সিল্করুট

মোহিনী মিলস

সময়ের কাঠগড়ায় এক ধ্বংসের ইতিহাস

ড. আমানুর আমান


অবিভক্ত ভারতের বস্ত্র শিল্পের ইতিহাসে এক বিশেষ অগ্রদূতের ভূমিকা রেখেছে তত্কালীন পূর্ব বাংলার নদীয়া জেলার কুষ্টিয়ায় স্থাপিত মোহিনী মিলস। ব্রিটিশ শাসনামলে উপমহাদেশের ইতিহাসে যে টি বস্ত্রকলের নাম পাওয়া যায় মোহিনী মিলস তার অন্যতম। অন্যদিকে পূর্ব বাংলায় মিলের স্থানটি ছিল অনন্য উচ্চতায়। কারণ বঙ্গের পুরো ভূভাগে এই একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানই সে সময় গড়ে উঠেছিল। যদিও ইউরোপে ঘটে যাওয়া শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়া থেকে দূরে অনেক পরে মিলটি স্থাপিত হয় তথাপি শুধু অর্থনৈতিক বিচারেই নয়, মিলটি পুরো বাংলা ভূখণ্ডের মর্যাদাকেই বৃদ্ধি করেছিল। মর্যাদা অখণ্ড আরো শক্তিশালী হয়ে দেখা দিয়েছিল যখন মিলেরই উৎপাদিত সুতা দিয়ে তৈরি ধুতি, শাড়ি, মার্কিন শালু কাপড়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে যায় ভারতজুড়ে। ইতিহাসের রকম পাতাজোড়া সম্মান ওই সময়ে আর কিছুতেই এত অনায়াসে আসেনি।

মোহিনী মোহন চক্রবর্ত্তী

পেশায় ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের মেধাবী সদস্য মোহিনী মোহন চক্রবর্ত্তী মোহিনী মিলের প্রতিষ্ঠাতা। মোহিনী মোহনের জন্ম জুলাই ১৮৩৮ সালে (বাংলা ১২৪৫ সালের ২০ আষাঢ়) কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার মুড়াগাছা গ্রামে। মোহিনী মোহনের পিতা কৃষ্ণলাল চক্রবর্ত্তী মা ভগবতী দেবী। কৃষ্ণলালের পিতা নবকিশোর ছিলেন কুমারখালী রেশম কুটিরের দেওয়ান। সেখানে গুটি থেকে তসরের কাপড় তৈরি হতো। পাঁচ ভাই এক বোনের মধ্যে মোহিনী মোহন চক্রবর্ত্তী ছিলেন বড়। পুলিশে চাকরির সূত্রে পিতা কৃষ্ণলালের রাজশাহীর বোয়ালিয়াতে পোস্টিং ছিল (১৮৫৩-১৮৫৭) সে সূত্রে মোহিনী মোহন ১৮৫৩-১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ওখানেই স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং কলকাতা বোর্ডের অধীনে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেন। কুষ্টিয়া মহকুমা অফিসে কেরানি হিসেবে যোগদান করে চাকরি জীবন শুরু করেছিলেন মোহিনী মোহন। কুষ্টিয়া মহকুমার সাবডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট স্যার আলেকজান্ডার ম্যাককেনজি এবং বাংলার উচ্চপদস্থ বেসামরিক কর্মচারী স্যার ডব্লিউ হান্টার মোহিনী চক্রবর্ত্তীর কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কাজ কাজের প্রতি তার দৃঢ়তা নিষ্ঠার কারণে মোহিনী বাবুর জীবনের চাকা দ্রুতগতিতে চলতে শুরু করেছিল। ব্রিটিশ সরকার তাকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তার প্রথম পোস্টিং ছিল নোয়াখালীর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বিচারক হিসেবে। পরবর্তী সময়ে তিনি ফরিদপুরসহ বিভিন্ন জেলা পরগনায় চাকরি শেষে ১৮৯৪ সালে ভাগলপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে অবসর হ্রহণ করেছিলেন।

মোহিনী মিলস প্রতিষ্ঠা

মোহিনী মিলস লিমিটেড ছিল একটি বাণিজ্যিক উদ্যোগ। এটি মোহিনী মোহনের আমলাতান্ত্রিক চিন্তাধারা ভাবনার বাইরের গল্প। ব্রিটিশ শাসনের ওই সময়ে ভারতজুড়ে নানা অস্থিরতা। একদিকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দিকে দিকে নানা অসন্তোষ, অন্যদিকে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের স্বদেশী আন্দোলনও বেশ জোরালো। সেই সময়েই মোহিনী মিলস প্রতিষ্ঠার চিন্তা করা হয়। এটি উল্লেখ করা যেতে পারে যে এরই মধ্যে প্রথম আধুনিক সুতির টেক্সটাইল মিলস ১৮৫৮ সালে রঞ্জোদোদলাল ছোটাল নামে একজন গুজরাটি আহমেদাবাদে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনিও ছিলেন একজন সিভিল সার্ভেন্ট। কিন্তু বাংলায় মোহিনী মোহন ছিলেন প্রথম বাঙালি, যার হাত ধরে ভারতের পূর্ব অংশে সুতি বস্ত্রকলের প্রতিষ্ঠা পায়। চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর চাকরি থেকে পাওয়া সমুদয় অর্থ দিয়ে তিনি মিলস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।

১৯০৫-০৬ সালে মাত্র আটটি তাঁত যন্ত্র নিয়ে মোহিনী মোহন যাত্রা শুরু করেন মোহিনী মিলের। স্থান হিসেবে বেছে নেন তত্কালীন নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমাকে। জায়গাটি বেছে নেয়ার অনেকগুলো কারণ ছিল। জায়গাটি ছিল শহরের প্রাণকেন্দ্র। অদূরেই ছিল কুষ্টিয়া রেলওয়ে স্টেশন। তার পাশেই ছিল ছোট নদীবন্দর। মিলের পাশ দিয়েই গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ। সেখান থেকে নদী পেরোলেই ঢাকা শহর। আবার পাশেই বড়বাজার। গড়াই নদের ঘাট থেকে নদীপথে বড় বড় নৌকায় সুতা থেকে উৎপাদিত পণ্য কলকাতার শিয়ালদহ দেশের পাবনা, শাহজাদপুর, গাজীপুর, নাটোরসহ দেশের প্রায় সব এলাকায় পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ ছিল।

প্রতিষ্ঠার কিছুদিনের মধ্যেই মিলটি একটি লাভজনক শিল্পে পরিণত হয়। ১৯০৮ সালের মধ্যেই ১০০ একর জায়গার ওপর ছড়িয়ে যায় পুরো মিলটি। ১৯১০ থেকে ১৯১৮ সময়কালে সুদূর ইংল্যান্ড থেকে পিতলের হ্যান্ডলুম মেশিন আর পিতলের তৈরি প্রায় ২০০ তাঁত আমদানি করে মিলসের কলেবর উৎপাদন বহুগুণে বাড়িয়ে তোলা হয়। সময়ে প্রতিদিন কুষ্টিয়া বড় স্টেশনে ভারতের শিয়ালদহ থেকে কয়েকটি বগি রিজার্ভ আসত মোহিনী মিলের সুতা নেয়ার জন্য। আবার বড়বাজার গড়াই নদের ঘাট থেকে বড় বড় নৌকায় সুতা যেত দেশের বিভিন্ন জায়গায়। পাবনা, শাহজাদপুর, গাজীপুর, নাটোরসহ দেশের প্রায় সব এলাকা থেকে তাঁতিরা এখানে আসতেন সুতা কিনতে। এটিই ছিল পূর্ব বাংলার প্রথম বড় টেক্সটাইল মিলস।

সময়ে মিলটি একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়, যার প্রাথমিক পুঁজি ছিল লাখ ৫০ হাজার টাকা। পরবর্তী সময়ে কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে ৬০ লাখ টাকা সংগ্রহ করা হয়। ছয় মাসের মধ্যেই এক-তৃতীয়াংশ শেয়ার বিক্রি হয়ে যায়, যার অধিকাংশের ক্রেতা বরিশাল, সিলেট, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ভারতের পাটনা রেঙ্গুনের ব্যবসায়ীরা। কুষ্টিয়ায়ই ছিল শেয়ার রেজিস্ট্রার অফিস। মিলের প্রথম সাধারণ সভা হয় ১৯১৮ সালের ১৮ আগস্ট। মিলের ১৪ জন বোর্ড অব ডিরেক্টরসের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়। এরা হলেন বাবু মোহিনী মোহন চক্রবর্ত্তী, মাধবচন্দ্র রাও, বিহারী লাল সেন, কালিদাস নন্দী, চন্দ্রমণি সান্যাল, চণ্ডীচরণ চট্টোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ রায়, তারাপদ মজুমদার, গোকুল চন্দ্র মণ্ডল, পূর্ণচন্দ্র রায় (প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ভ্রাতা) মোহাম্মদ রওশন খান চৌধুরী। আরো তিনজন বিশেষ ব্যক্তি ওই বোর্ড অব ডিরেক্টরসে ছিলেন তারা হলেন রাজা প্রমথভূষণ দেব রায় বাহাদুর (নালন্দার জমিদার), জগিকশোর আচার্য (ময়মনসিংহের জমিদার) কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (জোড়াসাঁকোর জমিদারঅচিরেই ভারতবর্ষজুড়ে একটি আধুনিক সুতাকলের মধ্যে মোহিনী মিলসের নাম চলে আসে। ১৯২০-এর দশকের মধ্যে মিলে প্রায় তিন হাজার মানুষ কাজ করত। সময় এখানে উন্নতমানের সুতা, মোটা শাড়ি, ধুতি, বেডশিট, তোয়ালে, হাসপাতালে ব্যবহূত গজ, ব্যান্ডেজ, ধূসর বর্ণের রঙিন সুতা তৈরি হতো। স্বদেশী যুগে দেশী কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা মেটাতে মিলটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে থাকে। মোহিনী মিলসের মার্কিন শাড়ি কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা ছিল। ধীরে ধীরে মিলটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে। মিলটি থেকে ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, বার্মায় প্রচুর পরিমাণে সুতা রফতানি হতো। মিলটি পুরো এশিয়ার মধ্যেই একটি স্থান দখল করে নেয়। সময় মিলের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল লক্ষ্মী কটন মিলস ঢাকেশ্বরী কটন মিলস লিমিটেড।

ইতিহাস বলছে, সময় মিলে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ পিস ধুতি শাড়ি তৈরি হতো। সময় মিলের অথরাইজড ক্যাপিটাল লাখ ৫০ হাজার থেকে লাখে পৌঁছে। ১৯১৮ সালে সেটা পৌঁছে লাখে। ১৯১৪-১৯১৫ ছাড়া ১৯১২ থেকে ১৯১৮-এর মধ্যে কোম্পানিটি প্রতি বছরই লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।


১৯২০ সালে দেশে পুনরায় ব্রিটিশ পণ্য আনতে ব্রিটিশ সরকার এদেশীয় শিল্পের ওপর বৈষম্যপূর্ণ এক্সাইজ ডিউটি আরোপ করে। যা ছিল স্বদেশী কটন শিল্পের বিকাশের ওপর চরম আঘাত। সময় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় হোসিয়ারি শিল্প। কারণ শিল্পগুলোর উৎপাদনের ওপর লেভি আরোপ করা হয়। মোহিনী মিলসকে সুতা আমদানির জন্য শতাংশ কাস্টমস ডিউটি পরিশোধ করতে হতো।

১৯২২ সালে ৮৪ বছর বয়সে মোহিনী মোহন চক্রবর্ত্তীর মৃত্যুর পর বড় ছেলের ছেলে (পৌত্র) দেবীপ্রসাদ চক্রবর্ত্তী (কানু বাবু) মোহিনী মিলসের দায়িত্ব নেন। মিলটি এগিয়ে যেতে থাকে। মিলে বসানো হয় ১০ হাজার চরকার টাকু (স্পিন্ডলস) ৩০০ তাঁত। সময় কলকাতায় মিলের একটি ইউনিট স্থাপন করা হয়, যেখানে উৎপাদিত হতো ধুতি, লং-ক্লথ, শাড়ি, মশারি, বেডশিটস শার্টের কাপড়সবই ছিল উচ্চমানের।

মোহিনী মিলসকে কেন্দ্র করে মিলের শ্রমিকদের জন্য আধুনিক হাসপাতাল, খেলার মাঠ, নাট্যমঞ্চ নির্মাণ করা হয়। নাট্যমঞ্চের নাম ছিল সন্ধ্যা সমিতি। বাংলা সাহিত্যকে ছড়িয়ে দিতে একটি লাইব্রেরিও স্থাপন করা হয়। একটি শক্তিশালী ফুটবল টিমও ছিল মিলের অধীনে, যে দলটি প্রায়ই কলকাতা টিমের সঙ্গে খেলত। মোহিনী মিলসে বিভিন্ন অনুষ্ঠান বছরজুড়েই লেগে থাকত। মিল কর্তৃপক্ষের সৌজন্যে দু-তিনটি বড় অনুষ্ঠান হতো। ক্লাবের অনুষ্ঠান হতো জুলাই-আগস্টের মধ্যে। দুর্গা পূজার অনুষ্ঠান হতো খুব ধুমধাম করে। নভেম্বর পালিত হতো মিলের প্রতিষ্ঠাতা মোহিনী মোহনের তিরোধান দিবস। এই তিনটি অনুষ্ঠানেই দেশ-বিদেশের শিল্পীদের মিলনমেলা বসত। কলকাতার গায়কদের গান তখন শোনার সুযোগ হতো কুষ্টিয়ার আপামর জনতার। কানা কেষ্ট, সুপ্রভা সরকার, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, শ্যামল মিত্র, আল্পনা, বাণী ঘোষাল, গায়ত্রী বসু, কৃষ্ণা দাশগুপ্ত, ভি বালসারা, কীর্তন গায়িকা রাধারাণী কেউ বাদ যেতেন না (আরো অনেকে আসতেন যাদের নাম উল্লেখ করা হয়নি) ১৯২৩ সাল থেকে একটানা জমজমাটভাবে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত হয়েছে সে অনুষ্ঠান।

১৯৩০ সালের মধ্যেই মোহিনী মিলসের আরেকটি ইউনিট গড়ে ওঠে কলকাতার বেলঘরিয়ায়।

১৯৪২ সালের মোহিনী মিলসের একটি বিবৃতিতে দেখা যায় সময়ের মধ্যে মোহিনী মিলসের দুটি ইউনিটেই আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন ঘটে। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর স্বভাবতই মিলটি পাকিস্তানে চলে যায়। বাংলার পূর্ব অংশের নামকরণ হয় পূর্ব পাকিস্তান।

সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকাল হওয়া সত্ত্বেও মিলটি ৩৫.৬২ লাখ টাকা মুনাফা করে এবং ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। ১৯৩৮-১৯৫৫ পর্যন্ত মিলটির গড় মুনাফা ছিল কমপক্ষে ১৩ শতাংশ। মিলটি এই সময়ে ছিল তার যাত্রার শীর্ষে। সময়ে মিলের অনুমোদিত মূলধন ছিল ৬০ লাখ টাকা এবং সাবস্ক্রাইবড মূলধন ছিল ৫৯ লাখ ৯৮ হাজার ৮১৮ টাকা। মিলের ছিল ৪৮ হাজার ৪৬০ স্পিন্ডল (সুতা কাটার টাকু) ৯৭৫টি তাঁত। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত লাভজনকভাবেই চালু ছিল। নিয়মিত লভ্যাংশ প্রদানসহ আয়কর পরিশোধিত ছিল।

মিলটিতে বড় ধাক্কা আসে ১৯৬৫ সালের ভারত-পকিস্তান যুদ্ধের পর। তত্কালীন পাকিস্তান সরকার মিলটিকে শত্রু সম্পত্তি ঘোষণা করে মিলের মালিকদের দেশছাড়া করে। মিলের সব জমি, যন্ত্রপাতি, স্কুল, মন্দির, খেলার মাঠ, পুকুর, মার্কেট, হাসপাতাল সবই পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের হাতে দিয়ে দেয়া হয়।

১৯৬৫ সালের পর থেকে মিলটির পতন শুরু। ওই বছর থেকেই মিলটি লোকসান গুনতে থাকে। ১৯৬৭ সালে কোনো কারণ ছাড়াই মিলের উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করা হয়। মিলের অভ্যন্তরে শুরু হয় শ্রমিক অসন্তোষ। এর পরের কয়েক বছর ইতিহাস ছিল খুবই নাজুক। দেশে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে একেবারেই বন্ধ হয় যায় মিলটি। সময় মিলের অভ্যন্তরে চলতে থাকে নানা অরাজকতা। স্থানীয় একটি কুচক্রি মহল মিলের এক শ্রেণীর কর্মচারী যোগসাজশ করে মিলের অভ্যন্তরে ব্যাপক লুটতরাজ কায়েম করে। উঠিয়ে নিয়ে যায় মিলের মূল্যবান সম্পদ; দখল করে নেয় মিলের প্রচুর জমি। জানা যায় এখনো মিলের প্রচুর জমি এসব কুচক্রি মহলের দখলে রয়েছে।

স্বাধীনতা-পরবর্তীকাল

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার রাষ্ট্রপতির ২৭নং আদেশবলে মিলটি জাতীয়করণ করে বাংলাদেশ বস্ত্র শিল্প করপোরেশনের পরিচালনায় ন্যস্ত করেন। প্রতিষ্ঠানটি কিছুদিন চালু থাকার পর আবার বন্ধ হয়ে যায়। অত্যধিক লোকসানের কারণে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চালানোর অযোগ্য বিবেচিত হওয়ায় ১৯৮১ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে মিলটি গুটিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মিলটি বন্ধ করে দেয়া হয়। একই সঙ্গে মিলটির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে দায়দেনা মেটানোর জন্য একজন লিকুইডেটর নিয়োগ দেয়া হয়। মিলটির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ দরদাতা নজরুল ইসলামের কাছে ১১ কোটি ২৬ লাখ টাকায় এক বিক্রয় চুক্তিমূলে ১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বর হস্তান্তর করা হয়। ১৯৮৬ সালের ২০ জানুয়ারি এক ত্রিপক্ষীয় চুক্তিমূলে গুটানো মোহিনী মিলের হস্তান্তরিত সম্পত্তির ক্রেতা নজরুল ইসলামের স্থলে মেসার্স শাহ মখদুম টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের নামে গ্রহণ করা হয় এবং ওই কোম্পানি নজরুল ইসলামের স্থলাভিষিক্ত হয়। ক্রেতা কোম্পানি তাদের নিজস্ব সম্পত্তি বন্ধক রেখে এবং গোটানো মোহিনী মিলের সম্পত্তির ওপর দ্বিতীয় চার্জ সৃষ্টি করে অগ্রণী ব্যাংক কুষ্টিয়া বড়বাজার শাখা থেকে প্রায় কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে। কিন্তু মিলের পুরনো অংশটি পুনরায় চালু করার শর্ত জুড়ে দেয়ার কারণে কাঙ্ক্ষিত গুণগত উৎপাদন না হওয়ার ফলে মালিক পক্ষকে কোটি কোটি টাকা লোকসান দিতে হয়। লোকসানের কারণে ১৯৮৮ সালের ২৫ মে মিলটি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯১ সালের ২০ জানুয়ারি মিলটি বিক্রির জন্য আবারো দরপত্র ডাকা হয়। তখন অগ্রণী ব্যাংক নজরুল ইসলাম মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন। আদালত নিষেধাজ্ঞা জারি করলে বিক্রি কার্যক্রম স্থগিত হয়।

২০০৯ সালে শাহ্ মখদুম তৃতীয় আরেকটি পক্ষ দ্য পিপলস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস করপোরেশন (পিডিএসসি) লিমিটেডের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিলটি চালুর চুক্তি করে। চুক্তিতে বলা হয়, বস্ত্র পাট মন্ত্রণালয়ের হিসাবে সরকার মোহিনী মিলস বাবদ ক্রেতার (নজরুল) কাছ থেকে বিক্রীত মূল্য, সরকারের হাতে থাকার সময়ে নেয়া ঋণ অনুদানের সুদ-আসলে (১৯৮৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত) মিলে ৪৮ কোটি ৩৯ লাখ ৭৩ হাজার টাকা পাবে। এর মধ্যে ৩০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা চুক্তি স্বাক্ষরের তিন মাস এবং বাকি ১৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা পরবর্তী এক বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। ২০০৯ সালের ১০ ডিসেম্বর করা ওই চুক্তিতে বলা হয়, আগের মামলা প্রত্যাহার করতে হবে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে সরকারের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিতে পারবে না। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে পাওনা পরিশোধ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। ফলে মন্ত্রণালয় আবদুল মতিন নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আবার একই দামে বিক্রির চুক্তি করে। কিন্তু তখনো সঙ্গে ছিল পিডিএসসি। চুক্তি অনুযায়ী, সরকারকে কোটি ১০ লাখ এবং অগ্রণী ব্যাংককে ১১ কোটি টাকা পরিশোধ করে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তারা মিলটি চালায়। এরপর বন্ধ হয়ে যাওয়া মিলটি চলে যায় ইনারগোটেক লিমিটেডের হাতে।

বর্তমান অবস্থা

২০১১ সালে আব্দুল মতিন নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিক্রির চুক্তি করে সরকার। তারা কিছু টাকা পরিশোধ করে ২০১১ সাল পর্যন্ত। এরপর ২০১২ সালে মিল দেয়া হয় মেসার্স দিনার এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী এম আসলামকে। টাকা পরিশোধের জন্য তাকে সময় দেয়া হয় ২৮ দিন। স্বত্বাধিকারী অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরে মন্ত্রণালয় ইনারগোটেক লিমিটেডকে মিলটি দিয়ে দেয়। জমিসহ মিলটির দাম ৪৮ কোটি ৩৯ লাখ ৭৩ হাজার টাকা ধরে ইনারগোটেক লিমিটেডের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারাও সময়মতো টাকা না দেয়ায় মিলটি এখন পাট মন্ত্রণালয়ের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়া বা ধার পরিশোধ নিয়ে কাজ করে যে শাখা সেই লিকুইডেশন বা অবসায়ন শাখার তত্ত্বাবধানে। মিলটির বর্তমান মূল্যের মূল্যায়ন চলছে। এর স্থাবর সম্পত্তির মূল্যায়ন করছেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আর অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য নির্ধারণের জন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

মিলের ৯৯ বিঘা সম্পত্তির মধ্যে কারখানা আছে প্রায় ২৮ বিঘা জমির ওপর। কারখানার ভেতরের যন্ত্রাংশ পরিত্যক্ত। বিএমআরই ইউনিট এখন বন্ধ। ওই জমিতে চারটি মসজিদ, চারটি মন্দির, একটি স্কুল, একটি কলেজ, খেলার মাঠ, একটি দাতব্য হাসপাতাল রয়েছে। বেশকিছু জমি স্থাপনা বিভিন্ন প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে।

মিলের পুরো জায়গাটি কুষ্টিয়া পৌরসভার মধ্যে। জমির বর্তমান মূল্যমান বিচেনায় কাঠাপ্রতি দাম বর্তমানে ২০ লাখ টাকার ওপরে। সেই হিসাবে ৯৯ বিঘা জমির বাজারদর প্রায় ২০০০ কোটি টাকা।

 

. আমানুর আমান: লেখক  গবেষক