ক্যাপ্টেন মাজেদের মৃত্যুদণ্ড ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে কার্যকর হবে: পিপি

আদালত প্রতিবেদক

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদ (৭২) এর বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। আজ বুধবার বেলা দেড়টার দিকে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ হেলাল চৌধুরী এ পরোয়ানা জারির আদেশ দেন।

পরে ওই পরোয়ানা আদালত থেকে প্রস্তুত হওয়ার পর বেলা সাড়ে ৩টার দিকে কোতয়ালি থানার এসআই উজ্জল বিশ্বাস আদালতের সেরেস্তার কর্মচারী অমল কৃষ্ণ করকে নিয়ে লালসালু কাপরে আবৃত ওই মৃত্যু পরোয়ানা ঢাকার কেরানীগঞ্জস্থ কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে দেন।

আবদুল মাজেদের মৃত্যু পরোয়ানা জারি আদেশ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাকর্তৃপক্ষ পাওয়ার পর জেল কোডের বিধান অনুযায়ী ২১ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

এর আগে মঙ্গলবার ঢাকা সিএমএম আদালতে বঙ্গবন্ধু আত্মস্বীকৃত খুনিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়। কারাগারে পাঠানোর ওই আদেশ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারিক আদালত ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত বুধবার পায়। যা পাওয়ার পর আদালতটি করোনাভাইরাসজনিত কারণে ছুটিতে থাকায় বুধবারই এ বিষয়ে তারা হাইকোর্টের দিক নির্দেশনা চেয়ে পত্র প্রেরণ করেন।

হাইকোর্ট ওই পত্র পাওয়ার পর ঢাকার জেলা ও দায়রা জজের ছুটি প্রত্যাহার করে আসামি আবদুল মাজেদের বিরুদ্ধে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আদেশ দেন। ওই আদেশ আসার পর ঢাকা জেলার পাবলিক প্রসিকিউটর খোন্দকার আব্দুল মান্নান, মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু ও বঙ্গবন্ধু হত্যার মামলার প্রসিকিউটর মোশারফ হোসেন কাজল আসামি আবদুল মাজেদেকে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানোর আবেদনসহ তার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারির আবেদন করেন।

ওই আবেদনের উপর শুনানির পর প্রথমে আদালত আসামি আবদুল মাজেদেকে বুধবারই কারাগার থেকে আদালতে হাজির করার আদেশ দেন। আদেশ অনুযায়ী এদিন বেলা সোয়া ১টার দিকে আবদুল মাজেদেকে কারাগার থেকে কারাকর্তৃপক্ষ আদালতে হাজির করেন। এরপর তাকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখান আদালত। এরপর মৃত্যু পরোয়ানা জারির বিষয়ে প্রসিকিউটরা শুনানি করেন। শুনানির সময় বিচারক আসামি আবদুল মাজেদের বক্তব্যও শোনেন। এরপরই মৃত্যুর পরোয়ানা জারির আদেশ দিয়ে আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

আদালত মৃত্যু পরোয়ানা জারির আদেশ দেওয়ার পর প্রসিকিউটর কাজল সাংবাদিকদের জানান, আদালত আমাদের মৃত্যু পরোয়ানা জারির আবেদন মঞ্জুর করেছেন। এখন কারাকর্তৃপক্ষ জেল কোডের বিধান অনুযায়ী ২১ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

তিনি আরও বলেন, আদালত আদেশ দেওয়ার আগে আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সেখানে তিনি (আসামি) বলেছেন, তিনি পলাতক ছিলেন। ঘটনার দিন তিনি ক্যাপ্টেন খায়রুলের সঙ্গে ডিউটিতে ছিলেন। হত্যার পর পুরস্কার হিসেবে পরবর্তীতে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি হয়েছিলেন বলেও জানিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে আবদুল মাজেদ আরো জানিয়েছে, তিনি ১৯৯৬ সালে এ মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে তিনি পলাতক হন।

তবে আদালতের বুধবারের কার্যক্রম চলাকালে কোন সাংবাদিককে আদালত কক্ষে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি।

এর আগে গত ৬ এপ্রিল দিবাগত রাত ৩টা ৪৫ মিনিটের দিকে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার এ পলাতক আসামিকে গাবতলী বাস স্টান্ডের সামনে থেকে রিকশাযোগে যাওয়ারকালে আটক হয়। পরদিন মঙ্গলবার তাকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে ঢাকা সিএমএম আদালতে হাজির করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। সে অনুযাযী ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম এএম জুলফিকার হায়াত কারাগারে পাঠান। 

মাজেদ গ্রেফতার হওয়ার পর বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ও মৃত্যদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক রইলেন আরও ৫ জন। তারা হলেন, সাবেক সেনা কর্মকর্তা খন্দকার আবদুর রশীদ, শরিফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী ও এ এম রাশেদ চৌধুরী। এরা বিভিন্ন দেশে পলাতক অবস্থায় আছেন। তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তবে হত্যাকাণ্ডের বিচারে পদে পদে বাঁধা আসে। হত্যার পরপরই দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর দায়মুক্তি আইন বাতিল করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ওই বছরের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন।

১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। নিম্ন আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দ্বিধাবিভক্ত রায় প্রদান করেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মুত্যুদণ্ড বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেন। এরপর ১২ আসামির মধ্যে প্রথমে চারজন ও পরে এক আসামি আপিল করেন। কিন্তু এরপর ছয় বছর আপিল শুনানি না হওয়ায় আটকে যায় বিচার-প্রক্রিয়া।

দীর্ঘ ছয় বছর পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে আপিল বিভাগে একজন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটি আবার গতি পায়। ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. তোফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির লিভ টু আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। আপিলের অনুমতির প্রায় দুই বছর পর ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করেন। ফলে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে হাইকোর্টের দেওয়া ১২ খুনির মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল থাকে। এর মধ্য দিয়ে ১৩ বছর ধরে চলা এই মামলার বিচার-প্রক্রিয়া শেষ হয়।

২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মুহিউদ্দিন আহমেদে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ওই রায় কার্যকরের আগেই ২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যান আসামি আজিজ পাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন