হাসু আপাকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদতাম

শেখ রেহানা

শেখ হাসিনা আমাদের পরিবারের বড় মেয়ে। আমরা তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে সে বড়। আমাদের সকলের প্রিয় হাসু আপা। আমার চেয়ে দশ বছরের বড়। তার কোলে চড়েই আমি বড় হয়েছি। আমাদের পারিবারিক বন্ধনটি আনন্দময় ছিল। বিশেষ করে আমার মায়ের শাসন, আদর-যত্ন ভালোবাসার কোনো তুলনা খুঁজে পাই না। আব্বা রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, সভা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। অধিকাংশ সময় তাকে রাজবন্দি হিসেবে দেখেছি। কারাগারে যখন তাকে সাক্ষাতের দিন দেখতে যেতাম, তার আদর-স্নেহে আমাদের জড়িয়ে রাখতেন। যখন খুব ছোট্ট ছিলাম, আমাকে কোলে বসিয়ে রাখতেন। যখন স্কুলে পড়ি তাকে দেখতে গিয়ে অনেক খবর জানাতাম। কত কথা বলতাম। মাথায় হাত বুলিয়ে কত কথা বলতেন। যেদিন আব্বাকে দেখতে যেতাম না, সেদিন চিঠি লিখে পাঠাতাম। আব্বার অবর্তমানে মা হাসু আপা আমাদের কাছে এক বিরাট বটবৃক্ষের মতো ছিলেন। আমাদের চাওয়া-পাওয়া তারাই মেটাতেন। শিশুকাল থেকেই মা আমাদের গল্প শোনাতেন। জীবনে ভালো হয়ে চলার জন্য অনেক কথা শেখাতেন। তিনি ছিলেন ধৈর্য সহনশীলতার শ্রেষ্ঠ স্বাক্ষর। হাসু আপা তার কাছ থেকে শিক্ষাটা মনে হয় উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছেন। আমাদের বাড়িতে একটা সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল। হাসু আপা ছায়ানটে বেহালা বাজানো শিখতেন, কামাল ভাই সেতার শিখতেন, জামাল ভাই গিটার শিখতেন এবং আমি শিখতাম গান নাচ। বাড়িতে আমরা খেলাধুলা করতাম। আমাদের মধ্যে সাইকেল চালানো প্রতিযোগিতা হতো। আমরা সবাই বাড়ির বাইরে গিয়ে সাইকেল চালাতাম কিন্তু হাসু আপাকে বাড়ির ছাদে সাইকেল চালাতে হতো। আব্বা মা বাইরে গেলে হাসু আপা আমাদের গার্জিয়ান হতো। আমরা সব লক্ষ্মী হয়ে ঘরে বসে লুডু, দাবা, ক্যারম খেলতাম। তার নিয়মনীতি মেনে চলতে হতো। অনেক সময় তার শাসনও খুব কঠিন হতো। ঈদের সময় মা হাসু আপা আমাদের ঘরে জামা-কাপড় সেলাই করতেন। অনেক আত্মীয়স্বজনের কাপড়ও সেলাই করা হতো। আমি মাঝে মাঝে হাসু আপার কাছে ফ্রকের নতুন ডিজাইনের আবদার করতাম। তার বিনিময়ে তাকে চা কফি তৈরি করে খাওয়াতাম। যতক্ষণ না সেলাই শেষ হয় আমাকে খেদমত করতে হতো। সেলাইও শেষ আমার চা তৈরির কাজও শেষ। আমাদের বাসায় আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও মানুষের ভিড় লেগেই থাকত। আবার যখন দুঃসময় এসে দাঁড়াত দেখতাম শূন্যতায় খা খা করছে। আব্বা যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি ছিলেন এবং তার খবরই পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন আমার মা হাসু আপা আমাদের আগলে রাখতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে আব্বা আমাকে হাসু আপার সঙ্গে পাঠিয়ে দেন। পরে মগবাজারের এক আত্মীয় বাড়িতে আমার মায়ের সঙ্গে থাকি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও আব্বার জন্য দুশ্চিন্তায় আমাদের দিন কেটেছে। আমাদের গ্রেফতার করে ধানমন্ডি ১৮ নম্বর রোডের এক বাসায় বন্দি রাখা হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা খুব খারাপ ব্যবহার করত। আমাদের খাওয়ারও খুব কষ্ট হতো। হাসু আপার ছেলে জয়ের জন্ম হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজে। মাকে একবারও যেতে দেয়া হয়নি। মা খুব কাঁদত ঘরে বসে। অফিসাররা বলত, আপনি কি ডাক্তার, আপনি গিয়ে কী করবেন? মা উত্তর দিতেন, আমি মা। কামাল ভাই, জামাল ভাই মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে। আমি রাসেল ছিলাম মায়ের কাছে।

হাসু আপা যেদিন ছোট্ট জয়কে নিয়ে ঘরে ফেরে সেদিন আমাদের আনন্দের সীমা ছিল না। জয়কে কোলে নিয়ে মায়ের সেই হাসি-খুশি আনন্দঘন মুহূর্তটি আজও আমার মনে পড়ে। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে কামাল জামাল ভাইয়ের বিয়ের সময় আমরা খুব আনন্দ করেছিলাম। আমি তখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। আগস্টের প্রথম দিকে হাসু আপা জয় পুতুলকে নিয়ে দুলাভাইয়ের সঙ্গে জার্মানি যাচ্ছিল। আব্বা মা আমাকেও তাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন। আমার একটুও যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। হাসু আপা দুই বাচ্চা নিয়ে কষ্ট করবে বলে মা আমাকে যেতে বললেন। যাওয়ার সময় মা খুব কাঁদছিলেন। রাসেল আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখল বিমানে না ওঠা পর্যন্ত। সবাই এসেছিল সেদিন। আব্বা মাকে ছেড়ে যেতে হবে বলে আমারও মন খারাপ ছিল। যাহোক, জার্মানি গিয়ে আমরা থাকলাম। আশপাশের দেশের শহরেও বেড়ালাম। ১৩ আগস্ট মা আব্বার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হলো আমার। দেশে ফেরার জন্য আমি কান্নাকাটি করলাম। আব্বা বললেন, আমি বলে দিচ্ছি তুমি যেন তাড়াতাড়ি চলে আসো। ১৫ আগস্টের শোকাবহ ঘটনার কথা যখন শুনি, আমরা একেবারে বাকহীন হয়ে পড়ি। এমন নিষ্ঠুরতা ঘটাল কী করে? আব্বা না হয় রাজনীতি করতেন, আড়ালে তাঁর শত্রু থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। না হয় মেনেই নিলাম, সেই আড়ালের শত্রু মরণ আঘাত হানতে পারে, হেনেছে। কিন্তু আমার মা, ছোট্ট রাসেল, ভাই ভাবিরা তো রাজনীতি করত না। হাসু আপাকে জড়িয়ে ধরে আমরা দুই বোন শুধু কাঁদতাম। দুজন দুজনকে সান্ত্বনা দিতাম। দুজনে দুজনের চোখের পানি মুছিয়ে দিতাম। হাসু আপাকে এক মুহূর্ত না দেখলে আমার মন ছটফট করত। হাসু আপা আমার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে জোর করে খাওয়াত। কতদিন যে এভাবে কেটেছে ভাবতেই পারি না। মা-বাবা, ভাইদের হারিয়ে আমরা যেন হয়ে উঠি পরস্পরের অভিভাবক মানসিক প্রশান্তি খোঁজার একান্ত আশ্রয়। লেখাপড়া বন্ধ, এক অসহায় এতিম অবস্থায় দিন কাটে আমার। হাসু আপা না থাকলে আমার পক্ষে বেঁচে থাকাই খুব কষ্ট হতো। হাসু আপাই আমাকে বাবা আর মায়ের মতো স্নেহ-ভালোবাসা আর মমত্ব দিয়ে এখনো জড়িয়ে রেখেছে। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, হাসু আপা আমাদের কাছে একটা আদর্শ। আমাদের পারিবারিক একাত্মতা ছিল অত্যন্ত গভীর অনুভূতিসম্পন্ন। মা হাসু আপা আমাদের বাড়ির শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ ছিল। আব্বার রাজনীতি, ধ্যানধারণা আদর্শের প্রতি তাদের অগাধ আস্থা বিশ্বাস ছিল। হাসু আপা স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ত ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল। ১৫ আগস্টের পর অনেক সময় লেগেছে তার শক্ত হতে। আমি ১৯৭৬ সালে লন্ডন চলে যাই। ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে লন্ডনে আমার বিয়ের সময় হাসু আপা একটা টিকিটের জন্য যেতে পারেনি। এটা আমার জীবনের বড় একটা দুঃখ। মনে সান্ত্বনা নিলাম যে হাসু আপার বিয়ের সময় তো আব্বা ছিলেন না। আমার মায়ের বড় শখ ছিল আমার বিয়ে খুব ধুমধামের সঙ্গে দেবেন। দুর্ভাগ্য তারা কেউ তো থাকতে পারলেন না। আমার তিন সন্তানের জন্মের সময় হাসু আপা আমার কাছে থেকে মায়ের অভাব পূর্ণ করে দেয়। ১৯৯১ সালে আমার স্বামী যখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে সিঙ্গাপুরে হাসপাতালে ভর্তি হন, তখন হাসু আপা দলের কাজ ফেলে রেখে আমার কাছে ছুটে যায়। সেবা-যত্ন করে তাকে বাঁচিয়ে তোলে। আমার বাচ্চাদের পাশে থেকে সাহস জুগিয়ে মায়ের ভূমিকা পালন করে। ১৯৮০ সালে হাসু আপা একবার লন্ডন আসে। পঁচাত্তরের হত্যার বিচারের দাবি তোলে সভায় বক্তৃতা দেয়। ১৯৮১ সালে দিল্লিতে যখন হাসু আপার রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত হয় তখন আপাকে আমি সাহস জোগাই এবং জয় পুতুলের দায়িত্ব নিয়ে বলি, তুমি দেশের মানুষের স্বার্থে রাজনীতি করো আমি এদের দেখব। জয় পুতুলকে আমি সব সময় আমার তিন সন্তান ববি, টিউলিপ রূপন্তির সঙ্গে আমার পাঁচটি বাচ্চা হিসেবে বিবেচনা করে আসছি। হাসু আপা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে দেশে ফিরে আসে এবং প্রচণ্ড একটা জেদ নিয়ে রাজনীতি শুরু করে। তারপর তো অনেক সংগ্রাম-আন্দোলন, দুবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছে, মিথ্যা ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় প্রায় এক বছর কারাগারে বন্দি জীবন কাটিয়েছে। কখনো স্বস্তি শান্তিতে থাকতে পারেনি। কারাগারে নেয়ার পর নানা জনে নানা কথা বলত। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস ছিল, আল্লাহর ওপর ভরসা ছিল এবং দেশের মানুষের ওপর আস্থা ছিল যে আমরা সজ্ঞানে কোনো অন্যায় করিনি। ন্যায়বিচার পাব। হাসু আপা মাথা উঁচু করে সসম্মানে মুক্তি পাবে কথা বলে সবাইকে সান্ত্বনা দিতাম। পঁচাত্তরের ঘাতকের দৃষ্টি থেকে মুক্তি পায়নি। তার জন্য আশঙ্কা থাকে, দুশ্চিন্তা থাকে। কিন্তু তার সাহস কল্যাণকামী কাজের জন্য আমরা সব সময় সহযোগিতা কর থাকি। তার চেয়ে বয়সে আমি অনেক ছোট হলেও ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিই। হাসু আপা প্রধানমন্ত্রী হয়েছে শুধু আমাদের পিতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য। স্বপ্নটি হলো বাংলার মানুষ উন্নত জীবনের অধিকারী হবে। বিশ্বে বাঙালি বীরের জাতি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদার আসন পাবে। আমাদের সকলের বিশ্বাস স্বপ্ন একদিন নিশ্চয় সফল হবে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, হাসু আপার ওপর যে গুরুদায়িত্ব রয়েছে তা যেন সে জীবন দিয়ে হলেও বাস্তবায়ন করে যেতে পারে। দেশ মানুষের জন্য কাজ করার চেয়ে বড় কিছু প্রত্যাশা আমাদের মনে নেই। [পুনর্মুদ্রণ]

শেখ রেহানা: বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন