‘জাতীয় সংগীত—একটি পবিত্র বোধ’

সেলিম জাহান

আজকাল একটা কথা প্রায়ই শুনতে পাই, ‘অমুকে ওই কথাটি ঠিক বুঝে বলেনি।’ একজন সাধারণ মানুষ যখন কোনো কিছু একটা না বুঝে বলে ফেলে, তখন তাকে গুরুত্ব না দিলেও চলে তিনটে কারণে—এক. তার বক্তব্যটি হতে পারে একেবারেই অজ্ঞতাপ্রসূত; দুই. তার কথা কারো দৃষ্টিগোচর এবং মননগোচর হওয়ার সম্ভাবনা বড়ই ক্ষীণ; তিন. তার না বুঝে বলার ফলে মানুষ, সমাজ ও জাতির ক্ষতি হবে না।

কিন্তু মানুষ যখন একটা জায়গায় পৌঁছে যায়—ক্ষমতা, দায়িত্ব, শ্রদ্ধা, সম্মান, প্রতিনিধিত্ব ও জননন্দনের ক্ষেত্রে—তখন কিন্তু কথিত বক্তব্যের ক্ষেত্রে দায়িত্ব ও পরিমিতি চলে আসে। তখন ‘না বুঝে বলার’ কোনো সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে অবশ্যই বুঝে বলতে হবে। বলার আগে বুঝতে হবে। না বুঝলে বুঝে নিতে হবে। মুখ খোলার আগে বোধ খুলতে হবে।

যেমন চলমান ডেঙ্গুর কারণ এবং এর প্রতিকার সম্পর্কে পথচলতি একজন মানুষ তার যা মনে হয়, তা বলতে পারেন। তার দায়বদ্ধতা বড় কম। কিন্তু একজন ডাক্তার যখন কোনো কথা বলছেন কিংবা একজন সরকারি কর্মকর্তা যখন কোনো মতামত দিচ্ছেন, তখন সেটা শুধু তার কথা থাকে না। তাদের কথা, তাদের পরামর্শ, তাদের মতামত লোকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে, সে অনুসারে কাজ করে। দায়িত্বহীন কোনো কথা, পরামর্শ বা মতামত দিলে নানা জনগোষ্ঠীর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। সুতরাং সেখানে না বুঝে বলার কোনো সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে কিছু বলার আগে বুঝে নিতে হবে সবকিছু।

উপর্যুক্ত কথাগুলো যেমন ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে এবং সরকারি কর্মকর্তার ক্ষেত্রে সত্য, তেমনি সত্য একটি দেশের জাতীয় সংগীত ও একজন জনপরিচিত গায়কের ক্ষেত্রেও। একটি দেশের সব মানুষেরই শ্রদ্ধাশীল থাকার কথা তাদের দেশের জাতীয় সংগীতের প্রতি। সে রকম একটি পবিত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একজন জনপরিচিত গায়ক যখন জাতীয় সংগীতের সঙ্গে অন্য একটি গানের তুলনামূলক বিচার করে অন্য গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে বেশি অর্থবহ বলে উল্লেখ করেন, তখন তা আর তার নিজের কথা থাকে না এবং সে দায়িত্বহীন মন্তব্যকে ‘না বুঝে বলার’ মোড়কে পেঁচিয়ে রাখা যায় না। বক্তব্যটি যদি নিছক কোনো গান নিয়ে হতো, তাহলে হয়তো বিষয়টি ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও চলত। কিন্তু কথিত বক্তব্যটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নিয়ে এবং স্পর্শকাতরতাটি সেখানেই।

সমস্যা হচ্ছে, এ-জাতীয় দায়িত্বহীন মন্তব্যকে মূলধন করেই নানা অপশক্তি নানা অপচেষ্টা চালায়, নানা ষড়যন্ত্রে মাতে। জানা কথা, অপশক্তিরা তাদের হীন ষড়যন্ত্রে অন্যকে সততই ব্যবহার করে। আইয়ুব আমলে আরবি হরফে বাংলা লেখা ও রবীন্দ্রসংগীত বর্জনের অপচেষ্টার ক্ষেত্রেও এটা দেখা গেছে। স্বস্তির কথা যে তখন জ্ঞানতাপস অধ্যাপক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জননী সাহসিকা বেগম সুফিয়া কামাল, শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর মতো মানুষদের নেতৃত্বে এসব অপপ্রয়াস বানচাল করে দেয়া হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন