নিউরো-ইকোনমিকস: অর্থশাস্ত্রের নতুন ধারণা

মোতাহার হোসেন চৌধুরী

নিউরো-ইকোনমিকস বা স্নায়বিক অর্থনীতি নামে নতুন একটি বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে এখন। অর্থশাস্ত্রের প্রাবন্ধিক বিশ্লেষণে ও গবেষণায় ভিন্ন ধরনের এই তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ এর নিয়মিত কলামিস্ট Jason Zweig । আমেরিকান এই লেখক-সাংবাদিক তার ‘Your Money and Your Brain’ বইতে দেখিয়েছেন, মানুষের মস্তিষ্ক, স্নায়ুর ক্রিয়াকলাপ, ভাবাবেগ কীভাবে অর্থ রোজগার, বিনিয়োগসহ অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। 

এরূপ গবেষণার মতামত হচ্ছে— অর্থ আয়ের জন্য মরিয়া ও ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ মানুষের আর্থিক লোভ হিসাবে বিবেচিত হয় এবং এরূপ ক্ষেত্রে মানুষ প্রলুব্ধ হয়ে অযৌক্তিক ঝুঁকি নেয়। স্নায়ুবিজ্ঞানের বিশ্লেষণে এমন কার্যকলাপ আবেগীয় প্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে শেয়ার বাজারের উত্থান-পতনও এরূপ প্রবণতার অংশবিশেষ।

নিউরো-সাইকোলজি বলছে- অর্থপ্রাপ্তির অপ্রত্যাশিত ও নিত্যনতুন মোহ অনেকটা মাদকাসক্তির অনুরূপ। মাদকাসক্তি মানব মস্তিষ্কে স্নায়ুতন্ত্রের একটি বিশেষ অংশকে উত্তেজিত করে থাকে। মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের একই অংশ অর্থ রোজগারে অনৈতিক অংশগ্রহণেও প্রলুব্ধ করে। ঘোরলাগা চিন্তা বা ভাবাবেগ মানুষের মাথার সামনের অংশের স্নায়ুকে উত্তেজিত করে এবং মাথার পেছনের যুক্তিনির্ভর অংশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

মাদকের নেশা ও টাকা উপার্জনের নেশা স্নায়ুর এরূপ অংশের সঙ্গে সম্পৃক্ত অযৌক্তিক ও মন্দ আসক্তি। মাদকাসক্তদের আইন-কানুন-উপদেশ দ্বারা সংশোধন করা যায় না। এদের প্রচলিত চিকিৎসা বা নিরাময় হচ্ছে সংশোধনের লক্ষ্যে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।

মাদকে আক্রান্তরা প্ররোচিত করার মাধ্যমে অন্যকেও আসক্তিতে জড়িয়ে ফেলে। তেমনি অর্থ উপার্জনের নেশাও অপরকে একইভাবে সম্পৃক্ত করে। কোকেন বা অন্য যে কোনো নেশাগ্রস্তদের যেমন সংশোধনের লক্ষ্যে পুনর্বাসনের প্রয়োজন হয়,

অর্থপ্রাপ্তির আসক্তিতে আক্রান্তদের বেলায়ও তেমনটিই প্রয়োজন। সুপরামর্শ বা আইন দিয়ে তাদেরকেও সুস্থ করা যায় না।

এছাড়া আর্থিক খাতে বৈধপথে উপার্জনের পথ সংকুচিত হয়ে পড়লে অবৈধ পথ প্রশস্ত হয়। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় মন্দ পথের কারবারিরা ও বড় ধনীরা আরো বেপরোয়া হয়ে পড়ে মুনাফা অর্জনের নেশায়। এটাকে ‘Animal Spirit’ মানে জৈবিক প্রবৃত্তি বা পশুসম প্রবণতা হিসেবে অভিহিত করে গেছেন উনিশ শতকের অস্ট্রেলীয় বংশোদ্ভূত প্রখ্যাত রাজনৈতিক অর্থনীতির বিশ্লেষক জোসেফ অ্যালোইজ শুম্পিটার।

Jason Zweig-এর অর্থনীতির স্নায়বিক তত্ত্বের বিশ্লেষণের নিরিখে আমাদের ঋণখেলাপির অদমনযোগ্য নেশা, অর্থ লুটপাটের লাগামহীন নেশাও কি মস্তিষ্কের কারসাজি? স্নায়ুবৈকল্যের ব্যাপকতা বা একধরনের ব্যাধির বিস্তৃতি? যা

আইন-কানুন, উপদেশ পরামর্শে, সংস্কারে নিরাময় অযোগ্য! এরূপ ক্ষেত্রেও কি মাদকাসক্তি সংশোধনের অনুরূপ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা বা একই চিকিৎসার প্রয়োজন?

অর্থনীতিতে-দেশের উন্নয়ন ধারণায় জাতীয় বাজেট ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেশ মনোযোগ ও প্রাধিকার বহন করে চলেছে।

বাস্তবায়নের সক্ষমতা, অর্থসংস্থানের উৎস, ঘাটতি-সম্পূরক বাজেট, খাতওয়ারি বরাদ্দের যৌক্তিকতা বাজেটের এসব দিক নিয়ে মতানৈক্য আছে। এবারের করোনাকালে প্রদত্ত ও অনুমোদনকৃত জাতীয় বাজেট নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি কথা হয় বাজেটের আকারের প্রতিবছরের ক্রমবর্ধমান বিশালত্ব নিয়ে। করোনার বছরের এবারের বাজেট পেশের পর অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ ফেসবুকে মন্তব্য করেছিলেন-

“করোনা বা বাজেট এ দু’টোর কোনোটা নিয়েই বেশি চিন্তা করা ভালো না, শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তি কমে।”

সম্প্রতি প্রকাশিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির গাণিতিক হিসাব নিয়ে এবার অনেক কথা হচ্ছে। করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রকাশিত হিসাবের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই সন্দিহান অনেকে। প্রশ্ন উঠেছে জিডিপির এসব সূচক কতটা অর্থনৈতিক বা কতটা রাজনৈতিক! এটাও বলা হচ্ছে, রাজনীতিবিদদের প্রিয় এই সূচক কি অনেকটা নিউরো সাইকোলজিক্যাল ইকোনোমির অংশ হয়ে যাচ্ছে কিনা! আর্থিক সঙ্গতি, উন্নয়ন, স্বস্তি ও সুখের মানদণ্ড ও সূচক নিয়ে এসময়ের অনেক অর্থনীতিবিদ ও পরিসংখ্যানের স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলো ভিন্ন মত দিচ্ছেন। বলছেন- জিডিপি উন্নয়নের মাপকাঠি নয়।

বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশান ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধিই উন্নয়নের মাপকাঠি’- এ তত্ত্ব ভুল ও অচল ধারণা বলে এখন দাবি করা হচ্ছে। এডিবি সম্প্রতি জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন দিয়েছে, বাংলাদেশের জন্য সেটি সাধারণভাবে মনে হবে স্বস্তির, ৩০ দেশের তালিকায় ৪ নম্বরে। কিন্তু দেশের মানুষের সুখের যে চিত্র দিয়েছে সেটি উদ্বেগের, ভালো থেকে মন্দের ক্রমিকে ৩০টি দেশের মধ্যে ২৬তম।

তাহলে করোনাকালের বাজেট, প্রকাশিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন ধারণা কি দেশের প্রকৃত পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়!

দেশে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না, অর্থ উপার্জনের অনৈতিক পথ বন্ধ হচ্ছে না, লুটপাটমুখী অর্থ ব্যবস্থার বাজার অর্থনীতি শক্ত অবস্থান গড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে এরই মধ্যে।

বাজেটের আকার বিশালতা পায় বছর বছর নানা প্রশ্নের সুরাহা ব্যতিরেকে। উন্নয়ন ধারণার প্রচলিত কার্যক্রম দেশের মানুষের আর্থিক অবস্থা,স্বস্তি, সুখ ও সামাজিক নিরাপত্তার বিরাজমান পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। দেশের বেশিরভাগ মানুষের বিবর্ণ, মলিন, ভাবলেশহীন চেহারার মিছিল কি উন্নয়নের যথার্থতাকে সমর্থন করে?

জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাবও যদি গোলমেলে হয় বা আধুনিক অর্থনীতিবিদদের মতে জিডিপি উন্নয়নের মাপকাঠি না হয়! জনগণ তাহলে এসবকিছু নিয়ে চিন্তা বা আগ্রহ প্রকাশ না করাই কি ভালো?

এর মধ্যে করোনা অবশ্যই একটি স্বীকৃত বৈশ্বিক সমস্যা। কেউই বলছেন না, ভ্যাকসিন বা অন্য কোন পথে শিগগিরই এর সমাধান সম্ভব। তবু এখন আর করোনা মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে নেই। এটি নিয়ে অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি সুন্দর স্ট্যাটাস দিয়েছেন— ‘করোনা ভাইরাস নিয়ে আমাদের আগ্রহ আর তেমন নেই, কিন্তু আমাদের নিয়ে তার আগ্রহ কমেনি’।

আমাদের অর্থনীতির সংকটগুলো তত্ত্বীয়ভাবে একালের Jason Zweig-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী স্নায়ুতান্ত্রিক হতেও পারে! কিংবা উনিশ শতকের প্রথমার্ধের অর্থনীতিবিদ শুম্পিটারের দর্শনের ‘Animal Spirit’-এর অন্তর্ভুক্ত বলাও যেতে পারে!

তবু এদেশের ভুক্তভোগী কোটি কোটি মানুষ এসব জটিল তত্ত্বের প্রতি আগ্রহী না হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু নিরাময়ের ব্যবস্থা না হলে অর্থনীতির এতসব সংকটগুলো নিজেরাই কি মানুষের দুর্ভোগের কারণ হিসাবে আগ্রহের কেন্দ্রে শক্তিমত্তায় ক্রিয়াশীল থেকে যাবে না?

মোতাহার হোসেন চৌধুরী

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন