সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কভিড-১৯ বিষয়ক শীর্ষ উপদেষ্টা অ্যান্থনি ফউসি দেশে মহামারী মোকাবেলার ব্যর্থতার জন্য মার্কিনদের ‘বিজ্ঞানবিরোধী পক্ষপাতদুষ্টতা’কে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, এই পক্ষপাত ‘ধারণাতীত’। কারণ ‘বিজ্ঞান হচ্ছে সত্য’। এক্ষেত্রে ফউসি যারা মাস্ক ও সামাজিক দূরত্বের গুরুত্বকে অস্বীকার করেছে তাদের তুলনা করেছেন ‘অ্যান্টি ভ্যাকসার’দের (যেসব ব্যক্তি ভ্যাকসিনেশনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করে) সঙ্গে। যারা বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে।
ফউসির এমন বক্তব্য অবাক করা। করোনাভাইরাসের বিজ্ঞানে একজন দক্ষ ব্যক্তি হিসেবে তিনি, ‘বিজ্ঞানবিরোধী
পক্ষপাতদুষ্টতা’ বা বিজ্ঞানকে অস্বীকারের যে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান তাকে এড়িয়ে গেছেন।
আমেরিকানরা ক্রমবর্ধমানভাবে নিজেদের জগৎ তৈরি করে চলেছে। তথ্যগতভাবে নিজস্ব আদর্শিক সম্প্রদায় তাদের নিজেদের তথ্যজগৎ দখল করে আছে। রাজনৈতিক ব্লগস্ফিয়ারের কিছু অংশের মাঝে গ্লোবাল ওয়ার্মিংকে বাতিল করা হয় ধাপ্পাবাজি বলে। এটা এতটাই বাজে ব্যাপার যে প্রতিক্রিয়া অযোগ্য। অন্যান্য ভৌগোলিক ও অনলাইন কমিউনিটিগুলোর মধ্যে ভ্যাকসিন সুরক্ষার বিজ্ঞান, ফ্লুরিডেটেড পানীয় জল এবং জিনগতভাবে বিবর্তিত খাবারগুলোর বিষয় হয় বিকৃত নয়তো উপেক্ষিত। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ভিত্তিতে করোনাভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার মাঝেও বেশ পার্থক্য রয়েছে। যা আপাতদৃষ্টিতে সামাজিক দূরত্বের কার্যকারিতা অথবা কভিড-১৯-এ প্রকৃত মৃত্যুর হারের মতো বাস্তব বিষয়গুলোর প্রতি পক্ষপাতমূলক মতবিরোধের ভিত্তিতে তৈরি হয়।
তত্ত্বগতভাবে বাস্তব বিরোধগুলোর সমাধান করা তুলনামূলকভাবে সহজ: কেবল বর্তমানে উপস্থিত শক্তিশালী প্রমাণ কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠ শক্তিশালী বিশেষজ্ঞ মতামতকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করুন। এই প্রক্রিয়া বেশির ভাগ সময়েই সফলতা পেয়েছে।
কিন্তু এটা কাজ করে না যখন বৈজ্ঞানিক পরামর্শ এমন চিত্র তুলে ধরে, যা কিনা কারো সচেতন স্বার্থ বা আদর্শিক বিশ্বদর্শনকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। বাস্তবতা হচ্ছে একজনের রাজনৈতিক, ধর্মীয় অথবা জাতিগত পরিচয় অনেকটা কার্যকরভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করে রাজনৈতিক ইস্যুতে দেয়া বিশেষজ্ঞ মত সে গ্রহণ করবে কি করবে না সে সম্পর্কে।
অস্বীকৃতি সবসময় অজ্ঞতা থেকে আসে না
কোনো ঘটনার আন্তঃশৃঙ্খলাগত অধ্যয়ন একটা বিষয় পরিষ্কার করে: যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের সত্যতা সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রুপের স্বীকৃতি দানের ব্যর্থতাকে ওই বিষয়ে বৈজ্ঞানিক সম্মতির ব্যাপারে তথ্য ঘাটতির আলোকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। বিপরীতে অনেক বিতর্কিত বিষয়ে একজনের অস্বীকৃতি মূলত তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্ররোচিত হয়।
২০১৫ সালের একটি মেটাস্টাডি দেখায়, জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতার ওপর আদর্শিক মেরুকরণ উত্তরদাতাদের রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও এনার্জির পলিসির জ্ঞানকে বৃদ্ধি করে। কলেজপড়ুয়া একজন রক্ষণশীল ব্যক্তির জলবায়ুবিজ্ঞান অস্বীকারের সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
অবশ্য এই অস্বীকার করার বিষয়টি কেবল রক্ষণশীলদের সমস্যা না। গবেষণা বলছে, পারমাণবিক বর্জ্য নিরাপদে সংরক্ষণের সম্ভাবনা বা গোপনে বহনকারী বন্দুক আইনের প্রভাব নিয়ে বিশেষজ্ঞদের অনুমানভিত্তিক মতামত উদারপন্থীদের গ্রহণ করার সম্ভাবনা কম।
অস্বীকৃতি প্রাকৃতিক
মানুষের যৌক্তিক হওয়ার যোগ্যতা কিন্তু হাজার বছর ধরে মানিয়ে নেয়ার ফল। আমাদের পূর্বপুরুষরা বিকশিত হয়েছে ছোট ছোট দলে। একটি জাতিতে আত্মীকরণের জন্য সে জাতির আদর্শিক বিশ্বাসের পদ্ধতিকেও আত্মীকরণ করতে হবে। সেটি এখন বৈজ্ঞানিকও হতে পারে, আবার কুসংস্কারও হতে পারে। একটি গোষ্ঠী এবং তার বিশ্বদর্শনের প্রতি যে স্বভাবগত পক্ষপাতিত্ব তা গভীরভাবে মানব মনের সঙ্গে জড়িত।
একজন মানুষ তার গোষ্ঠীর অবস্থান ও বিশ্বাসের সঙ্গে অনেক গভীরভাবে সংযুক্ত থাকে। তাই এটা একেবারেই আশ্চর্যজনক নয় যে
লোকেরা তথ্যগুলোর প্রতি স্বয়ংক্রিয় ও রক্ষণাত্মকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, যা গোষ্ঠীর বিশ্বদর্শনকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। আমরা মূলত যৌক্তিকতা ও প্রমাণের নির্বাচিত মূল্যায়নের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখাই।
অযাচিত তথ্য আবার ভিন্ন উপায়ে হুমকি তৈরি করে। অর্থনৈতিক সংকট বা বাহ্যিক হুমকির মুখোমুখি হওয়া জনগণ, অনেক সময় কর্তৃত্ববাদী নেতাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আদর্শিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ পরিস্থিতিতে একজনের কুসংস্কার অন্যের বিশ্বাসকে প্রভাবিত করে। যতদিন একজন বিশ্বস্ত নেতা আপনাকে বলে যে কভিড-১৯-এর সংকট মূলত বাড়াবাড়ি। তবে বিপরীতে বৈজ্ঞানিক মতৈক্যের বাস্তবিক তথ্যকে ব্যক্তিগত আক্রমণ বলে মনে হতে পারে।
অস্বীকৃতি সব জায়গায় আছে
এ ধরনের প্রভাবিত, অনুপ্রেরণামূলক চিন্তা ব্যাখ্যা করে ঐতিহাসিক ঘটনা এবং বৈজ্ঞানিক মতৈক্যের প্রমাণবিরোধী চরম প্রত্যাখ্যানের বিস্তৃত উদহারণকে।
অর্থনৈতিক বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে ট্যাক্স কেটে রাখাকে কি নিজেদের জন্য খরচ করাকে বোঝায়? উচ্চসংখ্যক অভিবাসীদের ক্ষেত্রে কি সহিংস অপরাধের হারও বেশি? রাশিয়া কি ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছিল? আনুমানিক হিসেবে এ ধরনের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মত পক্ষপাতমূলক মিডিয়া দ্বারা পরিচালিত হয়, যদিও প্রমাণগুলো নিজেই স্বভাবগতভাবে পক্ষপাতদুষ্ট।
অস্বীকৃতিবাদী ফেনোমেনা অনেক ও বৈচিত্র্যময়। কিন্তু এর পেছনে যে গল্প তা খুব সাধারণ। মানবিক চেতনা তার অসচেতন আবেগী প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। সঠিক পরিস্থিতিতে দলগত পক্ষপাত, অস্তিত্ববাদী উদ্বেগ, স্থিতিশীলতার আকাঙ্ক্ষার মতো সর্বজনীন মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো বিষাক্ত এবং সিস্টেম জাস্টিফায়িং আইডিন্টিটি পলিটিক্সের সঙ্গে মিলিত হয়।
আমি খুবই অবাক হব যদি অ্যান্থনি ফউসি সত্যিকার অর্থেই কভিড-১৯ মোকাবেলার ক্ষেত্রে রাজনীতির উল্লেখযোগ্য প্রভাব সম্পর্কে কিংবা মাস্ক প্রত্যাখ্যানের পক্ষপাতিত্বে রিপাবলিকান স্টেট গভর্নমেন্টের দেয়া বক্তব্য কী ইঙ্গিত বহন করে, তা নিয়ে সচেতন না থাকেন। এছাড়া ট্রাম্পের শোভাযাত্রার বিষয়টিকেও উদাহরণ হিসেবে নেয়া যায়। কার্যকর বিজ্ঞান যোগাযোগ সমালোচনামূলকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পক্ষপাতমূলক বার্তার গভীর প্রভাব জনসাধারণের আচরণে থাকতে পারে। ভ্যাকসিনেশন, সম্পদ হ্রাস, পরিবেশ এবং কভিড-১৯ হচ্ছে জীবন-মরণ সমস্যা। এটাকে সফলভাবে মোকাবেলা করতে হলে আমাদের সচেতন থাকতে হবে বিজ্ঞানকে অস্বীকার করা নিয়ে বিজ্ঞান কী বলেছে সে সম্পর্কেও।
সায়েন্টিফিক আমেরিকান