না, করোনা সম্পর্কে ‘কেউ কিছু বলতে পারে না।’ এর সংক্রমণের ব্যাপারে আমরা কিছু কিছু জানি, সবটা জানি না; এর প্রতিকার বিষয়ে কিছু জ্ঞান আমাদের আছে, তবে পুরোটা নয়। এ ঘাটতি শুধু সাধারণ মানুষের নয়, চিকিত্সক, গবেষক, বিশেষজ্ঞ সবারই প্রায় এক অবস্থা। তাই একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, একটা কথাই সত্যি—আসলে করোনার ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে কোনো বিশেষজ্ঞই বিশেষজ্ঞ নন। আমি বলি, আসলে আমরা সবাই ‘বিশেষভাবে অজ্ঞ’।
বর্তমানে সারা বিশ্ব যখন করোনা সামলাতে, সংক্রমণ রোধে ও মৃত্যু ঠেকাতে ব্যতিব্যস্ত, তখন নানান তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কোনো সময় নেই এবং এটা এ মুহূর্তে অগ্রাধিকারও পাবে না। কেউ এখন বলতে পারবে না, যারা সংক্রমিত, যারা হাসপাতালে চিকিত্সারত কিংবা যারা মৃত্যুমুখে পতিত, তারা সমাজের কোন জায়গা থেকে এসেছে, কোন আয়স্তরের মানুষ তারা, শিক্ষাগত অর্জন সেখানে কোনো তারতম্য করে কিনা ইত্যাদি। আগামীতে কোনো একদিন এসব প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত লভ্য হবে এবং তখন গবেষকদের কাজের মাধ্যমে করোনা সংকটের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটটি সঠিকভাবে বোঝা যাবে।
তবে নানা বিষয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও বর্তমান অবস্থায় করোনা সংকটের আর্থসামাজিক বিষয়ে তিনটি প্রবণতা সুস্পষ্ট। এক. যারা বিশেষ কতগুলো রোগ যেমন ক্যান্সার, হূদরোগ, প্রমেহ, হাঁপানি ইত্যাদি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, করোনা মৃত্যুর মূল শিকার তারা। দুই. পুরুষের চেয়ে নারীর এবং তরুণদের চেয়ে বৃদ্ধদের অনুপাত বেশি এবং তিন. জাতিগত বা বর্ণগত সংখ্যালঘুদের অনুপাত বেশি।
প্রথম প্রবণতা স্বব্যাখ্যাত। যেসব রোগের কথা বলা হয়েছে, তাতে যারা ভুগছে, সেসব জনগোষ্ঠীর যেকোনো জীবাণু প্রতিরোধক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম। সুতরাং স্বাভাবিকভাবে তারাই করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর মূল শিকার হয়েছে।
দ্বিতীয় প্রবণতা সম্পর্কে কিছুটা বলা প্রয়োজন। নারীর তুলনায় পুরুষরা করোনা মৃত্যুর মূল শিকার। চীনের ৩ হাজার ৫০০ করোনা মৃত্যুর মধ্যে ৬৪ শতাংশ পুরুষ, আর ৩৬ শতাংশ নারী। ব্রিটেনে এ পর্যন্ত করোনা মৃত্যুর ৭০ শতাংশ পুরুষ ও ৩০ শতাংশ নারী। অর্থাত্ পুরুষের মৃত্যুর হার নারীর দ্বিগুণ। এর কারণ বিবিধ। নারীর একটি জৈবিক শারীরিক সুঅবস্থা আছে, যার কারণে নারীর প্রত্যাশিত গড় আয়ু বেশি। সেই সঙ্গে ধূমপান ও অতিরিক্ত মদ্যপানের প্রকোপ পুরুষের মাঝে বেশি। সুস্বাস্থ্য অভ্যাস পুরুষের চেয়ে নারীর ভালো এবং হূদরোগ বা প্রমেহের মতো রোগের আপাতন পুরুষের চেয়ে নারীর মধ্যে কম। যেকোনো জীবাণু প্রতিরোধের ক্ষমতা বয়োবৃদ্ধদের কম তরুণদের চেয়ে। করোনাও তার ব্যত্যয় নয়। ফলে করোনা মৃত্যুহার বয়োবৃদ্ধদের চেয়ে বেশি।
তৃতীয় প্রবণতায় আসি। যুক্তরাষ্ট্রে দেখা গেছে যে প্রতি চারজন করোনা সংক্রমিত মানুষের একজন কৃষ্ণাঙ্গ। ব্রিটেনেও এ-জাতীয় প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। হয়তো আগামী সময়ে যখন অন্যান্য দেশের উপাত্ত লভ্য হবে, তখন দেখা যাবে যে সংখ্যালঘুরাই সংক্রমিত হয়েছিল বেশি এবং মৃত্যুর আপাতনও তাদের মাঝেই বেশি ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে উচ্চতর সংক্রমণের কারণ কিছু কাঠামোগত এবং কিছু প্রায়োগিক। কাঠামোগত দিক থেকে বিচার করলে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী ঐতিহাসিক দিক থেকেই দরিদ্র, বঞ্চিত ও অসমতার শিকার। তারা স্বল্পশিক্ষিত, তাদের পুষ্টির অভাব রয়েছে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান নিম্ন। ন্যূনতম সামাজিক সুবিধাও তাদের কাছে লভ্য নয়। সুতরাং কাঠামোগত দিক থেকে তারা যেকোনো সংকট-ভঙ্গুর।
সেই সঙ্গে প্রায়োগিক অনেক কারণও এর সঙ্গে যুক্ত। কৃষ্ণাঙ্গরা বেশির ভাগই কর্ম-মইয়ের নিচের দিকে অবস্থান করে। ফলে একদিকে যেমন তাদের সঞ্চয় কম, অন্যদিকে কাজের জন্য তাদের ঘরের বাইরে আসতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাদের জীবনযাত্রা প্রণালির প্রকৃতির কারণেও ঘরের মধ্যে সামাজিক জনদূরত্ব বজায় রাখা কষ্টকর। তারা যেসব অঞ্চলে বসবাস করে, সেখানে স্বাস্থ্য সুবিধা ও সেবাও সীমিত। এসব প্রায়োগিক কারণেও তাদের করোনা-ভঙ্গুরতা বেশি। সুতরাং কাঠামোগত ও প্রায়োগিক কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে করোনার আপাতন ও মৃত্যুর হার বেশি।
শেষের কথা বলি, সারা বিশ্বেই দেখা যাচ্ছে যে করোনা শিশুদের তেমন একটা স্পর্শ করছে না। কী আছে শিশুদের যে করোনা তাদের এড়িয়ে চলছে? এ মুহূর্তে এর কোনো উত্তর নেই। কোনো একদিন হয়তো এর ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। কিন্তু এ মুহূর্তে আমার একটি পরম তৃপ্তি সেখানেই যে আমাদের শিশুদের সংক্রমণ ও মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হচ্ছে না।
ড. সেলিম জাহান: নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয় ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের সাবেক পরিচালক