নিরাপদ সবজি আবাদের চর্চা বাড়ছে দেশে

উত্তম কৃষিচর্চা অনুসরণে কৃষককে উৎসাহিত করুক কৃষি মন্ত্রণালয়

বিশ্বে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় হলেও এ খাতে রয়েছে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা। সবজি বিপণনে আধুনিক বাজারজাত ব্যবস্থা না থাকায় এবং বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা কার্যকর ব্যবহারের অভাবে ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না কৃষক। অন্যদিকে কৃষকের মজুদ অক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা কম দামে কিনে নিচ্ছেন কৃষিপণ্য। তার পরও বাংলাদেশে নিরাপদ সবজি আবাদের চর্চা বাড়ছে। খাদ্যনিরাপত্তার পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের গুরুত্ব এখন অনুভূত হচ্ছে সমানভাবেই। কৃষি খাতে প্রাযুক্তিক প্রগতির কল্যাণে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু এর পরও নিরাপদ খাদ্যের প্রাপ্যতাকে অনিশ্চিত করে তুলছে কীটনাশক ও রাসায়নিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে ভোক্তা থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক পর্যন্ত সব মহলকেই। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের দাবি এখন বাংলাদেশেও বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে। এখন পর্যন্ত পুষ্টিমানসম্পন্ন নিরাপদ সবজি উৎপাদন ও বিপণনে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও এর সিংহভাগই ছিল বেসরকারি পর্যায়ে। অন্যদিকে সরকারি পর্যায়ে এ নিয়ে ব্যাপক ও সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া হয়নি এতদিন। তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ও এখন এ উদ্যোগহীনতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এরই ধারাবাহিকতায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সারা দেশের সব উপজেলায় অন্তত একটি করে নিরাপদ সবজি গ্রাম গড়ে তোলার।

জাপানে আমাদের দেশের চেয়ে তিন গুণ বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সেখানকার কৃষকরা অত্যন্ত সচেতন। তারা সঠিক মাত্রায় সঠিক বালাইনাশক ব্যবহার করেন এবং অপেক্ষমাণ সময় অতিক্রমের পরই শাকসবজি উত্তোলন করে বাজারে বিক্রি করেন। ফলে ওইসব সবজি খেয়ে ভোক্তাদের কোনো অসুবিধা হয় না। আর আমাদের দেশে ঘটে তার উল্টো ঘটনা। কীটনাশক প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গেই সবজি তুলে বিক্রি করেন কৃষক। কিসের আবার অপেক্ষমাণ সময়! এ দেশের অধিকাংশ কৃষক বালাইনাশক ব্যবসায়ীদের পরামর্শে শস্যক্ষেতে বালাইনাশক ব্যবহার করেন। বাংলাদেশে যারা বালাইনাশকের ব্যবসা করেন, তাদের অধিকাংশেরই কৃষি-সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। তারা ফসলের পোকামাকড়, রোগবালাই ও আগাছা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না। রোগ ও পোকা আক্রমণের লক্ষণ সম্পর্কেও তাদের ধারণা নেই। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পর্কেও তারা অজ্ঞ। কৃষক বালাইনাশক ব্যবসায়ীদের পরামর্শে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার করেন। যেসব পোকামাকড় অতি সহজেই হাতেনাতে কিংবা কৃষিতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে দমন করা যায়, সেক্ষেত্রেও কীটনাশক ব্যবসায়ীদের পরামর্শে কৃষক অধিক মাত্রায় ক্ষতিকর কীটনাশক প্রয়োগ করেন। কীটনাশকের ক্ষতিকর দিক বিবেচনা না করে অপেক্ষমাণ সময় শেষের আগেই শাকসবজি তুলে বাজারে বিক্রি করেন। বালাইনাশকের নির্বিচার ব্যবহারে মানুষই শুধু দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছে না, ধ্বংস হচ্ছে উপকারী বন্ধু পোকা। পোকার দেহে সৃষ্টি হচ্ছে কীটনাশকের প্রতিরোধ ক্ষমতা। কীটনাশকের কারণে দূষিত হচ্ছে মাটি, পানি ও বাতাস। ধ্বংস হচ্ছে মাটিতে বসবাসকারী উপকারী অণুজীব ও কেঁচোর মতো উপকারী প্রাণী। মাটি হারাচ্ছে সহজাত উর্বরা শক্তি। বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ বৃষ্টি ও সেচের পানিতে চুইয়ে পড়ছে প্রাকৃতিক জলাশয়, নদী-নালা ও খালবিলে। ধ্বংস হচ্ছে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ। বিনষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে কৃষি।

এসব সমস্যা সমাধানে বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি উৎপাদন ও বাজারে তা বিক্রির ব্যবস্থা হতে পারে একটি সঠিক ও যুগোপযোগী সমাধান। এজন্য রাসায়নিক সার ও রাসায়নিক বালাইনাশকের পরিবর্তে জৈব সার ও জৈব বালাইনাশকের ব্যবহার বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে কৃষিতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে এবং হাতেনাতে পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন ব্যবস্থার ব্যবহার। সেই সঙ্গে প্রত্যেক সবজিচাষীর বাড়িতে কেঁচো কম্পোস্ট ও ট্রাইকো কম্পোস্ট তৈরির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পোকামাকড় ও ইঁদুর দমনে বিভিন্ন ফাঁদ, বিশেষ করে ফেরোমন আঠা ও হলুদ ফাঁদ ব্যবহারেও কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তুলনামূলকভাবে জৈব বালাইনাশকের দাম বেশি এবং সেগুলো রাসায়নিক বালাইনাশকের মতো গ্রামের হাটবাজারে সহজলভ্য নয়। তাই জৈব বালাইনাশকের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট কমিয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে কৃষকদের মধ্যে সরবরাহের উদ্যোগ নিতে হবে কৃষি মন্ত্রণালয়কে। কৃষক যাতে তার হাতের কাছে সহজে জৈব বালাইনাশক পান, তার ব্যবস্থা করতে হবে দেশের বালাইনাশক কোম্পানিগুলোকে। প্রয়োজনে রাসায়নিক সারের মতো জৈব সারেও সরকারি ভর্তুকি প্রদান করতে হবে। কমাতে হবে জৈব সারের দাম। জৈব সার ও কীটনাশকের ব্যবহার-সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যাপক প্রচার ও কৃষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

উত্তম কৃষির মানদণ্ড নির্ধারণ করে গ্লোবাল গ্যাপ (গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিসেস) ইউএসএআইডি ও গ্লোবাল গ্যাপের সহযোগিতায় দেশের চার শতাধিক চাষীকে উত্তম কৃষিচর্চায় প্রশিক্ষণ দিয়েছে স্বপ্ন। গ্লোবাল গ্যাপের মানদণ্ড মেনে সবজি উৎপাদন করছেন এসব চাষী। তারা অন্য চাষীদের চেয়ে সবজির দাম পাচ্ছেন বেশি। কম বালাইনাশক ব্যবহারের কারণে তাদের উৎপাদন খরচও হচ্ছে তুলনামূলকভাবে কম। থাইল্যান্ডে ৯০ শতাংশ শাকসবজি ও ফলমূল প্রক্রিয়াজাত করা হয়। দেশে যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে, সেসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং দেশের মানুষের মধ্যেও টাটকা ও প্রক্রিয়াজাত করা শাকসবজির ভোগ বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে উত্তম কৃষিচর্চা অনুসরণ করে মানসম্মত নিরাপদ সবজি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বিদেশে সবজি রফতানির পরিমাণ বাড়ানোর ব্যাপারেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন