মওলানা ভাসানীর আওয়ামী লীগ থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কি?

আনিকা মাহজাবিন

ছবি: সংগৃহীত

সাতচল্লিশে দেশভাগের কয়েক বছরের মধ্যেই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি করে গড়ে তোলা হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ, যা ছিল তখনকার অন্যতম শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দল। এর প্রায় আট বছর পর পররাষ্ট্রনীতিগত মতানৈক্যের জন্য দলে প্রথম ভাঙন দেখা দেয়। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে দলটির একাংশ মিলে গঠন করে নতুন দল—ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মওলানা ভাসানী বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি আওয়ামী লীগের রাজনীতির ধরনেও বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। 

ষাটের দশকের শেষ দিকে পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর দ্বন্দ্ব তীব্র হয়। ওই সময় আওয়ামী লীগের ভাসানী অংশের উদ্যোগে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ২৪-২৫ জুলাই গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনের মধ্য দিয়েই গঠিত হয় পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। এর সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সম্পাদক নির্বাচিত হন পশ্চিম পাকিস্তানের মাহমুদুল হক ওসমানী। 

আওয়ামী লীগের ভাঙন প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদরুদ্দীন উমর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার প্রশ্নে ১৯৫৭ সালে কমিউনিস্টদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটা বিরোধ হলো। মওলানা আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিলেন। আমি মনে করি, সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে সোহরাওয়ার্দীদের সঙ্গে যতই বিরোধ হোক, মওলানার আওয়ামী লীগ ছাড়া ঠিক হয়নি। ছেড়ে যাওয়ার পেছনে তার নিজের একটা চিন্তা ছিল, আর কমিউনিস্টদের একটি ইন্ধন ছিল। এ সিদ্ধান্তে খুব অসুবিধা হলো। দলটিতে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বামপন্থীদের যে অংশ ছিল, সেই অংশটা বের হয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ একটি দক্ষিণপন্থী দলে পরিণত হলো। আওয়ামী লীগের মধ্যে যে বামপন্থী প্রবণতা ছিল, সেটি চলে গেল। আবুল মনসুর আহমদ, আতাউর রহমান—তাদের নিয়ে আওয়ামী লীগ পুরোপুরি দক্ষিণপন্থী সংগঠন হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। ১৯৫৭ সালের আগে আওয়ামী লীগ এমনটা ছিল না। এটা পরবর্তী রাজনীতিতে ক্ষতির কারণ ছিল।’ 

বদরুদ্দীন উমর বলেন, ‘একটি বিষয় লক্ষণীয়। সেটা হলো, ১৯৪৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ একটি জাতীয়তাবাদী দল ছিল। পরে তা উগ্র জাতীয়তাবাদী দলে পরিণত হলো।’ 

ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেন মওলানা ভাসানী। তার রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে প্রধানত গ্রামীণ কৃষকদের কেন্দ্র করে। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অধিকাংশ কর্মসূচিও ছিল কৃষকদের স্বার্থকেন্দ্রিক। তার ‘ভাসানী’ নামের উৎপত্তি হয় কৃষক আন্দোলন করতে গিয়েই। আসামের ধুবড়ি জেলায় ব্রহ্মপুত্রের ভাসান চরে ১৯২৯ সালে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন তিনি। সেখান থেকেই প্রথম মওলানা ভাসানী নামে পরিচিত হন তিনি। 

পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে সবচেয়ে প্রতিবাদী রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন এ নেতা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকাকালে যুক্তফ্রন্ট মোর্চায় যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৪ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন লাভ করে।

এ প্রসঙ্গে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তখন আওয়ামী লীগের মধ্যে বিতর্ক ছিল। বিতর্কটি ছিল সোহরাওয়ার্দী বনাম ভাসানীর মধ্যে। যেহেতু তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল, তাই তারা স্ট্যাটাস কো মেনে চলতে চেয়েছে। কিন্তু ভাসানী এটি পছন্দ করেননি। সে সময় কাগমারীতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল মিটিং হয়। সেখানে মওলানা ভাসানী পদত্যাগ করেন। মওলানা ভাসানী পদত্যাগ করার আগে-পরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যারা বামপন্থী ছিলেন, তারাও বেরিয়ে যান আওয়ামী লীগ থেকে। কিছুদিন পর তারা (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) ন্যাপ গঠন করেন।’ 

ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে ন্যাপের ছিটকে পড়া প্রসঙ্গে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ন্যাপের মধ্যে অনেক কমিউনিস্ট কাজ করতেন। এদিকে ১৯৬৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে যায়। তার এক বছরের মধ্যে মস্কো ও পিকিংপন্থী ন্যাপও ভেঙে যায়। তখন ন্যাপ সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার কথা বলে, সমাজতন্ত্রের কথা বলে। এদিকে ছয় দফা ঘোষণার পর জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। তখন এ জাতীয়তাবাদী স্লোগান আওয়ামী লীগ লুফে নেয় এবং এর মধ্য দিয়েই খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এটি ঘটার ফলে ন্যাপ অনেকটা প্রান্তিক অবস্থায় চলে যায়। অন্যদিকে ১৯৬৪ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাদীদের একটি প্রভাব আমাদের পিকিংপন্থীদের ওপর পড়ল। তখন তরুণরা অনেকেই এদিকে ঝুঁকল যে কোনো গণসংগঠন রাখা যাবে না। সেজন্য তারা গণসংগঠনগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দিল। ছাত্র ইউনিয়ন, শ্রমিক ফেডারেশন, কৃষক সমিতি—এসব দুর্বল হয়ে গেল; ন্যাপ দুর্বল হয়ে গেল। তার সঙ্গে যোগ হলো নির্বাচন বর্জন। মওলানা তখন কমিউনিস্টদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এ কাজটি করলেন। রাষ্ট্রক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চর্চা থেকে ন্যাপ ছিটকে পড়ল। এর ফলে আওয়ামী লীগের লাভ হলো। দলটি ফাঁকা মাঠ পেল। কারণ ন্যাপের প্রবল প্রতিপক্ষ হওয়ার যে সম্ভাবনা ছিল, সেটি আর থাকল না।’ 

মহিউদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, ‘পিকিংপন্থী কমিউনিস্টরা মওলানা ভাসানীর ওপর এমনভাবে ভর করেছিল যে তারা ১৯৭০ সালের নির্বাচন বর্জনের স্লোগান দিল। ভাসানী তখন তাদের ফাঁদে পড়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। আওয়ামী লীগ একচেটিয়া দল হয়ে গেল। নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার কারণে ন্যাপ অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেল। অন্যদিকে মস্কোপন্থী ন্যাপ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি নিয়েছিল। কারণ এটিই ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসক্রিপশন। সে অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে মস্কোপন্থী ন্যাপ নিজেদের স্বাতন্ত্র্য হারাল। এভাবে ন্যাপ দুর্বল হতে থাকে।’ 

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠা হয় আওয়ামী মুসলিম লীগের। এ দল গঠনে মুখ্য ভূমিকা রাখেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একটি অংশ। দলটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী আর শামসুল হক ছিলেন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে। শেখ মুজিবুর রহমান (তখন কারাবন্দি) ছিলেন যুগ্ম সম্পাদক।  

বিশ্লেষকদের মতে, মওলানা ভাসানী থাকার সময় আওয়ামী লীগে বামপন্থী রাজনীতিবিদদের প্রভাব ছিল। তৎকালীন রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বাম রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু মওলানা ভাসানী নতুন দল গঠন করার পর থেকেই আওয়ামী লীগ থেকে বামপন্থী নেতারা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। 

এ বিষয়ে কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশের (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তার নীতি থেকে সরে গেছে। বামপন্থীরা আওয়ামী লীগ থেকে সরে যাননি। ভাসানী ন্যাপ গঠনের আগেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। তিনি বলেন, বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবির আর প্রয়োজন নেই; ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন হয়ে গেছে। তিনি জোট নিরপেক্ষনীতি অনুসরণ না করার কথাও বলেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের একটি বিখ্যাত উক্তি ছিল—শূন্য যোগ শূন্য সমান শূন্য। এসবের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের আদর্শ থেকে বিচ্যুতি ঘটে। সে সময় আওয়ামী লীগে যারা বামপন্থী ছিল, তারা সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মতো একই কাজ করবে না বলে ন্যাপ গঠন করেন। ন্যাপ থাকার ফলেই বাঙালির স্বাধিকার দাবিটা বিসর্জন না দিয়ে আবারো সোচ্চার হয়ে ওঠে।’ 

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘এদিকে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগকে আবারো পুনর্জীবিত করেন। সে সময় বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বাধিকার প্রশ্নে শক্ত পদক্ষেপ নেন; যা তাকে বাঙালির মুখপাত্র ও নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম করে তোলে। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও দলের ঊর্ধ্বে শেষ পর্যন্ত তিনি যেতে পারেননি। তার দলও শ্রেণীভিত্তির ওপর উঠতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্র ত্যাগ করে বাজার অর্থ ব্যবস্থার নামে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা চালু করেছে।’

এ প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক পত্রিকা হক কথার সম্পাদক সৈয়দ ইরফানুল বারী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ছয়দিনের কাগমারী সম্মেলনের প্রথম তিনদিনেই হুজুর বুঝে গেলেন যে তার বক্তব্যকে সমর্থন দিয়ে কেউ কিছু বলছেন না। এমনকি শেখ মুজিবুর রহমানও তাকে সমর্থন দিয়ে সেই সম্মেলনে কিছু বলেননি। তখন তাদের মনোভাব এমন ছিল, ক্ষমতায় গেছে সেটিই অনেক। ওই সম্মেলনের এ বিষয়টি চারদিকে ছড়িয়ে গেল। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদ ও স্বায়ত্তশাসন—এ দুটি বিষয়ে ভাসানী আপস করেননি। পাশাপাশি তিনি চেয়েছিলেন সংস্কৃতি, সাহিত্য ও শিল্পের দিক থেকে সমৃদ্ধ প্রগতিশীল একটি দেশ, যেখানে রক্ষণশীলতা থাকবে না, বৈষম্য থাকবে না। এসব কারণে তিনি পদত্যাগ করেন। পরবর্তী সময়ে যখন ন্যাপ গঠন করেন, তখন পূর্ব পাকিস্তানের সব বামপন্থী দল যোগ দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানেরও কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা হুজুরের দলে ভেড়েন। আদর্শগত কারণে এ বিভাজন কোনোভাবেই ঠেকানো সম্ভব ছিল না।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন