করোনার বড় ধাক্কা ব্যাংকের মুনাফায়

হাছান আদনান

কভিড-১৯ মহামারীর আঘাতে বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। স্থবিরতা বিরাজ করছে সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে, যার প্রভাব পড়েছে ব্যাংকগুলোর ওপর। ঋণ বিতরণ যেমন প্রায় বন্ধ, আদায়ও শূন্য। পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা কমবে, এটা অনুমিতই ছিল। কিন্তু জুন শেষে দেখা যাচ্ছে, ধারণার চেয়েও বড় ধস নেমেছে পরিচালন মুনাফায়। দেশের প্রায় সবকটি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কমেছে, বেশির ভাগ ব্যাংকেরই  মুনাফা  কমেছে ২৫ শতাংশের বেশি।

ব্যাংকাররা বলছেন, প্রথম তিন মাসে ব্যাংকগুলো যে মুনাফা করেছে, তার চার ভাগের এক ভাগ মুনাফাও শেষের তিন মাসে হয়নি। ঋণের কিস্তি আদায় প্রায় বন্ধ। বন্ধ গ্রাহকদের খেলাপি করার পথও। ফলে ব্যবসা সচল, সামর্থ্য আছেএমন গ্রাহকরাও ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করছেন না। আবার এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার শতাংশে নামিয়ে আনতে হয়েছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকের মুনাফার ওপর আঘাত বড় হয়েই দেখা দিয়েছে। জীবনযাত্রা কবে স্বাভাবিক হবে, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আসবেতাও অনিশ্চিত। পরিস্থিতিতে বছর শেষে ব্যাংকের মুনাফা কোথায় গিয়ে ঠেকে, তা নিয়েই শঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর একটি সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেড। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ব্যাংকটি পরিচালন মুনাফা করেছে ৩৪২ কোটি টাকা। যদিও গত বছর একই সময়ে সাইথইস্ট ব্যাংক ৫০৬ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছিল। হিসেবে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা কমেছে ৩২ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ছিল ২২৭ কোটি টাকা। মুনাফার অংক গত বছরের প্রথম প্রান্তিকের চেয়েও বেশি। পরিসংখ্যানই বলছে গত তিন মাসে ব্যাংকটির মুনাফা ধসে গেছে।

পরিচালন মুনাফার চিত্রকে কীভাবে দেখছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কামাল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, সব ঋণের সুদহার শতাংশে নামিয়ে আনায় মুনাফা এক ধাক্কায় এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। তার মধ্যেই করোনার আঘাত। গত তিন মাসে ব্যাংকের অবস্থা কী হয়েছে, সেটি মুনাফার পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে। এখন ভবিষ্যতে কী হবে, সেটিই বড় চিন্তার। করোনা আক্রান্তের সংখ্যা মৃত্যু দিন দিন বাড়ছে। পরিস্থিতির শেষ আমাদের জানা নেই।

আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে যে মুনাফা থাকে, সেটিই কোনো ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা। পরিচালন মুনাফা কোনো ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। মুনাফা থেকে খেলাপি ঋণ অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ এবং সরকারকে কর পরিশোধ করতে হয়। প্রভিশন কর-পরবর্তী মুনাফাই হলো একটি ব্যাংকের প্রকৃত বা নিট মুনাফা। গত ৩০ জুন ব্যাংকগুলোর অর্ধবার্ষিকের আয়-ব্যয়ের হিসাব শেষ হয়েছে।

ব্যাংকগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, দেশের প্রায় সব ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে। বেসরকারি খাতের সামনের সারির ব্যাংক পূবালীর পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৪০৪ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে ব্যাংকটি ৫৪০ কোটি টাকা মুনাফায় ছিল। ২৪৩ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক। আগের বছরের একই সময়ে ব্যাংকটি ৩৩১ কোটি টাকা মুনাফায় ছিল। ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে ৩১০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছিল যমুনা ব্যাংক। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে তা ২৮০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। মুনাফা কমেছে এক্সিম ব্যাংকেরও। ব্যাংকটি বছরের প্রথম ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৩১৭ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে ৩৩০ কোটি টাকা মুনাফা ছিল এক্সিম ব্যাংকের। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ৩০ জুন পর্যন্ত পরিচালন মুনাফা করেছে ২৪৭ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে ৩২৬ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফায় ছিল ব্যাংকটি। হিসেবে ইসলামী ধারার ব্যাংকটির মুনাফা কমেছে ২৪ শতাংশ।

শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী মো. শহিদুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, অর্থনীতিতে করোনার আঘাত কতটা লেগেছে, তা ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় দেখা যাচ্ছে। কারণ ব্যাংক হলো অর্থনীতির হূিপণ্ড। অর্থনীতির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির বড় অংশ ব্যাংকের ওপর পড়ে। যার প্রতিফলন দেখা যায় ব্যাংকের মুনাফায়।

তিনি বলেন, চলতি বছরের প্রথম তিন মাস আমরা স্বাভাবিক ব্যাংকিং করেছি। ছয় মাসে যে মুনাফা দেখা যাচ্ছে, তার সিংহভাগ প্রথম তিন মাসে করা। দ্বিতীয় তিন মাসে আমরা শুধু বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছি। জানি না,  পরিস্থিতির শেষ কোথায়। ব্যাংকের বিনিয়োগ উঠে আসছে না। গ্রাহকরা বিনিয়োগের কিস্তি দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। সব বিনিয়োগের মুনাফার হারও শতাংশে নির্ধারিত। সব মিলিয়ে ব্যাংকারদের জন্য সামনের দিনগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে।

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ২৯০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে এনসিসি ব্যাংক। গত বছরের একই সময়ে ব্যাংকটির মুনাফা ছিল ৩৬২ কোটি টাকা। হিসেবে এনসিসি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কমেছে ২৪ শতাংশ। গত বছরের প্রথম ছয় মাসে মেঘনা ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ছিল ৪৫ কোটি টাকা, বছর মাত্র ১২ কোটি টাকায় নেমেছে। সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। আগের বছর একই সময়ে যা ছিল ৯০ কোটি।

দুর্যোগেও পরিচালন মুনাফা বাড়ার তথ্য দিয়েছে কয়েকটি ব্যাংক। তবে তথ্যের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। এনআরবিসি ব্যাংক বলছে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে তারা ৯০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। ২০১৯ সালের একই সময়ে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ৮৯ কোটি টাকা। ১২৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফার তথ্য দিয়েছে মধুমতি ব্যাংক। গত বছরের একই সময়ে ব্যাংকটি ৯৮ কোটি টাকা মুনাফায় ছিল।

রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক জানিয়েছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটি ১৩০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। গত বছরের একই সময়ে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল মাত্র ৭৫ কোটি টাকা।

নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতির আগেই দেশের ব্যাংকিং খাতে লেজেগোবরে পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল। ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ আর উত্কণ্ঠায় ছিল ব্যাংকগুলো। বিশৃঙ্খলা ছিল আমানত নিয়েও। পরিস্থিতিতেই ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দেয় সরকার। ক্রেডিট কার্ড ছাড়া কোনো ঋণের সুদ শতাংশের বেশি হবে না, এমন নির্দেশনা দুই বছর ধরে আলোচিত হলেও শেষ পর্যন্ত গত এপ্রিল থেকে বাস্তবায়ন হয়েছে। ব্যাংকগুলো কাগজে-কলমে ঋণের সুদ শতাংশে নামিয়েছে। যদিও সাধারণ গ্রাহকদের প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ না দেয়ার শত শত অভিযোগ উঠছে ব্যাংকের বিরুদ্ধে।

এরপর ঋণগ্রহীতাদের স্বস্তি দিতে জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলেও খেলাপি না করার নির্দেশনা দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার ফলে ঋণখেলাপি হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে গ্রাহকরাও ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধ করছে না। এছাড়া এপ্রিল মে দুই মাসের ঋণের সুদ আদায় স্থগিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সব মিলিয়ে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও চলতি বছর ব্যাংকের জন্য ভালো কিছু দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন