বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষাঙ্গন

মুতাসিম বিল্লাহ

গল্পটা এক ‘খোকা’র; যাঁর শিক্ষা, শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সহপাঠী ও ছাত্রদের কল্যাণে ছাত্রাবস্থায় নিজেকে সঁপে দেয়ার ঘটনা, দেশ ও জাতি গঠনে নিজেকে তৈরি করেছিলেন হিতাকাঙ্ক্ষী শিক্ষানুরাগী, পরোপকারী মানুষের রোল মডেল। ঠিক ১০০ বছর আগে হয়েছিল তাঁর জন্ম। এই ভূখণ্ড তখন ‘বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেনি। সময়টি ছিল উত্তাল। দেশপ্রেম, স্বাজাত্যবোধ আর হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পাশাপাশি কংগ্রেস-মুসলিম লীগের বিভেদের রাজনীতিতে ক্ষত-বিক্ষত ছিল বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন। অবিভক্ত ভারতে একদিকে ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সশস্ত্র লড়াই, অন্যদিকে গান্ধীজি করছিলেন অহিংস আন্দোলন। এমনই মুহৃর্তে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ এই জনপদে সেই শিশুটির জন্ম হলো। এখনকার বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়, সে সময়কার গোপালগঞ্জ মহকুমায়, বর্তমানে এই জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবা শেখ লুত্ফর রহমান ও মা মোসাম্মত্ সাহারা খাতুন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তাঁর অবস্থান ছিল তৃতীয়। আর এই খোকাই বাংলাদেশের ইতিহাস বিনির্মাণের নায়ক তথা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি, মানুষের হৃদয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাব পাওয়া শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধুর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি তাঁর বাবা শেখ লুত্ফর রহমান ও মা সায়েরা খাতুনের তত্ত্বাবধানে। তাঁর ভাষায়, ‘আব্বার কাছ থেকেই আমি লেখাপড়া করি। আব্বার কাছেই আমি ঘুমাতাম। তাঁর গলা ধরে রাতে না ঘুমালে আমার ঘুম আসত না।’ শৈশবে আদরের খোকার জন্য বাবা তাঁর বাড়িতে রেখেছিলেন তিনজন শিক্ষক। ইসলাম ধর্ম শিক্ষার জন্য একজন মৌলভি সাহেব পড়াতেন আমপারা, দ্বিতীয়জন সাধারণ শিক্ষার পণ্ডিত সাখাওয়াত উল্লাহ পাটোয়ারী পড়াতেন বাংলা বর্ণমালা ও নামতা, তৃতীয়জন কাজী আবদুল হামিদ পড়াতেন কবিতা ও গল্প। 

১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সময়ে বঙ্গবন্ধু টুঙ্গিপাড়ার গিমাডাঙ্গা জি টি স্কুলে পড়েছেন তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও প্রাইমারি স্কুলের সেই শিক্ষক বেজেন্দ্রনাথ সূত্রধর ও সহপাঠী সৈয়দ নুরুল হক মানিককে ঢাকা আসার জন্য খবর পাঠান। তাঁরা এসেছেন শুনলে বঙ্গবন্ধু নিজেই ছুটে আসেন সব প্রটোকল ভেঙে এবং স্যারের পায়ে ধরে সালামের পর বুকে জড়িয়ে ধরেন। বঙ্গবন্ধু সে শিক্ষককে নিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী তথা তাঁর অফিসকক্ষে। তিনি শিক্ষককে নিয়ে নিজের চেয়ারে বসিয়ে উপস্থিত মন্ত্রী, এমপিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গর্বভরে বলেন, ‘আমার শিক্ষক’। 

গিমাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরে মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৩৪ সালে তিনি সপ্তম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ছোট সময়ে তিনি দুষ্টুমিতে মেতে থাকতেন, খেলাধুলা করতেন, গান গাইতেন, তবে হঠাত্ বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হয়ে হার্ট দুর্বল হয়ে গিয়েছিল তাঁর। ১৯৩৬ সালে আবার চক্ষু খারাপ হয়ে পড়ে। গ্লুকোমা নামে একটা রোগ হয়। চোখের চিকিত্সার কারণে পড়ালেখা থেকে বিরতিতে যেতে হয় তাঁকে। চোখের সমস্যায় ১৯৩৬ সাল থেকে চশমাও পরতে হতো। এ সময়টায় পড়ালেখা-স্কুল না থাকায় বিকাল হলে সভায় যেতেন। তখন ছিল স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। ১৯৩৭ সালে আবার তিনি লেখাপড়া শুরু করেন, তবে এবার আর পুরনো গোপালগঞ্জ সরকারি পাইলট স্কুলে নয়; যেহেতু তাঁর সহপাঠীরা তাঁকে পেছনে ফেলে গেছেন, তাই গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি হন। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাজীবনে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে আদর্শের সঙ্গে সমন্বিত করে এগিয়ে গেছেন রাজনীতির পরিমণ্ডলে। তাঁর জীবন, কর্ম, চিন্তাচেতনা, দর্শন ও মানস গঠনে বিভিন্ন শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ও ভূমিকা রয়েছে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেও বঙ্গবন্ধু নির্দ্বিধায় শিক্ষকদের কাছে টেনেছেন ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতায়, কুশলাদিও জেনেছেন। শৈশবের শিক্ষকদের মধ্য থেকে কাজী আবদুল হামিদ তাঁর জীবনে রেখাপাত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, “১৯৩৭ সালে আবার আমি লেখাপড়া শুরু করলাম। এবার আর পুরোনো স্কুলে পড়ব না, কারণ আমার সহপাঠীরা আমাকে পিছনে ফেলে গেছে। আমার আব্বা আমাকে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমার আব্বাও আবার গোপালগঞ্জ ফিরে এলেন। এই সময় আব্বা কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি মাস্টার সাহেবকে আমাকে পড়াবার জন্য বাসায় রাখলেন। তাঁর জন্য একটা আলাদা ঘরও করে দিলেন। গোপালগঞ্জের বাড়িটা আমার আব্বাই করেছিলেন। মাস্টার সাহেব গোপালগঞ্জে একটা ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন। যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্টিভিক্ষার চাল উঠাতেন সকল মুসলমান বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রবিবার আমরা বাড়ি বাড়ি থেকে চাল উঠিয়ে আনতাম এবং এই চাল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার ও অন্যান্য খরচ দিতেন। ঘুরে ঘুরে জায়গিরও ঠিক করে দিতেন। আমাকেই অনেক কাজ করতে হতো তাঁর সঙ্গে। হঠাত্ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। তখন আমি এই সেবা সমিতির ভার নেই এবং অনেক দিন পরিচালনা করি। আর একজন মুসলমান মাস্টার সাহেবের কাছে টাকাপয়সা জমা রাখা হতো। তিনি সভাপতি ছিলেন আর আমি ছিলাম সম্পাদক।” বঙ্গবন্ধু এ সময়টায় ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতেন, রাজনীতির খেয়াল তত ছিল না। এ সময়ে তাঁর বাবা তাঁর জন্য আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত পত্রিকা রাখতেন। ছোটকাল থেকেই তিনি এ পত্রিকাগুলো পড়তেন। 


বঙ্গবন্ধুর আরেকজন প্রিয় শিক্ষক ছিলেন গিরিশ বাবু। বঙ্গবন্ধু ১৯৩৭ সালে যখন গোপালগঞ্জ খ্রিস্টান মিশনারি হাই স্কুলে ভর্তি হন, তখন ওই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন গিরিশ বাবু। তিনি ছিলেন রাশভারী ও গম্ভীর এবং সব ছাত্রের প্রিয়। কিশোর মুজিব ছিলেন সত্যবাদী ও অন্যায়ের প্রতিবাদকারী। গিরিশ বাবু ছাত্র মুজিবকে স্নেহ করতেন সাহসিকতা ও স্পষ্টবাদিতার জন্য। বঙ্গবন্ধুও শিক্ষক গিরিশ বাবুকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন রসরঞ্জন সেনগুপ্ত। তিনি আবার ইংরেজি বিষয়ে প্রাইভেটও পড়াতেন বঙ্গবন্ধুকে। ওই স্কুলের আরো একজনের নাম জানা যায় তাঁর আত্মজীবনীতে। তিনি হলেন মনোরঞ্জন বাবু, যিনি গণিতের শিক্ষক ছিলেন। গণিতে বঙ্গবন্ধুর ভয় ছিল। কারণ তিনি অংকে ভুল করে ফেলতেন।

১৯৩৮ সালে ছাত্রজীবনেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সাতদিন জেল খাটেন। ১৯৩৯ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল পরিদর্শনে এলে বঙ্গবন্ধু স্কুলের ছাদ দিয়ে পানি পড়ার অভিযোগ এবং স্কুলছাত্রদের পক্ষ থেকে তা সারানোর জন্য দাবি তুলে ধরেন। একই সঙ্গে তিনি স্কুলের জন্য একটি ছাত্রাবাসের দাবিও তুলে ধরেন। এ সময়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়, হোসেন সোহরাওয়ার্দী নোটবুক বের করে বঙ্গবন্ধুর নাম ও ঠিকানা লিখে নেন। এর কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধুকে চিঠি দিয়ে তাঁকে ধন্যবাদ জানান এবং কলকাতা গেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করার আমন্ত্রণ জানান। তিনিও তাঁর চিঠির উত্তর দিতেন। এভাবে মাঝে মাঝে চিঠিও দিতেন।

১৯৪০ সালে শেখ মুজিব নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন এবং এক বছরের জন্য বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিল নির্বাচিত হন। তাঁকে গোপালগঞ্জ মুসলিম ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত করা হয়। আস্তে আস্তে এ সময়ে বঙ্গবন্ধু রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করেন। তাঁর বাবা তাঁকে এ বিষয়ে বাধা দেননি, শুধু বলেছেন, ‘লেখাপড়ার দিকে নজর দেবে।’ স্কুলে বঙ্গবন্ধু ক্যাপ্টেন ছিলেন, খেলাধুলার দিকে তাঁর খুব ঝোঁক ছিল, তবে তাঁর বাবা তাঁকে এ সময়ে খুব বেশি খেলাধুলা করতে দিতে চাইতেন না; যেহেতু এ সময়ে তিনি হার্টের রোগী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু এ সময়ে তাঁর গোপালগঞ্জ মহকুমায় যারা ভালো খেলোয়াড় ছিলেন, এমন তরুণদের তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খোঁজ করে নিয়ে এসে ভর্তি করাতেন, বেতনও ফ্রি করে দিতেন। ১৯৪০ সালে গোপালগঞ্জ স্কুলে বক্তৃতা দিয়ে দ্বিতীয়বার গ্রেফতার হন। 

১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষার একদিন আগে তাঁর জ্বর ছিল ১০৪ ডিগ্রি, মামস হয়ে গলা ফুলে গেল। শুয়ে শুয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। যদিও প্রথম পরীক্ষার পর থেকে ধীরে ধীরে আরোগ্য লাভ করেন। যদিও বঙ্গবন্ধু ১৩ বছর বয়সেই বিয়ে করেছিলেন, তবে ১৯৪২ সালে বঙ্গবন্ধুর প্রথম ফুলশয্যা হয়। পরীক্ষা দিয়ে কলকাতায় পাড়ি জমান বঙ্গবন্ধু, সভা-সমাবেশ করতেন, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কাছে প্রায়ই যেতেন। তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য সুদূর মফস্বল থেকে এবার কলকাতায় গিয়ে বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখানে বিখ্যাত বেকার হোস্টেলে আবাসন গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু বেকার কলেজের যে কক্ষে থাকতেন, সেই কক্ষটি সংরক্ষণ করছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ইসলামিয়া কলেজই ছিল তখন বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। স্পষ্টবাদিতা, সাহস, ন্যায্যতা, নিষ্ঠা, মানবিকতা ও সাংগঠনিক নেতৃত্বের কারণে অতি অল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৪৩ সালে মন্বন্তরের সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ওই সময় দুর্ভিক্ষের অবস্থা, বেকার হোস্টেলের ছাত্রদের সহায়তা এবং কলেজের শিক্ষক সাইদুর রহমান, আইএইচ জুবেরী, নারায়ণ বাবুসহ অধ্যাপকদের সহমর্মিতা সম্পর্কে জানা যায়। এ সময়ে বঙ্গবন্ধু লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহযোগিতায় চালু হওয়া লঙ্গরখানাগুলোয় দিনে একবার করে খাবার দিতেন। দিনভর কাজ করতেন। ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ড. জুবেরীও বঙ্গবন্ধুকে খুব ভালোবাসতেন। মন্বন্তরের সময় অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে বঙ্গবন্ধু অসুস্থ হলে অধ্যক্ষ মাঝেমধ্যে খবর নিতেন। তাঁর ভাষায়, ‘শিক্ষকরা আমাকে সকলেই স্নেহ করতেন।’ বিএ পরীক্ষা দেয়ার সময় অধ্যক্ষ বঙ্গবন্ধুকে সহায়তা করেছিলেন, সে প্রসঙ্গে তাঁর আত্মজীবনী থেকে জানা যায়। লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ জানিয়েছেন, ‘স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার সময়ও অধ্যাপক সাইদুর রহমানের পায়ে হাত দিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে দেখেছি।’ 

কলকাতার শিক্ষাজীবনে তাঁর বাবা প্রতি মাসে যে অর্থ পাঠাতেন, তা দিয়ে নিজের ও তাঁর সহপাঠী শেখ শাহাদাত্ হোসেনের খরচ চলত। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষাজীবনেও বঙ্গবন্ধুর দরদি মনোভব প্রকাশ পায়। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাজীবন থেকে কাজের বিষয়ে ছিলেন অগ্রগামী, নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতেন, ভীষণভাবে পরিশ্রম করতে পারতেন, ছাত্রদের আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়াতেন। কোন ছাত্রের কী অসুবিধা হচ্ছে, কোন ছাত্র হোস্টেলে জায়গা পায় না, কার ফ্রি সিট দরকার, তাঁকে বললে তিনি প্রিন্সিপাল ড. জুবেরী সাহেবের কাছে হাজির হতেন। শিক্ষকদের কখনো অন্যায় আবদার করতেন না। তাই শিক্ষকরা তাঁর কথা শুনতেন। ছাত্ররাও তাঁকে ভালোবাসত। 

১৯৪৬ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইসলামিয়া কলেজ ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ সময়ই তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমের মতো নেতাদের সরাসরি সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শান্তি স্থাপনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বঙ্গবন্ধু অসম সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন। 

এ সময়ে দিনরাত রিলিফের কাজ করতে গিয়ে লেখাপড়া মোটেই হচ্ছিল না তাঁর। তখন তাঁর বাবা তাঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন, “বাবা, রাজনীতি করো আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ, এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখো, ‘Sincerity of purpose and honesty of purpose’ থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না।” এটি তিনি সবসময় মনে রাখতেন। 

ইসলামিয়া কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নারায়ণ বাবুর প্রশংসাও করেছেন বঙ্গবন্ধু। ইসলামিয়া কলেজে গরিব ছেলেদের সাহায্য করার জন্য একটা ফান্ড ছিল। তার দেখাশোনা করতেন বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নারায়ণ বাবু। ইসলামিয়া কলেজের সব ছাত্রই ছিল মুসলমান। একজন হিন্দু শিক্ষককে সবাই এ কাজের ভার দিত কেন— এ প্রশ্ন তুলে বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কারণ, তিনি সত্যিকারের একজন শিক্ষক ছিলেন। হিন্দুও না, মুসলমানও না। যে টাকা ছাত্রদের কাছ থেকে উঠত এবং সরকার যা দিত, তা ছাড়াও তিনি অনেক দানশীল হিন্দু-মুসলমানদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে জমা করতেন এবং ছাত্রদের সাহায্য করতেন। এই রকম সহানুভূতিপরায়ণ শিক্ষক আমার চোখে খুব কমই পড়েছে।’ 

১৯৪৭ সালে তিনি বিএ পাস করেন। বিএ পরীক্ষার সময় তাঁর সহধর্মিণী তাঁর কাছে চলে এলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, তাঁর ধারণা ছিল ‘পরীক্ষার সময় সে আমার কাছে থাকলে আমি নিশ্চয়ই পাস করব। বিএ পরীক্ষা দিয়ে পাস করলাম। শেখ শাহাদাত হোসেন দুই মাসের ছুটি নিয়ে আমাকে পড়তে সাহায্য করেছিল। পরে জীবনে অনেক ক্ষতি আমার সে করেছে। এর জন্য তাকে কোনো দিনই কিছু বলি নাই। ওর বাড়ি আমার বাড়ির কাছাকাছি।’

বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে ভারতবর্ষের একটা ম্যাপ রাখতেন। আর হাবীবুলআহ বাহার সাহেবের ‘পাকিস্তান’ বইটা এবং মুজিবুর রহমান খাঁ সাহেবও ‘পাকিস্তান’ নামে একটা বিস্তৃত বই লিখেছিলেন সেটা—এই দুটো বই তাঁর প্রায় মুখস্থ ছিল। আজাদের কাটিংও থাকত তাঁর ব্যাগে। তাঁর জানা ছিল সিপাহি বিদ্রোহ ও ওহাবি আন্দোলনের ইতিহাস, কেমন করে ব্রিটিশরাজ মুসলমানদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল, কী করে রাতারাতি মুসলমানদের সর্বস্বান্ত করে হিন্দুদের সাহায্য করেছিল, মুসলমানরা ব্যবসা-বাণিজ্য, জমিদারি, সিপাহির চাকরি থেকে কীভাবে বিতাড়িত হলো, ইংরেজরা মুসলমানদের স্থান হিন্দুদের দ্বারা পূরণ করতে শুরু করেছিল কেন, ওহাবি আন্দোলন কী করে শুরু করেছিল হাজার হাজার বাঙালি মুজাহিদ। তিতুমীরের জিহাদ, হাজী শরীয়তুল্লাহর ফরায়জি আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করেই তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাস বলতেন। ভীষণভাবে হিন্দু বেনিয়া ও জমিদারদের আক্রমণ করতেন। হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে ইংরেজকে তোষামোদ করে অনেকটা উন্নততর দিকে অগ্রসর হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ছিল সব নিঃস্বার্থ স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ত্যাগী পুরুষ ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমানদের মিলনের চেষ্টা করলে এবং মুসলমানদের ওপর যে অত্যাচার ও জুলুম হিন্দু জমিদার ও বেনিয়ারা করেছিল, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে তিক্ততা এত বাড়ত না। এমনটিই উল্লেখ আছে তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে। 

উপমহাদেশের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয় কৈশোর, যৌবনেই ভ্রমণ করেছেন—দিল্লির লালকেল্লা, কুতুবমিনার, জামে মসজিদ, আজমির শরিফ, তাজমহল। ছাত্ররাজনীতিতে থাকাকালীন করেছেন পার্টটাইম জবও। ইত্তেহাদ কাগজের পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ছিলেন। মাসে ৩০০ টাকা পেতেন। তাঁর কাজ ছিল এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে টাকাপয়সা আদায় করা; ইত্তেহাদ কাগজ যাতে চলে এবং নতুন এজেন্ট বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ করা যায়, সেটা দেখা।

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্তির পর তিনি পূর্ব বাংলায় চলে আসেন এবং ঢাকাকে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেন। বাবার ইচ্ছে পূরণে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিছু সময় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকেন। নেতৃত্ব দিতেন ছাত্রলীগের। ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ গঠন করেন ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি, ফজলুল হক মুসলিম হলের অ্যাসেম্বলি থেকে। ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। একই বছর ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ ঘোষণা করা হয়। 

১৯৪৯ সালের ৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুসহ কয়েকজন ছাত্রনেতাকে জরিমানা ও বহিষ্কার করে। কিন্তু এ অন্যায় আদেশ পালনে তিনি অস্বীকৃতি জানান। বহিষ্কৃত হওয়ার পর তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৫২ সালের শেষ পর্যন্ত পালাক্রমে বন্দিজীবন কাটান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হলেও তিনি দেশের প্রয়োজনে অন্যায়ের প্রতিবাদে নিজের শিক্ষাজীবন নিয়ে ভাবেননি। তবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তাঁর ছিল প্রবল দুর্বলতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো আন্দোলনে তিনি সমর্থন দেন। ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সব আন্দোলনে তিনি অনুপ্রেরণা দেন। ১৯৭১ সালের ২ ও ৩ মার্চ ছাত্রসমাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে যে শপথ নেয়, তাতে বঙ্গবন্ধু পূর্ণ সমর্থন জানান। বাংলার মানুষদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে, ক্ষুধা-দারিদ্র্য থেকে মুক্তি, শোষিত-বঞ্চিত মানুষকে শোষণের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে উন্নত জীবন দিতে চেয়েছেন।

১৯৭২ সালের মার্চে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের (ডাকসু) আমন্ত্রণে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। ঢাকসু আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে ডাকসুর জীবন সদস্যপদ দেয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ ঘোষণার সিদ্ধান্তও ছিল। কিন্তু ঘাতকের বুলেটের আঘাতে নিহত হওয়ায় তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া আর হয়নি। 

১০০ বছর আগে যে জনপদ ছিল পিছিয়ে থাকা, পরাধীন, সেই জনপদের মানুষকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন একজন দীর্ঘকায় বাঙালি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন