উপসংহারেই হয়তো পৌঁছতে চায় সবাই

মাহমুদুর রহমান

সিরিজের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ছবি: আইএমডিবি

ছোটবেলা থেকেই কথা শুরু হয় আমাদের জীবনের লক্ষ্য নিয়ে। আর উপমহাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় পড়ানো হয় এইম ইন লাইফ। যদিও পড়াশোনা যত এগোয়, এইম ইন লাইফ তত বদলায়। মাঝে মাঝে আমরা ভুলেই যাই, এইম কী ছিল। লক্ষ্যের কাছে পৌঁছনো মনে হয় অসম্ভব। ‘জীবনের লক্ষ্য’র একটা বড় অংশে এসে বসে থাকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। আর দিনে দিনে সেই লক্ষ্যে আমাদের ঠেলে দিতে তৈরি হয় কোচিং সেন্টার। আমাদের দেশে ভর্তি মৌসুমে তাদের রমরমা ব্যবসা। কখনো সে ব্যবসার মধ্যে আবার থাকে দুই-একজন মরমী মানুষও। ‘কোটা ফ্যাক্টরি’র জীতু ভাইয়া তেমনই একজন। তিনি ছাত্রদের কেবল লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে চান না, সেই সঙ্গে লক্ষ্যের পথ চেনাতে আর পথ চলা শেখাতেও চান।

ভারতের রাজস্থানের শহর কোটা। এর একদিকে ইটের ভাটা, আরেক দিকে কোচিং সেন্টার। এত এত কোচিং সেন্টার তৈরি হয়েছে যে এখন কোটাকে বলা হয় কোটা ফ্যাক্টরি। কিন্তু কেন ফ্যাক্টরি? কেননা সেখানে শিক্ষার্থীদের কেবল ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা হয় না, তাদের ছাঁচে ফেলে তৈরি করা হয় নির্দিষ্ট মডেলে, যেন তারা বাকি সময় ওই মডেলের মতো এক সারি ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার তৈরি হতে পারে। এটাই তাদের জীবনের লক্ষ্য। যদি ১৫/১৬ বছরের সে ছাত্ররা এমনটা মনে না-ও করে, সময় নিয়ে তাদের ভেতর এ ধারণা ঢুকিয়ে দেয়াই কোটা ফ্যাক্টরির লক্ষ্য।

কিন্তু টিভিএফের সিরিজের তা লক্ষ্য নয়। এ সিরিজ বরং দেখায় কোটায় কী হচ্ছে। দেখানোর জন্য একটা রেফারেন্স হয়ে ওঠেন জীতু ভাইয়া আর তার কোচিং সেন্টার এইমার্স। তবে এটা অবশ্যই আর পাঁচটা ফ্যাক্টরির মতো কোটিং সেন্টার নয়। কেননা জীতু তার ছাত্রদের কাছে ‘জীতু ভাইয়া’। তিনি জীতু স্যার নয়। এখানেই এইমার্স অন্য কোচিংয়ে তুলনায় আলাদা। কেননা যদিও তারা আইআইটিতে যাওয়াকে ‘স্বপ্ন’ বলতে রাজি নয়, ‘লক্ষ্য’ বলে থাকে। কিন্তু এ সিরিজ প্রতি এপিসোডেই দেখায় জীতু আসলে একজন স্বাপ্নিক। সে স্বপ্ন দেখে তার ছাত্রদের নিয়ে। ব্যবসা করা তার উদ্দেশ্য নয়। কোটা ফ্যাক্টরি হয়ে গেলেও সেখানে জীতু অনেক বেশি মানবিক।

টিভিএফের সিরিজ ‘কোটা ফ্যাক্টরি’র তৃতীয় সিজন স্ট্রিম হলো। প্রথম সিজন ছিল টিভিএফের নিজস্ব নির্মাণ। এরপর যুক্ত হয় নেটফ্লিক্স। দ্বিতীয় সিজনে সিরিজের ওপর নেটফ্লিক্সের প্রভাব স্পষ্ট টের পাওয়া গেছে। কিন্তু তৃতীয় সিজন সে তুলনায় স্বতন্ত্র। কেননা নেটফ্লিক্স তাদের পশ্চিমা সিরিজে টিনএজদের মধ্যে যে ধরনের প্রেম, লাইফস্টাইল দেখাতে চায়, কোটা ফ্যাক্টরির দ্বিতীয় সিজনে উদয়-শিবাঙ্গী, বৈভব-বর্তিকার সম্পর্ক আর তাদের জীবনযাপনের ধরনে তার কিছুটা ছাপ ছিল। এমন নয় যে কোটা বা ভারতে এ জীবনযাপন নেই, কিন্তু সেটা নেটফ্লিক্স ঘরানার উপস্থাপন টিভিএফের এ সিরিজের জন্য কিছুটা চোখে লাগার মতো। কেননা প্রথম সিজনে কোটা ফ্যাক্টরির নিজস্ব একটা ধরন ছিল, দ্বিতীয় সিজনে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছেন নির্মাতারা। তবে প্রথম সিজনের মতো হলো না তৃতীয় সিজন। পুরো সময়টা মনে হলো একটা উপসংহারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

তবে এ সিরিজ জীতুকে নতুন করে চেনায়, বা বলা যায় তাকে ব্যাখ্যা করে। দর্শক দেখতে পায়, জীতু তার বন্ধুদের কাছ থেকে ধার নিয়ে চালাচ্ছে এইমার্স। তার নিজের কিছু ট্রমা আছে, যা নিয়ে দৌড়াতে হয় মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। অর্থাৎ কোটা ফ্যাক্টরির মূল চরিত্র হিসেবে পাওয়া উদয়, বৈভব, মীনা, বর্তিকা, শিবাঙ্গী, মিনালের পাশাপাশি জীতু এখানে গুরুত্ব পায়। মূলত প্রথম সিজনে অন্যতম মূল আকর্ষণ ছিল জীতু ভাইয়া। কিন্তু এবার ব্যক্তি জীতু বা জীতেন্দ্রর ভেতর ডুব মারার চেষ্টা করেছেন সিরিজের নির্মাতারা। তাকে নায়ক থেকে একজন ব্যক্তির পর্যায়ে আনা হয়েছে। দেখানো হয়েছে প্রত্যেকেরই বিশেষ একটা লক্ষ্য থাকে।

তৃতীয় সিজনেরও সিনেমাটোগ্রাফি আগের দুই সিজনের মতো। সাদাকালো টোনের সঙ্গে মানিয়ে গেছে একটা বিষণ্ন বেদনা। সিনেমাটোগ্রাফি মানে কেবল কালার টোন নয়, সেট ডিজাইন, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল থেকে প্রায় প্রতিটি বিষয়ই ভালোভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল এ সিরিজে। চিত্রনাট্যও তাই। মূল চরিত্রগুলোয় অভিনয়ে এবারো প্রতিবারের মতো ছিলেন জীতেন্দ্র কুমার (জীতু ভাইয়া), আলম খান (উদয় গুপ্ত), ময়ূর মোরে (বৈভব পাণ্ডে), রঞ্জন রাজ (বালমুকুন্দ মীনা), রেবতী পিল্লাই (বর্তিকা রাতাওয়াল), উর্বি সিং (মিনাল পারেখ), এহসাস চানা (শিবাঙ্গী রানাওয়াত), হরিশ পেডিনতি (বাবলু) ও রাজেশ কুমার (গগন রাস্তোগি)। তিন এপিসোডে পূজা চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিলোত্তমা সোম, কিন্তু তিন এপিসোডে তিন সিজনের সমান প্রভাব রেখেছেন তিনি। আর এবারো একটা মনোলগ দিয়ে মন জয় করেছেন ময়ূর মোরে।

কোটা ফ্যাক্টরির তৃতীয় সিজন শেষ হয় ছাত্রদের পরীক্ষার ফল দিয়ে। আর জীতুর এইমার্স ছাড়ার মধ্য দিয়ে। সিরিজের শেষ দৃশ্যটা গুরুত্বপূর্ণ। গাড়িতে জীতু আর অটোরিকশায় বৈভব যখন পাশাপাশি এক রাস্তায় চলে আর ওপর থেকে নেয়া শট আমাদের দেখায় একটা সময় তাদের পথ আলাদা হয়ে গেল, কোটা ফ্যাক্টরি বুঝিয়ে দেয় লক্ষ্য ঠিক থাকলেও কখনো কখনো পথ বদল জরুরি আর শেষমেশ উপসংহারেই হয়তো পৌঁছতে চায় সবাই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন