‘করোনা’ দুর্যোগে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দায়বদ্ধতা

আশেক মাহমুদ

বিশ্বায়নের ঘূর্ণাবর্তে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বিশ্বকে এক মহাদুর্যোগের দিকে ঠেলে দেয়। এ পর্যন্ত এই মহামারীতে সারাবিশ্বেআক্রান্ত হয় সাড়ে ১৮ লাখ ও মৃত্যুবরণ করে এক লাখের অধিক (সূত্রঃ জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি)।  আর আক্রান্ত মোট ২০৮ দেশের মধ্যে বাংলাদেশও দুর্ভাগ্যক্রমে স্থান পায়। সরকারি তথ্য মতে, এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে আক্রান্ত হয়েছে ৮০৩ জন, মারা গেছে ৩৯ জন(সূত্রঃ আই ই ডিসি আর) (যদিও টেস্ট অপ্রতুলতায় আক্রান্ত ও মৃতের হার নিয়ে ধোঁয়াশা আছে)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে চিহ্নিত সংক্রমণের চারটি স্তরের মধ্যে আমরা এখন তৃতীয় স্তর বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন স্তরে আছি। চলতি এপ্রিল মাসই হল সবচেয়ে বিপদের সময়। এই সময়ে আমরা যদি সার্বিকভাবে সতর্ক না হই তাহলে আমাদের ভাগ্যে সংক্রমণের চতুর্থ পর্যায় বা মহামারী হয়ে বহু মানুষের মৃত্যু ধেয়ে আসবে। সেই জায়গা থেকে লক ডাউন কার্যকর করা এবং নিজ নিজ ঘরে বন্দি থাকা আবশ্যক হয়ে গেছে। এই চতুর্থ পর্যায়কে ঠেকানো হবে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

কেননা চীন, ইরান, ইতালী, ফ্রান্স, স্পেন, ইংল্যান্ড, আমেরিকার মত দেশগুলো চতুর্থ পর্যায়কে মোকাবেলা করতে পারেনি বলেই এসব দেশ ব্যাপক মহামারীর কবলে পড়ে যায়। দক্ষিন কোরিয়া, তাইওয়ান দক্ষতার সাথে চতুর্থ স্তরকে থামিয়ে দিতে পেরেছে। কিন্তু আমরা এখনো নিজের দেশের ব্যাপারে স্বস্তিতে নেই। কেননা, জানুয়ারীর শেষ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬ লাখ ৬৫ হাজার (শেষ দু'সপ্তাতেই পৌনে দু'লাখ প্রবাসী) প্রবাসী এদেশে প্রবেশ করেছে। কিন্তু পূর্ব প্রস্তুতির ঘাটতির কারণে এবং বিষয়টিকে প্রথমদিকে হালকাভাবে নেয়ার প্রেক্ষিতে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিণে প্রবাসীদের রাখা হয়নি। অল্প কিছু বাদে সবাইকে পাঠানো হয় হোম কোয়ারেন্টিনে, যা আমাদের দেশের বাস্তবতারসাথে খাপ খায়না। বর্তমানে অল্প কিছু সংখ্যক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকলেও বিপদটা বেশি, দুটো কারনে, এক. প্রায় সবাই নিজ নিজ বাড়িতে আছে যার অধিকাংশ খামখেয়ালীভাবে চলাফেরায় রত;দুই. প্রবাসীরা নিজ নিজ বাড়িতে ফেরার পরে সাধারণ সরকারী ছুটি ঘোষণা,এর ফলে শহরগুলোর মানুষ গ্রামে ভীড় করতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে কমিউনিটি সংক্রমণ এমনকি মহামারী আকার ধারণ করার আশংকা তীব্রতর হয়। এরপরে একটাই উপায় বাকী থাকে, সেটা হল লক ডাউন করা আর সামাজিক দূরত্ব (সোশাল ডিস্ট্যান্সিং) ও সামাজিক সুরক্ষা (সোশাল সেফটি) নিশ্চিত করা। এই দুটো বিষয় কার্যত কঠিন হয়ে পড়ে।

তাইওয়ান ও দক্ষিন কোরিয়ার পথ অনুসরণ করে এতোমধ্যে জার্মানি সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেছে। এর মূল কারন ট্রেস, টেস্ট এবং ট্রিট (শনাক্ত, পরীক্ষা এবং চিকিৎসা)-এই ‘তিন টি ‘ কৌশল রপ্ত ও বাস্তবায়ন।জার্মানি অন্য যে কোনো ইউরোপীয় দেশের তুলনায় বেশি পরিমাণ করোনাভাইরাস পরীক্ষা চালাচ্ছে; দেশটি সপ্তাহে ৩ থেকে ৫ লাখ মানুষের করোনা পরীক্ষা করছে; এর ফলে জার্মানিতে ৬৪ হাজারের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হলেও মৃতের হার ০.৭ শতাংশে ধরে রাখতে পেরেছে (যুগান্তর, ৩০ মার্চ ২০২০)। অথচ আমরা এসব দৃষ্টান্ত অনুসরণ না করে ইতালী,স্পেন, আমেরিকার পথেই হাঁটছি। নিউইয়র্কে যখন ক্যাভিড-১৯ এ মৃত্যুর হার বেড়ে চলছে তখনো ট্রাম্প এই শহরকে লকডাউন করেনি, তার খেসারত এবার আমেরিকাকেই দিতে হবে।

আমরাও যদি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গাকে কম গুরুত্ব দেই,আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে পারে ভয়াবহ বিপদ। আমরা কি ট্রেস, টেস্ট এবং ট্রিট এই তিনটি মডেল অনুসরণ করেছি? আমরা যখন লাখো লাখো প্রবাসীদের কোয়ারেন্টান পদ্ধতিতে রাখতে পারিনি তখনি ট্রেস পদ্ধতি দুর্বল করে ফেলেছি। আমরা সরকারী ও বেসরকারী কোনভাবেইযথাসময়ে যথেষ্ট কিটের ব্যবস্থা করতে পারিনি, এ কারণে আক্রান্ত শনাক্তকরণ চলছে এক আঁধার ধোঁয়াশার মধ্যে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, তাদের হাতে ৭২ হাজার টেস্ট কিটস রয়েছে এবং ইতোমধ্যে তারা ৯২ হাজার টেস্ট কিটস সংগ্রহ করেছে, যাদেশের জনগণের করোনা শনাক্তকরণের জন্য খুবই নগণ্য। জার্মানির জনসংখ্যা ৮ কোটি, সেখানে এক সপ্তাহে ৩ থেকে ৫ লাখ করোনা টেস্ট চলছে, অথচ তার দ্বিগুণের বেশি লোকসংখ্যার বাংলাদেশে এতো নগণ্য কিটস দিয়ে কিভাবে রোগী সনাক্তকরন হবে? এ ক্ষেত্রে আমরা যে বিলম্ব করছি তার পরিণতিতে কেভিড-১৯ মহামারী হয়ে গেলে আমরা দিশেহারা হয়ে যাবো।

বর্তমানে যে আংশিক লক ডাউন চলছে সেক্ষেত্রে লক ডাউনও দুর্বল হয়ে পড়ছে তিনটি কারনে- ১.খামখেয়ালীপনা ২.নিয়তিবাদী অন্ধ ভাবনা ৩. আয় রোজগার নিয়ে দুশ্চিন্তা। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত তাদের জমানো টাকা বা নির্ধারিত বেতন দিয়ে সংসার চালাতে পারলেও খেটে খাওয়া মানুষ, ভিক্ষুক, পরিযায়ী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা তিন বেলা খাবার জোটানোর দুশ্চিন্তায় অস্থির। ওদের করোনা নিয়ে যতটা ভয় তার চেয়ে বেশি ভয় ক্ষুধা নিবারণ নিয়ে। অন্যদিকে ওরাই যদি আয় রোজগারে নেমে পড়ে তাহলে সকলের ভয় করোনা সংক্রমণ নিয়ে। এই জটিলতার অবসান দুরূহ বলেই সরকার নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য আর্থিক সাহায্যের দিকে মনোযোগ দেয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জেলা প্রশাসন, এলাকার মেম্বার চেয়ারম্যানদের হাত ধরে অভাবী মানুষের কাছে সাহায্য পৌছানোর পদ্ধতি গ্রহন করেন, যদিও কিছু সেনা সদস্য আংশিকভাবে যুক্ত হয়। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষদের কাছে সেই সাহায্য পৌছেনা, নাম মাত্র অল্প কিছু লোকের কাছে ছাড়া। আর এটা চলছে চেপে বসা দুর্নীতির অভ্যাসগত চরিত্রের কারনে। আর কিছুদিন এভাবে চললে,অভাবী মানুষেরা হুড়হুড় করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলে আর বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে লুট করলে পরিস্থিতি সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে।

এসব দিকে বিবেচনা করে সরকারকে আরো অধিক দায়িত্বশীল হতে হবে এবংজনগণকে আসতে হবে সহযোগিতার ভুমিকায়। উন্নয়ন খাতের ব্যয় আপাতত বন্ধ করে টেস্ট ও ট্রিট ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্ধন দরকার। উচ্চমানের টেস্ট কিটসের সংগ্রহ বাড়িয়ে, প্রতি থানায় থানায় ল্যাব টেস্টের ব্যবস্থা করে, কয়েকটা করোনা হাসপাতাল বানিয়ে ও সকল ডাক্তার ও নার্সদের জন্য পিপিই সামগ্রীর ব্যবস্থা করে সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্ত করতে হবে। এর পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য এমনকি শ্রমিকদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা বাড়াতে হবে, সাথে সাথে সেই প্রণোদনা অভাবী ও নিম্ন আয়ের মানুষদের নিকট পৌছানো নিশ্চিত করতে হবে।বিনা মুল্যে ত্রাণ ও ১০ টাকা দরেও যে চাল বন্টন করা হচ্ছে সে উদ্যোগও বুমেরাং হতে পারে যদি তা বণ্টনের দায়িত্ব দেয়া হয় মেম্বার চেয়ারম্যান ও জেলা প্রশাসনকে। শত শত বস্তা সরকারী চাল সরাতে গিয়ে যখন লুটেরাদের একজন ধরা পড়ে তখনি মানুষ আস্থা রাখতে পারছেনা; কেননা অনেকেই ধরা পড়েনা, এই সত্য সবাই জানে। সে কারণে অভাবীদের অন্তত দুবেলা খাবারের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। আর যারা ত্রাণ লুটে নেয় তাদেরকে শুধু ধরলেই হবেনা, সাথে সাথে দ্রুত আইন ট্রাইব্যুনালে কঠিন শাস্তি দিতে হবে। যেভাবে লক ডাউনের বিস্তার হচ্ছে সেভাবে যদি অভাবী, খেটে খাওয়া মানুষ আর এই দুর্যোগে কর্মহীন হয়ে ঘরে যাপিত মানুষদের ঘরে ত্রাণ না আসে, তাহলে লক ডাউন ভেঙ্গে পড়বে; অভাবীরা করোনাকে উপেক্ষা করে খাবারের জন্য দলবেঁধে রাস্তায় নেমে পড়বে, তখন পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে যাবে। তাই, ওদের ঘরে গিয়ে নগদ টাকা দিতে হবে। এ কাজে দরকার বড় আকারের সরকারী প্রণোদনা আর সামাজিক উদ্যোগ।  সরকারী এই সাহায্য যদি সেনা ও নৌ বাহিনীর মাধ্যমে বণ্টন করা হয় তাতে সরকারী এই বরাদ্দের যথার্থ মূল্যায়ন হবে, এই আশা আমাদের সকলের। সাথে সাথে প্রতিটি এলাকায় সামাজিক ত্রাণ কমিটি বানানো যেতে পারে। এখানে এলাকার শিক্ষক, মসজিদ, মন্দিরের হুজুর ও পুরোহিত এবং সৎ সামাজিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে কমিটি করে সেখানে স্বচ্ছলদের দান করার সুযোগ দেয়া দরকার, দরকার বিতরণের সামাজিক উদ্যোগ।  

আসুন, এই দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা সরকারী, বেসরকারী ও জনতার উদ্যোগকে প্রানবন্ত করতে সাহায্য করি। সাময়িক 'সামাজিক' দূরত্ব, সামাজিক সুরক্ষা ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আমরা যেন করোনা দুর্যোগকে মোকাবিলা করতে পারি, এই আমাদের প্রত্যাশা।

আশেক মাহমুদ

সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

পি এইচ ডি গবেষণাধীন, ইউনিভার্সিটি অব মালায়া, মালয়েশিয়া 

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন