শ্রদ্ধাঞ্জলি

ওয়াহিদুল হক স্যার স্মরণে

আব্দুল বায়েস

গাণিতিক অর্থনীতির বিশ্বনন্দিত বাংলাদেশী প্রফেসর ওয়াহিদুল হকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি। পৃথিবীর বিখ্যাত বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন স্যার, তবে থিতু ছিলেন টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ওখানেই (ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন) তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৮৭ বছর।

আমি তার সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। বস্তুত এটা আমার দুর্ভাগ্য বলতে হবে। তিনি আমাদের বিভাগের শিক্ষক ছিলেন বলেও জানতাম না, তবে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় দেখি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে বসছেন। লক্ষ করতাম যে সুযোগ পেলেই আন্দোলনরত ছাত্রসমাজের কলা ভবনের সামনে অনুষ্ঠিত বটতলার সভায় পেছনে দাঁড়িয়ে নিবিড় মনে বক্তৃতা শুনছেন; ঠোঁটে লেগে থাকত একটার পর একটা রথম্যান সিগারেট। তখন তিনি আমাদের বিভাগের নিয়মিত শিক্ষক ছিলেন, নাকি অতিথি অধ্যাপক, বলতে পারব না।

যাই হোক, সেই সময়টায় পাকিস্তানের এই অংশ ছিল উত্তপ্ত। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ছয় দফা, গণতন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে পুরো ইস্টার্ন প্রভিন্স যেন জ্বলন্ত কড়াই; পশ্চিমা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ফুঁসছিল ছাত্র, শ্রমিক জনতা। বিশেষত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকদের অবস্থান ছিল লাস্ট নেইল অন দ্য কফিন অব পাকিস্তান।

এমন এক কঠিন সময়ে বিভাগীয় শিক্ষক হিসেবে আবির্ভাব ঘটল রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান, আজিজুর রহমান খান, ওয়াহিদুল হকসহ আরো কয়েকজন প্রতিভাবান ব্যক্তির। শুনেছি তারা আদ্যোপান্ত মার্ক্সিস্ট ছিলেন। অবশ্য তার কিছুটা টের পাওয়া যায় প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলে, যেখানে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ার প্রান্তিক আবহ সৃষ্টির প্রচেষ্টা ছিল এবং যেটি প্রণয়নে জড়িত ছিলেন আমাদের বাঘা বাঘা গুরু। রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান আর আজিজুর রহমান খানের সরাসরি ছাত্র ছিলাম স্মৃতি আজও আমাকে পুলকিত করে, গৌরবান্বিত করে। মনে হয়, এমন শিক্ষকদের ছাত্র হওয়া পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার; যা অন্তত বাংলাদেশে সবার ভাগ্যে জুটে বলে মনে হয় না।

ওয়াহিদুল হক স্যারের সঙ্গে ক্লাসে নয়, বাইরে কথা হতো। তার নামডাক শুনেছি, তাই ওই ক্রান্তিকালে দলবেঁধে তার কাছে যেতাম কিছু একটা শুনতে, তাও অর্থনীতি নয়, চলমান রাজনীতি পাকিস্তানের ভবিষ্যত্ নিয়ে। রথম্যান সিগারেট ধরাতে ধরাতে পাকিস্তান নামে দেশটির বিলুপ্তির পক্ষে ক্ষুরধার যুক্তি উপস্থাপন করতেন।

পর্যন্তই। মাঝে মাঝে তিনি ছুটি কাটাতে দেশে আসতেন। তখন তাকে দেখতাম, তবে দূর থেকেকখনো বিআইডিএসে, কখনো অর্থনীতি সমিতির সেমিনারে। খুব কাছাকাছি হলে সালাম ঠুকতাম, বিনিময়ে মিষ্টি একটা হাসি এবং কুশল জিজ্ঞাসা যেন আমি তার পরিচিত।

আশির দশকে তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলেন। মন্ত্রিত্বের শেষ দিকে আমার কলাবাগানের বাসায় একটা ফোনকল এসে রীতিমতো হইচই ফেলে দিল। মন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশে তার পিএস আমার বায়োডাটা চাইছেন। সবার কপালে চোখ! মনে বেশ খুঁতখুঁতানি নিয়ে আমার জীবনবৃত্তান্ত পাঠিয়ে দিলাম। পরে জানলাম, শিল্প সংরক্ষণের ওপর আমার লেখা একটা নিবন্ধ পড়ে তিনি খুব ইমপ্রেসড ছিলেন বিধায় তার আসছে এক প্রকল্পে আমাকে অন্তর্ভুক্ত করতে চান।

মন্ত্রিত্ব ছেড়ে কিছুদিনের ব্যবধানে তিনি কলাবাগানে এক আত্মীয়ের বাসায় উঠলেন। আমিও সেখানে থাকি। ভাবলাম, ফেস টু ফেস আলাপ করা দরকার। এক সন্ধ্যায় দেখা করতে গেলাম শুধু এইটুকু বলার জন্য যে ছাগল দিয়ে চাষ হয় না; অর্থাত্ আমার মতো অংকে দুর্বল একজনকে নিলে স্যার মহাবিপদে পড়বেন। আমার মনে আছে সেদিন প্রচণ্ড গরম ছিল, সঙ্গে লোডশেডিং। কলিংবেল বাজিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি স্যার খালি গায়ে, মোমবাতির আলোয় এবং কোলে একজন শিশু নিয়ে পায়চারী করছেন। একজন খাস বাঙালি। আমতা আমতা করে আমার দুর্বলতা তুলে ধরতেই স্যার আমাকে সহাস্যে আশ্বস্ত করলেন এভাবেঅংকই সব নয়; অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান; তুমি আমার টিমে কাজ করবে।

অবশ্য ওই প্রকল্প আর হয়ে ওঠেনি। তা নিয়ে কোনো আফসোস ছিল না; বরং আনন্দ লাগছিল এই ভেবে যে বিশ্ববিখ্যাত একজন প্রফেসর, তাও গাণিতিক অর্থনীতির, আমার প্রবন্ধ পড়ে প্রশংসা করেছেন।

প্রসঙ্গত একটা তথ্য না দিলেই নয়। এখন পর্যন্ত একই ব্যাচ থেকে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন মোট পাঁচজনআবুল মাল আব্দুল মুহিত (ইংরেজি), এম সায়েদুজ্জামান (পদার্থবিজ্ঞান); মে. জে. (অব) কে মুনিম (ইঞ্জিনিয়ারিং), এম সাইফুর রহমান (হিসাববিজ্ঞান) এবং ওয়াহিদুল হক (পরিসংখ্যান অর্থনীতি) তারা সবাই অলথ্রো প্রচণ্ড মেধাবী ছিলেন। শুনেছি ওয়াহিদুল হক ছাত্রাবস্থায়ই টেকস্ট বইতে ভুল ধরে আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিতি পান।

যারা মারা গেছেন, তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করি। আর জীবিতদের জন্য সুস্বাস্থ্য দীর্ঘ জীবন প্রার্থনা করছি।

আব্দুল বায়েস: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অর্থনীতির অধ্যাপক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন