এ প্রজন্মের শিক্ষক আগামীর স্বপ্নদ্রষ্টা

মো. সিদ্দিকুর রহমান

২০১৯ সালের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের নির্ধারিত প্রতিপাদ্য ছিল YOUNG TEACHER: THE FUTURE OF THE PROFESSION প্রতি বছর শিক্ষকদের মাঝে দিবসটি ঘুরেফিরে আসে। বিশ্বে শিক্ষকসমাজের কাছে দিবসটি অহংকার করার মতো। জানামতে, বিশ্বের অন্যান্য পেশার মানুষের স্মরণ করার মতো কোনো দিবস নেই। শিক্ষকরা জাতি গড়ার কারিগর। তাদের মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বিশ্ব শিক্ষক দিবসের তাত্পর্য অপরিসীম। অথচ বাংলাদেশের শিক্ষকসমাজের অনেকেই দিবসটি সম্পর্কে তেমন জ্ঞাত নয়। এ দিবসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ না রাখা এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দিবসটি হয়ে পড়েছে গুরুত্বহীন। সাধারণ শিক্ষকদের মাঝে দিবসটি নিয়ে তেমন ভাবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। প্রতি বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নেতৃত্বে ও অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ইউনেস্কো গণসাক্ষরতাসহ বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে জাতীয় কমিটি শোভাযাত্রা ও আনুষ্ঠানিকভাবে দিবসটি উদযাপন করে। আমরা প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়ায় দিবসটির গুরুত্ব ও তাত্পর্য নিয়ে নিবন্ধ লিখে থাকি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতি বছর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস বিদ্যালয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে পালন করে। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ প্রাথমিকের মন্ত্রণালয়ের ঐতিহাসিক শিক্ষা দিবস ও বিশ্ব শিক্ষক দিবস সরকারিভাবে পালনে কোনো ভাবনা দৃশ্যমান নয়। শিক্ষার উন্নয়নে বর্তমান সরকারের কার্যক্রম দেশ-বিদেশে সমাদৃত। এ উন্নয়নে শিক্ষকসমাজ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। জাতি গড়ার কারিগর তথা শিক্ষা উন্নয়নে মুখ্য অংশীদার। শিক্ষকসমাজের একটি মাত্র দিবস সরকারিভাবে পালন না করে বিদ্যালয় খোলা রাখা শিক্ষকসমাজের অবদান স্বীকৃতি না দেয়ার শামিল। শিক্ষকসমাজের পক্ষ থেকে দিবসটিতে বিদ্যালয় বন্ধ রেখে সরকারিভাবে পালনের দাবি জানাই। শিক্ষাবান্ধব সরকারের অনেক উন্নয়নের পরও আজো বৈষম্যের বেড়াজালে নিমজ্জিত শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষায় বাণিজ্য বন্ধ হয়েছে বলে দৃশ্যমান নয়। সরকারের ঐতিহাসিক সাফল্য প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত বিনা মূল্যে বই বিতরণের সাফল্য ম্লান করে দিচ্ছে নোট-গাইড। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পরও শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষকসমাজের মাঝে বৈষম্যের দেয়াল বিরাজমান। প্রাথমিকে সহকারী ও প্রধান শিক্ষকের মধ্যে বেতনবৈষম্য নিয়ে আজ অসন্তোষ চরমে। প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ও কিন্ডারগার্টেন তথা অন্যান্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সময়সূচি ও পাঠ্যবইয়ে বিশাল বৈষম্য। এ বৈষম্যের কারণে প্রাথমিকে শিক্ষার্থীর খাবার, উপবৃত্তিসহ নানা উদ্যোগ ম্লান হয়ে আজ প্রাথমিক শিক্ষা সংকটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মতিঝিল থানার পিঅ্যান্ডটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে এসে শিক্ষার্থী সংকট স্বচক্ষে দেখেছেন। তিনি শিক্ষকদের শিক্ষার্থী সংকট দূর করার নির্দেশ দেন। বাস্তব সমস্যা হলো, আশপাশের বিদ্যালয়গুলোর সময়সূচির সঙ্গে পিঅ্যান্ডটি স্কুলের সময়সূচির বিশাল ব্যবধান। আরেকটি সমস্যা হলো, উচ্চ বিদ্যালয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভূমি অবৈধভাবে দখল করে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলাসহ বিদ্যালয়ের পরিবেশ বিঘ্নিত করে রেখেছে। সময়সূচি ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের দায় তো শুধু শিক্ষকদের নয়। এ দায় নিয়ে প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভাবতে হবে। বেসরকারি শিক্ষকদের মাঝেও এমপিও, নন-এমপিও নিয়ে বৈষম্য। সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজের সঙ্গে বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের বাড়িভাড়াসহ বেতনের পাহাড়সম বৈষম্য।

আজ প্রাথমিক শিক্ষাসহ শিক্ষার সব বৈষম্য দূর করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও শিক্ষাবান্ধব সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। বিশ্ব শিক্ষক দিবসের এ বছরের মূল প্রতিপাদ্যের ব্যাখ্যা হচ্ছে, এ প্রজন্মের শিক্ষকরা আগামী প্রজন্মের সুনাগরিক তৈরি করার স্বপ্নদ্রষ্টা। এর মাঝে কতিপয় চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। প্রথমত, এ প্রজন্মের শিক্ষকরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ইতিহাস পড়ে বেড়ে ওঠেননি। বরং তারা স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ইতিহাস জেনে এসেছেন। অন্যদিকে মর্যাদা ও বেতন স্কেলের কার্পণ্যের কারণে মেধাবী তরুণরা শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছেন। আর যারা শিক্ষকতা পেশায় আছেন, তারা বৈষম্য, পাঠদানবহির্ভূত কাজের চাপ ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় হাবুডুব খাচ্ছেন।

কুমিল্লা জেলার শিক্ষক মো. কামরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পরিপন্থী শিক্ষক দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বক্তব্যটি বাস্তব। এ প্রেক্ষাপটে নবপ্রজন্মের শিক্ষকদের দেশের সংগ্রামী ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে জানাতে হবে। শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জ্ঞান যাচাইয়ের প্রতি অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। তরুণ প্রজন্মের শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদার বৈষম্য দূর করতে হবে। শিক্ষকদের শিক্ষাদানবহির্ভূত সব কাজ থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। এক কথায় শিক্ষকদের তৃতীয় ও দ্বিতীয় শ্রেণীর বেতন স্কেল ও মর্যাদা দিয়ে প্রথম শ্রেণীর সুনাগরিক তৈরি শুধু স্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়।

শিক্ষক সংগঠনগুলোর মাঝে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনে কোনো ইতিবাচক উদ্যোগ দেখা যায় না। এ বছর বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনগুলোকে নিয়ে একত্রে দিবসটি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে হয়তো তাদের মাঝে তৈরি হবে পরবর্তী সময়ে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের আগ্রহ। শিক্ষকদের মর্যাদা ও বৈষম্য দূর করার অভিপ্রায়ে শিক্ষকসমাজ এগিয়ে যাক।

 

মো. সিদ্দিকুর রহমান: সভাপতি

বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ

[email protected]

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন