অভয়াশ্রমে ৮৪% বেড়েছে ইলিশের উৎপাদন

জেসমিন মলি

ভালো নীতির ভালো ফল

গত এক দশকে খাতভিত্তিক বেশ কিছু ভালো নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। এসব নীতির সুফল নিয়ে চার পর্বের ধারাবাহিকে প্রথম পর্ব

নদ-নদীর নাব্য হ্রাস, পরিবেশ বিপর্যয়, নির্বিচারে জাটকা নিধন মা মাছ আহরণের ফলে একটা সময় নদীতে আকাল দেখা দিয়েছিল ইলিশের। দ্রুত উৎপাদন কমে গিয়ে নিম্ন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল জাতীয় মাছটি। গত কয়েক বছরে সেই চিত্র অনেকটাই বদলেছে। নানামুখী উদ্যোগে আবারো নদীতে ফিরতে শুরু করেছে ইলিশের ঝাঁক। এক দশকে দেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৮৪ শতাংশ।

দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অনেকগুলো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নতুন নতুন অভয়াশ্রম গড়ে তোলার মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হচ্ছে ইলিশের বিচরণক্ষেত্রগুলো। মা ইলিশ সংরক্ষণ জাটকা নিধন বন্ধে নিয়মিত পরিচালিত হচ্ছে বিশেষ অভিযান। সে সঙ্গে মৎস্যজীবীদের মধ্যে বাড়ানো হচ্ছে সচেতনতা। ইলিশের প্রজনন মৌসুমে নদীতে জাল ফেলা বন্ধ রাখতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় তাদের দেয়া হচ্ছে চাল আর্থিক সহায়তা। আর এসবেরই সুফল মিলছে ইলিশ উৎপাদনে।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশে ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল দশমিক ৯০ লাখ টন। এর এক দশক পর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জাতীয় মাছটির উৎপাদন বেড়ে দশমিক ৩৩ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। শিগগিরই উৎপাদন সাড়ে পাঁচ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশে মোট উৎপাদিত মাছের ১২ দশমিক ১৫ শতাংশই আসে শুধু ইলিশ থেকে। আর মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ইলিশের অবদান শতাংশেরও বেশি।

মৎস্য প্রাণিসম্পদমন্ত্রী রেজাউল করিম বিষয়ে বলেন, গত ১১ বছরে বাড়তি প্রায় ৬৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। একই সঙ্গে চাষী মৎস্যজীবীদের আয়ও বেড়েছে। এছাড়া মা ইলিশ রক্ষা জাটকা নিধন রোধে কার্যকর কর্মসূচির আওতায় দরিদ্র জেলেদের খাদ্যসহায়তা দেয়া অব্যাহত রয়েছে। ফলে ইলিশের উৎপাদন এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০৯ সালের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশিতে।

ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে যে উদ্যোগটি সবচেয়ে বেশি কাজে দিয়েছে তা হলো অভয়াশ্রম গড়ে তোলা। ১৯৮৫ সালের দি প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিস রুলস সংশোধন করে ঘোষণা করা হয়েছে ইলিশের পঞ্চম ষষ্ঠ অভায়শ্রম। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ঘোষণা করা হয় ষষ্ঠ অভয়াশ্রম। ইলিশ রক্ষায় পর্যন্ত ঘোষিত ছয়টি অভয়াশ্রম হচ্ছেপটুয়াখালীর কলাপাড়ায় আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কিলোমিটার, চরইলিশার মদনপুর থেকে ভোলার চরপিয়াল পর্যন্ত মেঘনা নদীর ৯০ কিলোমিটার, ভোলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালীর চর রুস্তম পর্যন্ত তেঁতুলিয়া নদীর ১০০ কিলোমিটার, চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনা নদীর ১০০ কিলোমিটার শরীয়তপুরের নড়িয়া থেকে ভেদরগঞ্জ পর্যন্ত নিম্ন পদ্মার ২০ কিলোমিটার এলাকা। এছাড়া বরিশাল সদর উপজেলার কালাবদর নদীর হবিনগর পয়েন্ট থেকে মেহেন্দীগঞ্জের বামনীরচর পয়েন্ট পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার, মেহেন্দীগঞ্জের গজারিয়া নদীর হাটপয়েন্ট থেকে হিজলা লঞ্চঘাট পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার, হিজলার মেঘনার মৌলভীরহাট পয়েন্ট থেকে মেহেন্দীগঞ্জ সংলগ্ন মেঘনার দক্ষিণ-পশ্চিম জাঙ্গালিয়া পয়েন্ট পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার এলাকাও অভয়াশ্রমের আওতায় রয়েছে। এসব অভয়াশ্রমের সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন সম্মিলিতভাবে অভিযান কার্যক্রম পরিচালনাসহ জাটকা সংরক্ষণ, ইলিশের উৎপাদন আকার আশাতীত বৃদ্ধি পেয়েছে।

ইলিশের অভয়াশ্রম ঘোষণার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকায় জরিপ পরিচালনা, পানির গুণগতমান নির্ণয়সহ যাবতীয় প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো করে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক . ইয়াহিয়া মাহমুদ বণিক বার্তাকে বলেন, ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল অভয়াশ্রম ঘোষণা। অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোতে বিশেষ মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয়েছে। ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ সময়ে জেলেদের খাদ্যসহায়তা দেয়া হয়েছে। বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি করা হয়েছে। মা ইলিশ রক্ষা জাটকা নিধন বন্ধ করতে জেলেদের সঙ্গে নিয়ে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। এসবের ফলও মিলেছে। জেলেরা নিজেরা সচেতন হয়েছে, আবার একত্র হয়ে অন্যরা যাতে নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ আহরণ না করে সে বিষয়ে নজরদারিও রেখেছে। এছাড়া কারেন্ট জাল, বেহন্দি জাল পাওয়ামাত্রই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় জব্দ ধ্বংস করা হয়েছে। ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সবার প্রচেষ্টারই সম্মিলিত ফল মিলেছে।

জাটকা রক্ষায় নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত জাটকা আহরণ নিষিদ্ধকালে জেলেদের ভিজিএফ খাদ্যসহায়তা দেয়া হয়। এছাড়া জাটকা আহরণে বিরত অতিদরিদ্র জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান কার্যক্রমের জন্য উপকরণ সহায়তাও বিতরণ করা হয়েছে। নির্বিচারে জাটকা নিধন বন্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি নভেম্বর থেকে জুন মাস পর্যন্ত মৎস্য সংরক্ষণ আইন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মা ইলিশ রক্ষায় প্রধান প্রজনন মৌসুমে মোট ২২ দিন প্রজনন এলাকাসহ সমগ্র দেশব্যাপী ইলিশ আহরণ, বিপণন, পরিবহন মজুদ বন্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা হয়েছে। একই সঙ্গে আইন বাস্তবায়নের জন্য মাঠপর্যায়েও কাজ করা হয়েছে। প্রতি বছর জাটকা রক্ষায় সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টির লক্ষ্যে জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ উদযাপন করা হচ্ছে। এছাড়া জাটকাসহ অন্যান্য মৎস্যসম্পদ ধ্বংসকারী অবৈধ জাল নির্মূলে বিশেষ কম্বিং অপারেশন পরিচালনাও করা হয়।

ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকালে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ভোলার জেলে মসলেম উদ্দিন বলেন, প্রথম বুঝতাম না। মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও নৌকা জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। তবে কয়েকবার পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর মাছ নৌকা সব নিয়ে গেছে। এখন আর যায় না। এখন আগের থেকে অনেক বেশি ইলিশ ধরা পড়ে। নিজেরই ভালো লাগে। আয়ও বেড়েছে। তবে তাদের যে খাদ্যসহায়তা দেয়া হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। ছয়জন মানুষের সংসারে চাল দিয়ে চালানো খুবই কষ্ট। মাছ ধরা ছাড়া অন্য কাজও পারি না যে সময়ে অন্য কাজ করব। খাদ্যসহায়তার পরিমাণ বাড়ালে তার অনেক উপকার হতো বলে উল্লেখ করেন।

মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় জাটকা আহরণ নিষিদ্ধকালে ২০১৯-২০ অর্থবছরে চার মাসে ২০টি জেলার ৯৬ উপজেলার জাটকা আহরণে বিরত থাকা লাখ হাজার ২৮৮ জেলে পরিবারকে প্রতি মাসে ৪০ কেজি হারে মোট ৪৬ হাজার ৫৮০ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। গত ১০ বছরে কর্মসূচি বাস্তবায়নে লাখ ৫৫ হাজার ১৮২ টন খাদ্যসহায়তা বিভিন্ন জেলে পরিবারের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকালেও জেলে পরিবারগুলোকে খাদ্যসহায়তা বিতরণ অব্যাহত ছিল। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে ২০১৯ সালে ৩৫টি জেলার ১৪৭ উপজেলার লাখ হাজার ৩২৯ পরিবারে ২০ কেজি হারে মোট হাজার ১৬৬ টন ভিজিএফসহ খাদ্যসহায়তা দেয়া হয়েছে।

জাটকা আহরণ নিষিদ্ধ সময়ে জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিষয়ভিত্তিক কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদানসহ আয়-বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরের বাস্তবায়িত দুটি প্রকল্পের আওতায় ৫৩ হাজার ৩০৯ জন সুফলভোগীকে বিকল্প কর্মসংস্থান কার্যক্রমের জন্য উপকরণ সহায়তা বিতরণ করা হয়েছে। ২০ থেকে ২৫ লাখ লোক ইলিশ আহরণে সরাসরি জড়িত। কোটি ৫০ লাখ টাকার সংস্থান রেখে ইলিশ সংরক্ষণ উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে।

মৎস্য প্রাণিসম্পদমন্ত্রী রেজাউল করিম বলেন, গত ১১ বছরে বাড়তি প্রায় ৬৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। একই সঙ্গে চাষী মৎস্যজীবীদের আয়ও বেড়েছে। এছাড়া মা ইলিশ রক্ষা জাটকা নিধন রোধে কার্যকর কর্মসূচির আওতায় দরিদ্র জেলেদের খাদ্যসহায়তা দেয়া অব্যাহত রয়েছে। ফলে ইলিশের উৎপাদন এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০৯ সালের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশিতে।

ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের যে ১১টি দেশে ইলিশ উৎপাদন হয় তার মধ্যে শীর্ষে। বাংলাদেশ ইলিশের মিলেছে ভৌগোলিক নিবন্ধন (জিআই) সনদ প্রাপ্তিতে নিজস্ব পরিচয় নিয়ে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ইলিশ আজ সমাদৃত। পৃথিবীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ইলিশ উৎপাদনকারী বাংলাদেশ এখন থেকে বিশ্বে উপস্থাপিত হবে ইলিশের দেশ হিসেবে। বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশের ভৌগোলিক নিবন্ধনের ফলে পণ্যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য গুণগত মানসম্পন্ন ইলিশ বিপণনে দেশ-বিদেশে বাণিজ্যিক অন্যান্য সুবিধা পাওয়া যাবে বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন