কভিড-১৯

শিথিলতার শুরুতেই সর্বোচ্চ শনাক্তের রেকর্ড

নিজস্ব প্রতিবেদক

অর্থনীতির চাকা সচল করার লক্ষ্যে গত ২৬ এপ্রিল থেকে খুলে দেয়া হয় কারখানা। আর গতকাল থেকে সীমিত আকারে দোকানপাট-শপিং মলে কেনাকাটার সুযোগ পাচ্ছেন মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে গতকালই সর্বোচ্চ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে দেশে। একদিনে ৮৮৭ জন শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম রোগী শনাক্তের পর এটিই সর্বোচ্চ দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা। 

সংক্রমণের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশে কভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা আটশর ঘরে যেতে সময় লেগেছিল ৩৮ দিন। সংক্রমণের ৬৪তম দিনে এসে একদিনেই আক্রান্ত হলেন ৮৮৭ জন। গতকাল মৃত্যু হয়েছে আরো ১৪ জনের।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত অনলাইন বুলেটিনে দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন সংস্থাটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা। তিনি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের ৩৬টি ল্যাবে ৫ হাজার ৭৩৮টি নমুনা পরীক্ষা হয়। এতে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৮৮৭ জনের। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ১৪ হাজার ৬৫৭। এর আগে বাংলাদেশে একদিনে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা ঘটে গত ৬ মে। ওইদিন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৭৯০।

এটি মোটেও স্বস্তিদায়ক নয় বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ-সংক্রান্ত কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। অর্থনীতির স্থবিরতার বিপরীতে যে স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে, তার মূল্যায়ন বা পরিমাপ কে করেছে? এ সিদ্ধান্ত কার পরামর্শে নেয়া হয়েছে?

দোকান মালিক সমিতির প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, গতকাল ইসলামপুর, উর্দু রোড মৌলভীবাজার, নিউ সুপার মার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড, সেঞ্চুরি অর্কিডসহ কিছু কিছু মার্কেট খোলা হয়েছে। আবার বাটা, এপেক্সের মতো পাদুকাসহ পোশাক ও অনুষঙ্গ পণ্যের আড়ংয়ের খুচরা বিক্রয়কেন্দ্রগুলোও খুলতে শুরু করেছে। গত ২৬ এপ্রিল থেকে সচল হয়েছে শিল্প-কারখানা। গতকাল পর্যন্ত ছয় শিল্প এলাকার ৭ হাজার ৬০২ কারখানার মধ্যে খোলা ছিল ৩ হাজার ৮২৯টি। যার অধিকাংশই বস্ত্র ও পোশাক শিল্পের। 

জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, ২৪ ঘণ্টায় ৫ হাজার ৭৩৮টি নমুনা পরীক্ষায় ৮৮৭ জন কভিড-১৯ শনাক্ত হয়েছেন। যাদের মধ্যে চিকিৎসক, পুলিশ, ব্যাংকারসহ সাধারণ মানুষও আছেন। সংখ্যাটা বৃদ্ধির হারও অনেক বেশি। এ মুহূর্তে শনাক্ত ব্যক্তি কোন পেশার, বিষয়টি ভাবা অবান্তর। সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের প্রতিশ্রুতিতেই আমাদের খাতের কারখানাগুলো সচল করা হয়েছে।

গত ৪ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়, করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে দোকান ও শপিং মল ১০ মে থেকে খোলা রাখা যাবে। তবে দোকান ও শপিং মল বিকাল ৪টার মধ্যে বন্ধ করতে হবে।

চিঠিতে বলা হয়, কভিড-১৯ রোগের বিস্তার রোধ এবং পরিস্থিতির উন্নয়নের লক্ষ্যে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার ৭ থেকে ১৬ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি/জনসাধারণের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা/সীমিত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে শর্তাদি বিবেচনা করে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট, শপিং মলসহ অন্যান্য কার্যাবলি ১০ মে থেকে সীমিত আকারে খুলে দেয়ার ব্যবস্থার অনুরোধ জানানো হলো। তবে এক্ষেত্রে আন্তঃজেলা ও আন্তঃউপজেলা যোগাযোগ/চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। হাট-বাজার, ব্যবসাকেন্দ্র, দোকানপাট ও শপিং মলগুলো সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টার মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতিটি শপিং মলে প্রবেশের ক্ষেত্রে স্যানিটাইজার ব্যবহারসহ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ঘোষিত সতর্কতা গ্রহণ করতে হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। 

এতে আরো বলা হয়, আসন্ন ঈদের ছুটিতে জনগণকে নিজ নিজ স্থানে থাকতে হবে এবং আন্তঃজেলা-উপজেলা বাড়িতে যাওয়ার ভ্রমণ থেকে নিবৃত্ত করতে হবে। এসব শর্ত পালন সাপেক্ষে অধীন অফিস/অধিদপ্তর/বাহিনী/সংস্থাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে চিঠিতে অনুরোধ জানায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

এপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বণিক বার্তাকে বলেন, নমুনা সংগ্রহের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলাদেশে। আর প্রতিদিন পরীক্ষা করাটাও মারাত্মক জটিল হয়ে পড়েছে। এর মাধ্যমে সন্দেহভাজন আক্রান্তদের পরীক্ষার পাশাপাশি কভিড পজিটিভ কেস সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের পরীক্ষা ব্যবস্থাও অনেক দেশের মতোই কম। 

সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে আজ আমরা নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। সেখানে জীবন ও জীবিকা দুটোকেই বিবেচনায় নিয়ে একটা কৌশল তৈরি করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এ কৌশলে অবশ্যই মানুষের জীবন প্রাধান্য পাবে। যেখানে তথ্যের ভিত্তিতে সংক্রমণের হার আতঙ্কজনক, সেখানে কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশন; দরকার হলে আরো জোরদার করে লকডাউন পর্যন্ত, হয়তোবা যেতে হতে পারে। কিন্তু যেখানে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি রোধ করা সম্ভব, যেখানে মানুষের স্বাভাবিক চলাচল আবার চালু করা সম্ভব, সেটাও করতে হবে। দুটোর জন্যই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রশাসনিক সমন্বয় ও সুদৃঢ় ব্যবস্থাপনা। 

স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের কথা বলেছেন দোকান মালিক সমিতির সভাপতিও। সীমিত আকারে আজ থেকে মার্কেট খোলার ব্যবস্থা করেছি, জানান এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, একেবারে কাস্টমার আসছে না, সে কথা বলব না, মোটামুটি চলছে। এ মুহূর্তে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে টাকাও নেই, কারণ দুই মাস ধরে আমাদের দোকানপাট বন্ধ। আমরা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী, মার্কেট বন্ধ থাকলেও, বেতন পরিশোধের চেষ্টা করব।

গত ২৪ ঘণ্টায় আরো ১৪ জনের মৃত্যুর তথ্য দেন অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা। এটা একদিনে বাংলাদেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু। এর আগে গত ১৭ এপ্রিল একদিনে ১৫ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

গতকাল যাদের মৃত্যুর তথ্য জানানো হয়েছে, তাদের মধ্যে ১০ জন পুরুষ, চারজন নারী। পুরুষদের মধ্যে চল্লিশোর্ধ্ব চারজন। দুজনের বয়স ৫০ বছরের বেশি। ষাটোর্ধ্ব আছেন তিনজন। বাকি একজনের বয়স ৯০ বছরের বেশি। মৃত নারীদের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব দুজন। একজন ত্রিশোর্ধ্ব, আরেকজনের বয়স ৫০ বছরের বেশি। গতকাল পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যু হলো ২২৮ জনের। 

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ২ হাজার ৬৫০ জন সুস্থ হওয়ার খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ২২৬ জন। করোনাভাইরাসসহ বিভিন্ন রোগের তথ্য ও সংশ্লিষ্ট সেবা পেতে গত ২৪ ঘণ্টায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হটলাইনগুলোতে সব মিলিয়ে ১ লাখ ৩৫ হাজার ১৭৯টি ফোন এসেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন