আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যকর অংশগ্রহণে এসডিজি অর্জন সম্ভব

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনাকালে নানা সমস্যার মধ্যেই আমাদের এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ করার সুয়োগ রয়েছে। এতে করে দেশের সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বাড়বে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকরভাগে অংশগ্রহণ করলে এসডিসির লক্ষ্যপূরণ সম্ভব।

এসডিজি অর্জনে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিতশীর্ষক এক অনলাইন বৈঠকে গতকাল বক্তাদের আলোচনায় এসব কথা উঠে আসে। বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশন (বিএলএফসিএ বণিক বার্তা যৌথভাবে বৈঠকটি আয়োজন করে। এতে বক্তব্য রাখেন পিকেএসএফের চেয়ারম্যান স্বাধীনতা একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, আইপিডিসি ফিন্যান্সের চেয়ারম্যান সাবেক মুখ্য সচিব মো. আব্দুল করিম, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাজার বিভাগের নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) অধ্যাপক পরিচালক (প্রশিক্ষণ) শাহ মো. আহসান হাবীব প্রমুখ।

বৈঠকে সবাইকে ‌স্বাগত জা‌নি‌য়ে বক্তব্য রাখেন ব‌ণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হা‌নিফ মাহমুদ। সূচনা বক্তব্য রাখেন বিএলএফসিএ চেয়ারম্যান এবং আইপিডিসি ফিন্যান্স লিমিটেডের এমডি সিইও মমিনুল ইসলাম। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বিএলএফসিএর প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান এবং আইআইডিএফসির এমডি মো. গোলাম সরওয়ার ভুঁইয়া।

সূচনা বক্তব্যে আইপিডিসি ফিন্যান্স লিমিটেডের এমডি সিইও মমিনুল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে আমরা বিশেষ সংকটের মধ্যে দিন পার করছি। সংক্রমণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছিল। এখন কিছুটা চালু হলেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে অনেক সময় লাগবে। অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। সামনের দিনেগুলোয় আরো বন্ধের শঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে অনেকে চাকরি হারিয়েছে। অনেকেই চাকরি হারানোর শঙ্কায় রয়েছে, যে কারণে সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে। পরিস্থিতিতে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন আরো বেশি কঠিন হয়ে পড়বে। তাই এখন থেকেই আমরা যে খাতেই কাজ করি না কেন এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আগের থেকে বেশি মনোযোগী হতে হবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ৩৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৬৮ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ রয়েছে। এর ৪৫ শতাংশই দীর্ঘমেয়াদি ঋণে দেয়া রয়েছে, যার প্রভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। একই সঙ্গে এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলোয় ব্যাংক খাত থেকে ব্যাংকবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ বেশি। তবুও বলতে চাই, এসব প্রতিষ্ঠান যেসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে, তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় চেয়ে অনেক কম।

বিআইবিএমের অধ্যাপক পরিচালক (প্রশিক্ষণ) শাহ মো. আহসান হাবীব বলেন, এনবিএফআইগুলো যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সেটি ভালো। তবে মাঝেমধ্যে কিছু খারাপ সংবাদ আসে। যত ভালো কাজই করা হোক না কেন দুয়েকটি খারাপ সংবাদে সব অর্জন ম্লান হয়ে যায়। ধারণাগতভাবে আমরা এটা আশা করি যে ব্যাংক স্বল্প মধ্যমেয়াদে অর্থায়ন করবে। আর এনবিএফআইগুলো মধ্য থেকে দীর্ঘমেয়াদে অর্থায়ন করবে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে এনবিএফআইগুলোর সম্প্রসারণের বড় সুযোগ রয়েছে। টেকসই উন্নয়নের জন্য শুধু ব্যাংক দিয়ে হবে না, এনবিএফআইগুলোকেও প্রয়োজন। কভিড-১৯-এর সংকটের সময় ব্যাংক এনবিএফআইয়ের কাজ হচ্ছে নীতিনির্ধারকদের সমর্থন করা।

তিনি বলেন, গ্রিন ফিন্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে এনবিএফআইগুলোর কাজ করার ভালো সুযোগ রয়েছে। এমনকি তারা ব্যাংকের চেয়েও বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা কৃষি বাজার আকর্ষণীয় করতে পারিনি। এখনো সনাতন পদ্ধতিতেই এক্ষেত্রে লেনদেন হচ্ছে। আমরা একটি কমোডিটি মার্কেট গড়ে তুলতে পারিনি। অ্যাডভান্সড লেভেলের না হলেও অন্তত প্রাইমারি পর্যায়ের একটি কমোডিটি মার্কেট থাকা উচিত ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাজার বিভাগের নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করা এবং ইকোসিস্টেমে নেতিবাচক প্রভাব না ফেলার বিষয়গুলো মাথায় রেখে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বা এসডিজির লক্ষ্যপূরণে কাজ করা হচ্ছে। সরকারের অনেকগুলো দপ্তর লক্ষ্যপূরণে সম্পৃক্ত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে মিলে এসডিজির ২৯টি লক্ষ্যপূরণের উদ্যোগ প্রত্যক্ষভাবে এগিয়ে নিচ্ছে। ২০১১ সালে এসডিজির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পরিবেশ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণ করা হয়। এর অংশ হিসেবে ২০১৩ সালে সব ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে পরিবেশবান্ধব ব্যাংকিং নীতিমালার আওতায় আনা হয়, যা গ্রিন ব্যাংকিং নামে পরিচিতি পায়।

তিনি বলেন, গ্রিন ব্যাংকিং নীতিমালা এসডিজি লক্ষ্যপূরণে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। ২০১২ সালের মধ্যেই ৪০টি ব্যাংকে গ্রিন ব্যাংকিং ইউনিট স্থাপন হয়। ২৯টি ব্যাংক গ্রিন অফিস গাইডলাইন চালু করে। হাজার ৩১৫টি গ্রিন ব্যাংকিং সম্পর্কিত প্রকল্পে অর্থায়ন করা হয়। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হওয়া ত্রৈমাসিক হিসাবে দেশে কার্যরত ৫৯টি ব্যাংক হাজার ৩২৪ কোটি টাকা ৩৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ১৭১ কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে। গ্রিন ব্যাংকিং খাতে গত বছর ১১ হাজার ১০৩ কোটি টাকা অর্থায়ন হয়েছে। এতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশ ৬০৮ কোটি টাকা। এসব অর্থায়নে অনেক সীমাবদ্ধতা ঝুঁকি রয়েছে। এর পরও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা প্রশংসনীয়।

আইপিডিসি ফিন্যান্সের চেয়ারম্যান সাবেক মুখ্য সচিব মো. আব্দুল করিম বলেন, এসডিজি অর্জনের ব্যাপারে বাংলাদেশ ভালোই চলছিল। বিশেষ করে করোনার আঘাতের আগে। করোনা সারা বিশ্বকে যেমন আঘাত করেছে, বাংলাদেশকেও তেমন আঘাত করেছে। শুধু স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও। সেদিক থেকে বাংলাদেশও যথেষ্ট আঘাতপ্রাপ্ত।

তিনি বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এমনিতেই গত এক-দেড় বছরে কঠিন সময় পার করেছে। তারল্য সংকটসহ নানা সংকট ছিল। বিষয়টি নিয়ে অর্থমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করে আমরা আমাদের সমস্যার কথা বলেছি। এক্ষেত্রে অতি ক্ষুদ্র এবং ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের অর্থায়নগুলোকে বিবেচনায় নেয়া দরকার। ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান, যারা গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখে তাদের সমস্যাগুলোও বিবেচনায় নেয়া দরকার।

সময় অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়ন নিশ্চিত করা গেলে এসডিজির লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। আলোচনার শেষাংশে তিনি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায়আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাশীর্ষক একটি প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন।

পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক . কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ তার বক্তব্যে বলেন, প্রথমেই বলতে হয় অর্থায়ন করতে হবে, এর প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে কোথায়, কোন কারণে এবং কীভাবে অর্থায়ন করা হবে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। অনেক অর্থই ব্যয় হয়, কিন্তু এর সুফল পুরোপুরি পাওয়া যায় না। এসডিজির ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক, সামাজিক পরিবেশ তিনটি স্তম্ভ রয়েছে। কাজেই একে এভাবে বলা যায় সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক উন্নয়ন। অনেকেই গ্রিনের কথা বলছেন। বিষয়ে আমি কিছু বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। গ্রিনের চেয়ে আমাদের যে বিষয়টিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে, সেটি হলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের ওপর যে অভিঘাত এসেছে, সেটির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো বা অভিযোজন। সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করছে উন্নত উন্নয়নশীল দেশগুলো। এক্ষেত্রে আমাদের অবদান যৎসামান্য। তাই আমাদের অভিযোজনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব খোলা কিংবা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করলেই অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়ন নিশ্চিত হয় না। যখন কাউকে এমন পরিমাণ অর্থ দেয়া হবে, যেটি কাজে লাগিয়ে সে কিছু করে খেতে পারবে, সেটিই অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়ন। জিডিপির বিষয়ে আমরা অনেকদিন থেকেই বলছি, এতে প্রকৃত মূল্যায়ন হয় না। কারণ এটি গড়। এটা যতটা না বলে তার চেয়ে বেশি লুকিয়ে রাখে। কারণ এখানে তো বৈষম্যের বিষয়টি আসছে না। এসডিজির ১৭টি লক্ষ্য নিয়ে এসডিজি ইনডেক্স করার কাজ চলছে। এতে অর্থনীতি, পরিবেশ, বৈষম্যসহ সবকিছুই থাকবে। আমরা এটি বিবেচনা করতে পারি। নীল অর্থনীতির বিষয়ে বলা হয়েছে। আসলে আমরা বিষয়ে এখনো তেমন কোনো অগ্রগতি করতে পারিনি। বিষয়ে আমাদের গুরুত্ব দেয়া উচিত।

তিনি আরো বলেন, এসএমইর সংজ্ঞায় স্মল বলতে আমরা ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ আছে, এমন প্রতিষ্ঠানকে বুঝি। রকম এসএমই প্রতিষ্ঠান আছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার। এর বাইরে কিন্তু এক কোটি অতি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা কভিডের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।  সরকারের পক্ষ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে, সেটি অতি ক্ষুদ্র থেকে শুরু করে এসএমই সবার জন্যই। কিন্তু এসএমই প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগ থাকলেও অতি ক্ষুদ্রদের কিন্তু তা নেই। দেশে অতি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান রয়েছে এক কোটি। আর খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে আড়াই কোটি মানুষ। এদের পুনর্বাসন না করলে দারিদ্র্য কমিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর এদের কাছে পৌঁছতে হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমএফআই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে।

বিএলএফসিএর দ্বিতীয় ভাইস চেয়ারম্যান এবং ইসলামিক ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের (আইএফআইএল) এমডি সিইও আবু জাফর মো. সালেহ এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে পরিবেশবান্ধব ব্লু ইকোনমি সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোয় অর্থায়নের জন্য এনবিএফআইগুলোকে একটি তহবিল গঠনের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দেন।

ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বিএলএফসিএর প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান এবং আইআইডিএফসির এমডি সিইও মো. গোলাম সরওয়ার ভুঁইয়া বলেন, আমার প্রতিষ্ঠান ২০০৭ সাল থেকেই পরিবেশবান্ধব অর্থায়ন নিয়ে কাজ করছে। আজকের আলোচনার মাধ্যমে এনবিএফআইগুলোর ভাবমূর্তি আরো বাড়বে। একই সঙ্গে আলোচনা থেকে এনবিএফআইগুলো কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে তাদের পরিকল্পনাগুলো ঢেলে সাজাতে পারবে। এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ প্রয়োজন। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি তহবিলের প্রয়োজন হবে। পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি তহবিল সংগ্রহ করা সম্ভব নয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন