নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির পটভূমিতে পরিবর্তন এসেছে। চাহিদা ও সরবরাহ শৃঙ্খলের দুরবস্থায় বিশ্বজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। তবে করোনার প্রভাবে অর্থনীতির পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সবাই যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তা নয়। বরং এখানেও দেখা গেছে অসাম্য। ফলে ধনীরা আরো ধনী হয়েছেন। আর মধ্য ও নিম্নবিত্তরা মন্দার চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের নতুন একটি প্রতিবেদন অন্তত সেই কথাই বলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ জন শীর্ষ ধনীর কাছে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, দেশটির অর্ধেক নাগরিকের মোট সম্পদ যোগ করলে তার সমান হবে।
চলতি বছরের প্রথমার্ধে মার্কিনিদের সম্পদ পর্যালোচনা করে ফেড জানিয়েছে, জাতি, বয়স ও শ্রেণীভেদে মার্কিনদের সম্পদ ধারণে অসাম্য প্রকট হয়েছে। ফেডের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর কাছে সম্মিলিতভাবে ৩৪ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারের সম্পদ রয়েছে। অন্যদিকে দরিদ্র ৫০ শতাংশ (প্রায় ১৬ কোটি ৫০ লাখ) মার্কিনের মোট সম্পদের পরিমাণ মাত্র ২ লাখ ৮ হাজার কোটি ডলার, যা যুক্তরাষ্ট্রের মোট হাউজহোল্ড ওয়েলথের মাত্র ১ দশমিক ৯ শতাংশ।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ৫০ বিত্তবানের কাছেও সম্মিলিতভাবে সম্পদ রয়েছে প্রায় ২ লাখ কোটি ডলার। চলতি বছরের শুরুর দিকে তাদের সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩৩ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। করোনা মহামারীর মধ্যে কর্মসংস্থান হারানো, ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সাধারণ মার্কিনরা যেখানে খাদের কিনারে চলে এসেছে, সেখানে শীর্ষ ৫০ ধনকুবের এ সময়ে রীতিমতো সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
মহামারীর কারণে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন স্বল্প আয়ের সেবাকর্মীরা। চাকরি হারিয়ে সরকারের বেকারত্ব ভাতার আবেদনকারীদের মধ্যে তাদের সংখ্যাই বেশি। অন্যদিকে উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর পেশাজীবীরা বেশ ভালোই আছেন। মহামারীর সময়ে বাসা থেকে অফিস করছেন তারা। কর্মসংস্থান হারানোর দুশ্চিন্তায় তো পড়তে হয়ইনি, উপরন্তু সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তরফ থেকে অর্থনীতি ও বাজারে প্রণোদনার অর্থ যোগ হওয়ায় তাদের রিটায়ারমেন্ট অ্যাকাউন্ট ফুলে-ফেঁপে উঠেছে।
সম্পদমূল্যে অসাম্যের নেপথ্যে আরো একটি কারণ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে শেয়ারদরে যে উত্থান দেখা গেছে, বেশির ভাগ মার্কিনই তার ফায়দা লুটতে পারেননি। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে ৫০ শতাংশের বেশি করপোরেশন ইকুইটি ও মিউচুয়াল ফান্ড শেয়ার মাত্র ১ শতাংশ সম্পদশালীর দখলে রয়েছে। পরবর্তী ৯ শতাংশ বিত্তবান এক-তৃতীয়াংশের বেশি ইকুইটি শেয়ারের মালিক। সব মিলিয়ে ১০ শতাংশ শীর্ষ ধনী সম্মিলিতভাবে ৮৮ শতাংশ ইকুইটি শেয়ার নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। ফলে পুঁজিবাজারে শেয়ারদর বেড়ে গেলে তা কেবল ধনীদের সম্পদমূল্যই বাড়াচ্ছে।
ফেডের প্রতিবেদন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজারে মিলেনিয়াল (১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে যাদের জন্ম) অর্থাৎ তরুণ কর্মীদের সংখ্যাই বেশি (৭ কোটি ২০ লাখ)। অথচ তারা যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশের মালিক। এ সম্পদও মাত্র কয়েকজনের হাতেই সীমাবদ্ধ। তাদের মধ্যে তিন মিলেনিয়াল উদ্যোক্তা—ফেসবুক ইনকরপোরেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ ও ডাস্টিন মস্কোভিটজ এবং ওয়ালমার্ট সাম্রাজ্যের বর্তমান কর্ণধার লুকাস ওয়ালটনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এবার আসা যাক বর্ণের ভিত্তিতে অসাম্যের বিষয়ে। কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানরা যে অর্থনৈতিকভাবে এখনো অবহেলিত, ফেডের তথ্যে তারই প্রমাণ মিলেছে। ফেড বলছে, সম্পদ বিন্যাসের পাই চার্টে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের অংশীদারিত্ব তিন দশক আগে যা ছিল, এখনো তা-ই আছে। যুক্তরাষ্ট্রে মোট সম্পদের ৮৩ দশমিক ৯ শতাংশ শেতাঙ্গ আমেরিকানদের দখলে রয়েছে। অন্যদিকে কৃষ্ণাঙ্গদের কাছে রয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ১ শতাংশ, যা ১৯৯০ সালেও একই ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ২৫ ধনীর মধ্যে কেবল একজনই রয়েছেন, যিনি শেতাঙ্গ নন। তিনি হলেন জুম ভিডিও কমিউনিকেশনস ইনকরপোরেশনের প্রধান নির্বাহী এরিক ইউয়ান। বাড়িতে বসে কাজ ও দূরশিক্ষণের আশীর্বাদে চলতি বছর তার সম্পদমূল্য সাত গুণ বেড়ে ২ হাজার ৪২০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
ফেডপ্রধান জেরোমি পাওয়েল বলেছেন, ‘করোনা মহামারী সম্পদ ও অর্থনৈতিক অসাম্য আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।’
তিনি অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারকে আরো বেশি সহায়তা দেয়ার আহ্বান জানান।
করোনা মহামারীকালীন অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগীদের মধ্যে প্রযুক্তি কোম্পানি-সংশ্লিষ্টদের আধিক্য রয়েছে। তাদের মধ্যে সবার ওপরে রয়েছেন অ্যামাজন ডটকম প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস। চলতি বছর তার সম্পদমূল্য বেড়েছে ৬৪ শতাংশ। ব্লুমবার্গ