অটোগ্যাসে সম্ভাবনা আছে, প্রসার নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

গাড়ির সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসেবে সুনাম রয়েছে অটোগ্যাসের। পণ্যটির ব্যবসায় সরকারের নীতিসমর্থনও রয়েছে। ব্যবসায়িক দিক থেকেও সম্ভাবনা রয়েছে অনেক। তার পরও দেশে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় প্রসার ঘটছে না পণ্যটির ব্যবসার।

তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) গাড়িতে ব্যবহার করা হলে এটিকে অভিহিত করা হয় অটোগ্যাস নামে। ক্লিন বা গ্রিন ফুয়েল হিসেবে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি আছে গ্যাসের। উন্নত দেশগুলোয় গাড়ির প্রধান জ্বালানি অটোগ্যাস। উন্নয়নশীল অনেক দেশও ঝুঁকছে এতে। ওজন সিএনজির চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ কম। অন্যদিকে সিলিন্ডারে চাপ কম থাকায় বিস্ফোরণের ঝুঁকিও অনেক কম। পরিবহনযোগ্য হওয়ায় দেশের যেকোনো প্রান্তেই অটোগ্যাস ফিলিং স্টেশন করা সম্ভব। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে সরকারও এখন গাড়ির জ্বালানি হিসেবে সিএনজির বদলে অটোগ্যাসকেই প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে।

দেশে পরিবহনে এলপিজির ব্যবহার শুরু হয় ২০০৫ সালে। -সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করা হয় ২০১৬ সালে। ব্যবহার শুরুর পর দেড় দশক পেরিয়ে গেলেও গাড়ির জ্বালানি হিসেবে অটোগ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি ব্যবসায়িক প্রসার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় দেখা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে দেশে কতগুলো গাড়িতে অটোগ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে, সে সম্পর্কে কারো কাছে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য না থাকলেও সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রসঙ্গত, দেশে নিবন্ধিত মোটরযানের সংখ্যা ৪৫ লাখের বেশি। পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর তথ্য বলছে, এর মধ্যে চলাচলরত গাড়ির সংখ্যা ৩০ লাখের মতো। জ্বালানি হিসেবে এসব গাড়ি মূলত ডিজেল, পেট্রল, অকটেন সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস বা সিএনজি ব্যবহার করে। সরকারের রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) হিসেবে সিএনজিতে চলা গাড়ির সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখ।

ব্যবসায়ী ব্যবহারকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৫০০ সিসির একটি গাড়ির অটোগ্যাস ধারণক্ষমতা ৬০ লিটার। একবার ফুল রিচার্জে একটা গাড়ি হাইওয়েতে ৪০০-৪৫০ কিলোমিটার চলতে পারে। ঢাকায় চলতে পারে ৩০০-৩৫০ কিলোমিটার। বিপরীতে সমপরিমাণের এক সিলিন্ডার সিএনজিতে একটি গাড়ি চলতে পারে ৮০-৯০ কিলোমিটার। বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার সিএনজির দাম ৪৩ টাকা। অন্যদিকে প্রতি লিটার অটোগ্যাসের বাজারমূল্য ৫০ টাকা। মূল্য বিবেচনায় বর্তমান সময়টিকেই গাড়িতে অটোগ্যাসের ব্যবহার বাড়ানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু নানামুখী জটিলতায় ব্যবসা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সম্প্রসারণ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তারা। এর পেছনে দায়ী করা হচ্ছে প্রচার-প্রচারণার অভাব, অটোগ্যাস চালুর প্রক্রিয়া -সংক্রান্ত অনুমোদনের দীর্ঘসূত্রতা, গাড়ি মালিকদের কনভারশনে অনীহা মূল্য সমন্বয়হীনতাকে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, সিএনজি থেকে এলপিজিতে একটি গাড়ি কনভারশনে খরচ হয় ৪০-৫০ হাজার টাকা। গাড়িতে সিএনজি সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারি নীতি-সহায়তা রয়েছে। অন্যদিকে এলপিজিতে ধরনের কোনো সহায়তার ঘোষণা এখনো দেয়া হয়নি। লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে গ্যাস নেয়ার ঝামেলা না থাকলেও অটোগ্যাস এখনো সহজলভ্য নয়, গোটা রাজধানীতে এখন পর্যন্ত মাত্র ৫০টি এলপিজি স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে।

সিএনজি ফিলিং অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ফারহান নূর বণিক বার্তাকে বলেন, এলপিজি ব্যবহারে কনভারশনের বিষয়টি গাড়ি মালিকদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নানা কারণেই এলপিজিতে সুবিধার কথা বলা হলেও অনেকে আগ্রহী হতে পারছেন না।

তিনি বলেন, দেশে এখন অত্যাধুনিক গাড়ি আসছে। ব্যাটারিচালিত গাড়ি বাজারে এসেছে। অবস্থায় কনভারশন সিস্টেমের প্রতি সরকার উৎসাহিত করলেও বাজারে অনেক অত্যাধুনিক মডেলের গাড়ি রয়েছে, যেখানে ডুয়েল-ফুয়েল সিস্টেম রয়েছে। ফলে যেটি সহজ, সেটি মানুষ গ্রহণ করবে।

বৈশ্বিক পরিবহন জ্বালানি খাতে গ্রিন ফুয়েল বা পরিবেশবান্ধব জ্বালানির চাহিদা বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও অটোগ্যাসের ব্যবসায় সাফল্যের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এলপিজি খাতের বেশ কয়েকটি কোম্পানি এরই মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা যমুনার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজও শুরু করেছে। বর্তমানে অটোগ্যাস ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি বেসরকারি কোম্পানিগুলোর হাতে। সরকারের কাছ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের এলপিজি স্টেশন নির্মাণ, যন্ত্রপাতি, লোকবলসহ অটোগ্যাসের ব্যবসার অনুমোদন পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এছাড়া অনুমোদন পাওয়ার পরও দ্রুততম সময়ের মধ্যে কার্যক্রম চালু করা সম্ভব হয়ে ওঠে না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) সভাপতি ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক আজম জে চৌধুরী বলেন, প্রথমত, অটোগ্যাস ইনস্টলেশনে যেসব জিনিসপত্র প্রয়োজন, সেগুলো বিদেশ থেকে আনতে হয়। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এছাড়া যেখানে বা যেসব ফিলিং স্টেশনে অটোগ্যাস ইনস্টলমেন্ট দেয়া হয়, সেগুলোর সরকারি অনুমোদন প্রয়োজন হয়, সেটিও একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তবে তার চেয়েও বড় কারণ হলো সুবিধা ইঞ্জিনের স্থায়িত্বের দিক থেকে এলপিজি-সিএনজির পার্থক্য সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করতে না পারা। এসব কারণেই ব্যবসা এগোয়নি। এখন মানুষ বিষয়ে জানতে পারছে, যে কারণে ব্যবসায় সম্ভাবনাও জেগেছে।

গাড়িতে এলপিজির ব্যবহার নিয়ে জ্বালানি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালে রিফুয়েলিং স্টেশন, রূপান্তর ওয়ার্কশপ স্থাপন, পরিচালন রক্ষণাবেক্ষণ নীতিমালা জারি করে। নীতিমালার আওতায় শুরুতে অটোগ্যাস ব্যবসার জন্য জ্বালানি বিভাগ থেকে অনুমোদন পায় বেক্সিমকো এলপিজি। এর আওতায় কোম্পানিটি ৫০০টি ফ্র্যাঞ্চাইজি ২৫টি কনভারশন ওয়ার্কশপ স্থাপনের অনুমতি পায়। ওই নীতিমালা জারির পর গত চার বছরে এর আওতায় আরো এক হাজার অটোগ্যাস স্টেশন স্থাপনের অনুমতি পেয়েছে সাত-আটটি এলপিজি বিপণনকারী কোম্পানি। যদিও এর মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৫০টি চালু হওয়ার তথ্য পাওয়া গিয়েছে।

কোম্পানিগুলোর দেয়া তথ্যমতে, এলপিজি খাতের দেশের সবচেয়ে বড় কোম্পানি বসুন্ধরা এলপিজি অটোগ্যাস স্থাপনে সারা দেশে ১৭৫টি ফিলিং স্টেশনের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এর আওতায় এরই মধ্যে ৪০টি স্টেশনে অটোগ্যাস সরবরাহ শুরু করছে কোম্পানিটি। ১০০টি ফিলিং স্টেশনে অটোগ্যাস সরবরাহের জন্য ব্যবসায়িক চুক্তি করেছে জি-গ্যাস। এর মধ্যে ৩৫টিতে অটোগ্যাস বিক্রি শুরু হয়েছে। এছাড়া ওমেরা এলপিজি থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে ২২টিতে। এর বাইরে বিএম, পেট্রোম্যাক্স ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানও বেশ কয়েকটি ফিলিং স্টেশনের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে অটোগ্যাস বিক্রি করছে।

বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা মনে করছেন, এতদিন অটোগ্যাস ব্যবসার সম্প্রসারণ করতে না পারার আরেকটি বড় কারণ হলো সিএনজি এলপিজির দামের সমন্বয়হীনতা। বিষয়ে বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের হেড অব সেলস প্রকৌশলী জাকারিয়া জালাল বলেন, দামের পার্থক্য থাকলে মানুষ অবশ্যই সাশ্রয়ের কথা চিন্তা করবেন। এখন সিএনজি এলপিজির দাম কাছাকাছি। সুতরাং এখন অটোগ্যাস ব্যবসার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন