেছে। এছাড়া সুবিধার আওতায় রুলস অব অরিজিনেও এসেছে পরিবর্তন। সেই শর্ত পূরণ করে শুল্ক সুবিধা ভোগ নিয়েও প্রশ্ন রয়ে গেছে।
চীনে পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার নিয়ে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর বিশ্লেষণ বলছে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রি (এলডিসি) স্কিম অনুযায়ী, মোট ২৯৯টি পোশাক পণ্যের জন্য চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেয়েছে বাংলাদেশ। ২৯৯টির মধ্যে ২২৬টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা এশিয়া প্যাসিফিক ট্রেড এগ্রিমেন্টের (এপিটিএ) আওতায় আগে থেকেই ছিল। নতুন সুবিধার আওতায় ৮ সংখ্যার এইচএস কোডে নতুন করে মোট ৭৩টি পণ্য শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, চীনের বাজারে নতুন করে বাড়তি সুবিধা পেলেও আমরা শতভাগ পণ্যের বাজার সুবিধা পাচ্ছি, বিষয়টি তেমন নয়। কারণ ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত যে ১৯ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্যের ওপর শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতাম না তার মধ্যে মাত্র ২ কোটি ডলারের পণ্য নতুন করে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেল। অর্থাৎ ১৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার মূল্যের পণ্য এখনো শুল্কমুক্ত সুবিধার বাইরে আছে, যা ওই বছরে চীনে আমাদের মোট পোশাক রফতানির ৩৫ দশমিক ১৮ শতাংশ। নতুন সুবিধা প্রাপ্তির ফলে চীনে পোশাক রফতানি মূল্যের ৪ শতাংশ যুক্ত হলো, কিন্তু রফতানির এক-তৃতীয়াংশে এখনো ৬ থেকে ১২ শতাংশ হারে শুল্ক প্রযোজ্য হবে এমন তথ্য উল্লেখ করে রুবানা হক বলেন, পূর্ববর্তী সুবিধার আওতায় রুলস অব অরিজিন অনুযায়ী ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের বিধান ছিল, যা নতুন নিয়মে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৪০ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ রুলস অব অরিজিন প্রতিপালন করা কিছুটা কঠিন হয়ে পড়েছে। আর এ শর্ত পূরণ করে কী পরিমাণ পণ্য বাজার সুবিধা ভোগ করতে পারে, সেটি এখন দেখার বিষয়।
বিজিএমইএ বলছে, চীনে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৫০ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি করে, যার মধ্যে ৩০ কোটি ৮৪ লাখ ডলার পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীনে বাংলাদেশ ৫০ কোটি ৭০ লাখ ডলার মূল্যের ১৫৫টি পোশাক পণ্য রফতানি করে, যার মধ্যে ৪৭টি পণ্য এখনো কোনো প্রকার বাজার সুবিধার বাইরে থাকল।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মনে করে, চীন ১৪০ কোটি জনসংখ্যার একটি বিশাল সম্ভাবনাময় বাজার। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে এ দেশের জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমেই বাড়ছে। একইভাবে উৎপাদন ব্যয়ও বাড়ছে। চীনের বাজারে ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত (ডিএফকিউএফ) প্রবেশাধিকার সুবিধায় তৈরি পোশাকসহ বাংলাদেশের রফতানি সক্ষমতাসম্পন্ন প্রায় সব পণ্য চীনে শুল্ক ও কোটামুক্তভাবে প্রবেশের সুবিধা পাবে। ফলে চীনে রফতানি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে, যা বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির বাণিজ্য বৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের (বিএফটিআই) সিইও আলী আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, চীনে শুল্ক সুবিধা পাওয়া তালিকাটি যাচাই-বাছাই চলছে। এ কার্যক্রম শেষ হলে সুবিধার কার্যকারিতা সম্পর্কে মতামত জানানো সম্ভব হবে।
চীন ১ জুলাই থেকে এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত বাজার প্রবেশাধিকার সুবিধা দিচ্ছে জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, প্রাথমিকভাবে এ সুবিধার আওতায় বাংলাদেশসহ ৩৩টি স্বল্পোন্নত দেশকে চীনের ৬০ শতাংশ ট্যারিফ লাইনে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করা হয়। কিন্তু চীনের দেয়া এ সুবিধা বাংলাদেশের রফতানি সক্ষমতার অনুকূল কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় যে বাংলাদেশের রফতানি সক্ষমতা আছে এমন অনেক পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের জন্য রফতানি সম্ভাবনাময় পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা প্রদানের জন্য চীনকে অনুরোধ করে।
মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যদিও চীন ২০১৩ সালে শুল্কমুক্ত সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৪০টিতে উন্নীত করে। এর মধ্যে ২৪টি স্বল্পোন্নত দেশ যারা ১ জানুয়ারি ২০১৫-এর আগে চীনের সঙ্গে লেটার অব এক্সচেঞ্জ স্বাক্ষর করেছে তারা ৯৭ শতাংশ ট্যারিফ লাইনে, ১২টি স্বল্পোন্নত দেশ যারা ১ জানুয়ারি ২০১৫-এর পরে লেটার অব এক্সচেঞ্জ স্বাক্ষর করেছে, তারা ৯৫ শতাংশ ট্যারিফ লাইনে এবং বাংলাদেশ ও মৌরিতানিয়া মাত্র ৬০ শতাংশ ট্যারিফ লাইনে এ সুবিধা পেয়ে আসছিল। বাংলাদেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে চীন অবহিত করে যে লেটার অব এক্সচেঞ্জ স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ ৯৭ শতাংশ ট্যারিফ লাইনে শুল্কমুক্ত সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। তবে শর্তারোপ করে যে স্বল্পোন্নত দেশকে দেয়া সুবিধা গ্রহণ করলে বাংলাদেশ এপিটিএর আওতায় স্বল্পোন্নত দেশের জন্য বিদ্যমান সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে না।