সওজের প্রকৌশলীদের দুর্নীতি

তদন্তপূর্বক দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক

সড়ক নিয়ে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা থেমে নেই। উন্নত অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণ ব্যয় বেশি হলেও এর স্থায়িত্ব বাড়েনি। স্রেফ সড়কের পরিমাণ বৃদ্ধি ঘটেছে। এ ধারাবাহিকতায় দেশে সড়ক অবকাঠামোর পরিমাণ বাড়ছে কিন্তু স্থায়িত্ব বাড়ছে না; বরং নির্মাণকাজ শেষ হতে না হতেই সড়কের কার্পেটিং উঠে যাচ্ছে, কোথাও দেবে যাচ্ছে। অথচ সড়কের দেখভালের দায়িত্বে যে অভিভাবক প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে, তারা দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করছে বলেই আজ দেশের সড়কের এ দৈন্য দৃশ্যমান। নিয়মানুসারে যে অনুপাতে নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার করার কথা, তা যেমন অনুসরণ করা হচ্ছে না, তেমনি এক ঠিকাদার আরেক ঠিকাদারের লাইসেন্স দেখিয়ে কাজ বাগিয়ে নিচ্ছেন। অথচ সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা উদাসীন। কেননা প্রদীপের গোড়ায় অন্ধকারের মতোই ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে খোদ সওজের কিছু প্রকৌশলীর। তাদের মদদে দিনের পর দিন একই সড়ক মেরামতের পেছনে সরকারের বড় অংকের অর্থ ব্যয় হচ্ছে। আশার কথা, সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স প্রদর্শনপূর্বক চলছে শুদ্ধি অভিযান। আমাদের প্রত্যাশা সওজের যে প্রকৌশলী ও কর্মকর্তারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। এক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।

প্রসঙ্গত, নিজ নির্বাচনী এলাকার একটি পরিবারকে সমবেদনা জানিয়ে সামান্য কিছু উপহারসামগ্রী ও অর্থ দেয়ার প্রস্তাব করায় জাপানের এক মন্ত্রী পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার এক মন্ত্রীকে শাস্তিমূলক পদত্যাগ করতে হয়েছে নিজ কন্যার উচ্চশিক্ষাকে কেন্দ্র করে অনিয়ম করেছেন বলে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের এমন নজির সৃষ্টি করতে হবে বাংলাদেশেও। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে সর্বপ্রথম প্রতিটি ধাপের দুর্নীতি দূর করা জরুরি। এক্ষেত্রে সড়ক সংস্কার ও মেরামতের কাজে যারা গাফিলতি করেন, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ জনগণের যৌক্তিক দাবি। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো সংস্কারের নামে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে; যা দেশের সাধারণ মানুষেরই কষ্টার্জিত অর্থ। ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে সরকারি প্রকৌশলীদের জনগণের টাকা অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ বড় ধরনের অপরাধ বৈকি। তাছাড়া সড়কে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগটি দীর্ঘদিনের। নিম্নমানের ইট, খোয়া ও বিটুমিন ব্যবহার, ঠিকমতো মাটি ও বালি না ফেলার মতো কারণগুলো নিয়মিত তদারক করতে হবে। মুনাফালোভী ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি তাদের লাইসেন্স বাতিল করে শাস্তি দিতে হবে।

মহাসড়কের পেভমেন্টের আয়ুষ্কাল থাকার কথা ২০ বছর। কিন্তু এক বছরেই আয়ুষ্কাল হারাচ্ছে নতুন নির্মিত অনেক জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক। উন্নত দেশগুলো ঘন ঘন মেরামতকাজে ঠিকাদারকে বাধ্য করে। অথচ আমাদের দেশে একবার কাজ সম্পাদনের পর আরো কোনো খোঁজ রাখা কিংবা নিয়ম করে দেখভাল করা হয় না। রাজনৈতিক চাপে অযোগ্যদের কাজ দেয়ার সংস্কৃতির দুর্নীতির সংখ্যা বাড়ছে, যা দেশের টেকসই অগ্রগতির অন্তরায়। গত বছর দুদকের অনুসন্ধানে সওজ সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেয়া, ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমেও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে এর প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ উঠে এসেছে পূর্ত নিরীক্ষা অধিদপ্তরের সর্বশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও। একই কাজে ঠিকাদারকে একাধিকবার বিল পরিশোধে সহযোগিতা কিংবা একই স্থানে দুবার কাজ সম্পন্ন দেখানোর পাশাপাশি প্রয়োজন না থাকলেও সড়ক উন্নয়নের নামে অর্থ তুলে নিতেও সহায়তা করেছেন তারা। দেশের ৫৫টি সড়ক বিভাগের প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তোলা হয়েছে। এসব অভিযোগের সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৫ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা। হাতেগোনা কয়েকজন দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে অতীতে আইনি ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলীদের বড় অংশই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকাটা সংশ্লিষ্ট মহলের কাজের প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

উল্লেখ্য, দুর্নীতি বন্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকে বছরখানেক আগেই ২১ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। বিষয়টির কতটা অগ্রগতি হয়েছে, তার তদারকি জরুরি। সড়কের কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কিনা, সেটি দেখভালের জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের বিকল্প নেই। দুদকের সুপারিশ যেন কেবল কাগজ-কলমে না থাকে, সেজন্য সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে জড়িত সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়কে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে সনাতন ধারার পরিবর্তে কীভাবে সড়কের টেকসই উন্নয়ন ঘটানো যায়, সে ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা চাই। উন্নত দেশগুলো তাদের সড়ক-মহাসড়কগুলোকে কীভাবে স্থানীয় জলবায়ু উপযোগী করে তৈরি করছে, এ সম্পর্কে আমাদেরও অবগত হতে হবে। বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তিগত পরীক্ষার মাধ্যমে সড়কের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করাটা আর্থিকভাবে ফলপ্রসূ হবে। তবে সওজের দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলীদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়ার পাশাপাশি উন্নত জ্ঞানসমৃদ্ধ প্রকৌশলীদের পদে বসানো জরুরি। এ ব্যাপারে দায়িত্বরত মন্ত্রণালয়কে তত্পর হতে হবে। অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরির পাশাপাশি যোগ্য লোকদের দায়িত্ব প্রদানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অর্জনের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন