যেভাবে আরব বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী শাসক ওমানের কাবুস

বণিক বার্তা অনলাইন

আরব বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সময় দেশ শাসন করেছেন সুলতান কাবুস বিন সাইদ আল সাইদ। ওমানের এ সুলতান গতকাল শুক্রবার রাতে ৭৯ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বেলজিয়ামে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে গত মাসেই দেশে ফিরেছিলেন তিনি। এরপরই জানা যায় তিনি ক্যানসারে ভুগছিলেন। 

এই সুলতান ছিলেন অবিবাহীত। ফলে ওমানের রাজপ্রাসাদে উত্তরাধিকারী নিয়ে জটিলতা তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন শেষে জানা যাবে কে হতে যাচ্ছেন ওমানের পরবর্তী সুলতান। 

১৯৭০ সালে ব্রিটেনের সহযোগিতায় এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাবাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন কাবুস। অনেকে বলেন, ভুগর্ভস্থ তেল সমৃদ্ধ ওমানের উন্নয়নের যাত্রা শুরু এর পর থেকেই।  সেই ১৯৭০ সাল থেকে প্রায় নির্বিবাদে ওমান শাসন করে এসেছেন কাবুস। এমনকি আরব বসন্তের সময়ও তিনি প্রায় রক্তপাত ছাড়াই টিকে যান। সেই ১৭৪৪ সাল থেকে শাসন করে আসছে এই আল সাইদ পরিবার। কিন্তু এ যাবতকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় সুলতান মনে করা হয় কাবুসকে। পশ্চিমা গণমাধ্যমে তাকে প্রগতিশীল সুলতান হিসেবে অভিহিত করা হয়। 

সুলতানাতের মৌলিক নীতি অনুযায়ী রাজ পরিবারের কাউন্সিল তিন দিনের মধ্যে নতুন সুলতান নির্বাচন করবে। এ কাউন্সিলের প্রায় ৫০ জন সদস্যের সবাই পুরুষ। রাজ পরিবার যদি সুলতান নির্বাচনে ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয় তাহলে প্রতিরক্ষা কাউন্সিল, সুপ্রিম কোর্টের চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা কাউন্সিল এবং জাতীয় কাউন্সিলের উপস্থিতিতে একটি খাম খোলা হবে। সুলতান কাবুস এ খামেই তার পছন্দের উত্তরাধিকারীর নাম লিখে গেছেন।

সিংহাসনের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে আছেন সদ্য প্রয়াত সুলতানের তিন চাচাতো ভাই। এরা হলেন সংস্কৃতি মন্ত্রী হাইথাম বিন তারিক আল সাইদ, উপ প্রধানমন্ত্রী আসাদ বিন তারিক আল সাইদ এবং সাবেক নেভি কমান্ডার ও উপদেষ্ট শিহাব বিন তারিক আল আসাদ। সুলতান কাবুস ছিলেন একাধারে ওমানের প্রধানমন্ত্রী, সশস্ত্র বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং অর্থ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন সর্বেসর্বা।

প্রায় পাঁচ দশকের শাসনামলে সুলতান কাবুস ওমানের রাজনৈতিক পরিসরে এতোটাই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যে, সে অর্থে কোনো বিরোধী শক্তি দাঁড়ায়নি। তাছাড়া এদেশের ৪৬ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৪৩ শতাংশই প্রবাসী। মাত্র ২৯ বছর বয়সে বাবা সাইদ বিন তইমুরকে সিংহাসনচ্যুত করার পর ওমানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারে হাত দেন তিনি। সাইদ বিন তইমুরকে চরম রক্ষণশীল শাসক বলে মনে করা হয়। তিনি রেডিও শোনা, রোদচশমা পরা নিষিদ্ধ করেন। এমনকি তার আমলে কে বিয়ে করতে পারবে এবং নাগরিকদের পড়াশোনা ও বিদেশ যাত্রার ব্যাপারেও রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ছিল।

সিংহাসনের আরোহনের পরপরই কাবুস একটি আধুনিক সরকার গঠন এবং তেল রফতানির টাকা দেশের উন্নয়নে খরচ করার ঘোষণা দেন। তিনি যখন ক্ষমতা নেন তখন ওমানে মাত্র ১০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা এবং তিনটি বিদ্যালয় ছিল।

শাসনামলের প্রথম কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি দেশে সম্ভাব্য বিশৃঙ্খলা ও বিক্ষোভের দরজা বন্ধ করার কৌশল নেন। ব্রিটিশ বিশেষ বাহিনীর সহায়তায় দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ দোফারে উপজাতিদের সশস্ত্র বিপ্লব চেষ্টা দমাতে সক্ষম হন। বলা হয় মার্কসিস্ট পিপলস ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব ইয়েমেনের সহযোগিতায় উপজাতিদের ‘বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টির পরিকল্পনা ছিল।

বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে সব সময় নিরপেক্ষ থেকেছেন সুলতান কাবুস। সম্ভবত এ অবস্থানের কারণেই পরমাণু ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে দূতিয়ালি করতে পেরেছিল ওমান। সুলতানের উদ্যোগেই ২০১৩ সালে ইরান-মার্কিন গোপন আলোচনা শুরু হয়। এর দুই বছর পরই পরমাণু ইস্যুতে ঐতিহাসিক চুক্তিতে পৌঁছে দুই দেশ।

সুলতান কাবুসকে অনেকে ক্যারিশমাটিক ও দূরদর্শী শাসক বলে মনে করেন। নিজ দেশে তার জনপ্রিয়তাও আছে। কিন্তু তিনি ছিলেন ওমানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সুলতানের বিরুদ্ধে কোনো টুঁ শব্দও মেনে নেয়া হতো না। ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় সারা দেশে কমবেশি বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল।

তবে তেল সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলেই আধুনিক দুনিয়ায় প্রবেশ করে ওমান। সাধারণ মানুষের উন্নয়নে তেলের টাকা খরচ করার কারণে ওমানে কখনো সরকারের বিরুদ্ধে কোনো অসন্তোষ সেভাবে দানা বাঁধেনি। যদিও বেতন বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের দাবি এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে।

ওমানের নিরাপত্তা বাহিনী সে আন্দোলন শুরুর দিকে সহ্য করলেও এক সময় দমনের নীতি গ্রহণ করে। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট এবং তাজা গুলিও ব্যবহার করা হয়। দুই জন নিহত এবং কিছু মানুষ আহত হয়। কয়েকশ বিক্ষোভকারীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়। বেআইনিভাবে সমাবেশ করা এবং সুলতানের অবমাননার অভিযোগে তাদের বিচার করা হয়।

শেষ পর্যন্ত আন্দোলন থেমে যায়। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কোনো পরিবর্তন ছাড়াই শেষ হয় বিক্ষোভ। তবে সুলতান কাবুস দুর্নীতির অভিযোগে বেশ কয়েকজন মন্ত্রীকে সরিয়ে দেন। এরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারে নানা দায়িত্বে ছিলেন। পাশাপাশি উপদেষ্টা কাউন্সিলের ক্ষমতার আওতা বাড়ানো হয় এবং সরকারিখাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়। 

এর পর থেকে অবশ্য বিরোধী মত দমনে আরো কঠোর হয়েছে ওমান। সরকারের সমালোচক স্থানীয় পত্রিকা ও ম্যাগাজিন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বই জব্দ, অধিকার কর্মীদের হয়রানিসহ নানা দমনমূলক ব্যবস্থার চর্চা করে এসেছে কাবুসের সরকার। সূত্র: বিবিসি ও সিএনএন

আরো পড়ুন: 

অর্ধশতাব্দি ওমান শাসন করা সুলতানের মৃত্যু

ওমানের নতুন সুলতান হাইথাম বিন তারিক আল-সাঈদ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন