৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ

৬৭ বছর আগে পররাষ্ট্রনীতিকে ঘিরে ভাঙন হয় আওয়ামী লীগে

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর তীব্র বিরোধ দেখা দেয়। সোহরাওয়ার্দী ঝুঁকে পড়েন মার্কিনপন্থী পররাষ্ট্রনীতির দিকে। অন্যদিকে ভাসানীর চাওয়া ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি। পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ডানপন্থী নেতাকর্মীরা সোহরাওয়ার্দীর পক্ষ নেন। বামপন্থী অংশ মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি ও পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলেন। ফলে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে পড়ে। 

১৯৫৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (বর্তমান আওয়ামী লীগ) ভেঙে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। ওই ভাঙনের প্রায় ৬৭ বছর পরও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আওয়ামী লীগে চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করছেন দলটির বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা। যদিও তাদের মতে, এ চ্যালেঞ্জ আগের মতো তীব্র নয়। 

এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এ কে আব্দুল মোমেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বৃহৎ একটি দল হওয়ায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন মতের হতে পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জীবনজুড়েই ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী নেতা। কখনো কোনো জোটে যোগদানের পক্ষে তিনি ছিলেন না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও সেভাবেই নিরপেক্ষ জায়গা থেকে এগিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী যতদিন আছেন ততদিন আওয়ামী লীগ এ নিরপেক্ষ জায়গাটি ধরে রাখবে। এরপর আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে সংকট হবে কিনা সেটি তো বলতে পারছি না।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক থেকে এটি স্পষ্ট যে বাংলাদেশ সবার সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই সবার সঙ্গে বাংলাদেশের উষ্ণ সম্পর্ক রয়েছে।’ 

পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে ষাটের দশকের শুরুতে আওয়ামী মুসলিম লীগের নীতি ছিল স্পষ্ট। দলটি চেয়েছিল জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি এবং একটি ফেডারেল কাঠামোর আওতায় কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন পরিপূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এ ঘোষিত নীতি থেকে সরে আসেন। তিনি সিয়াটো ও সেন্টোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক চুক্তির মাধ্যমে পাশ্চাত্যের জোটভুক্তি নীতির প্রবক্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৬-৫৭) সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে গণপরিষদের সদস্য ও দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সে সময় প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দীর এ নীতিকে সমর্থন জানান। 

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক কখনো বেশি ভালো ছিল, কখনো কম ভালো ছিল। এ অবস্থা সব সময়ই বিরাজ করে এসেছে। আবার মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা আমাদের বিরুদ্ধে গেছে। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় মন্ত্রিপরিষদকে চাপ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আপস করলে যুদ্ধ হতো না। বিভিন্ন বিষয় তো রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে শত্রুও মনে করি না, বন্ধুও মনে করি না। তাদের সঙ্গে বেশি বন্ধুত্ব যাদের, তাদের শত্রুর দরকার নেই। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগতভাবে মোটামুটি ভালো সম্পর্ক রাখতে চাই।’ 

১৯৫৫ সালের অক্টোবর ও ১৯৫৬ সালের মে মাসে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তাদের দলীয় কাউন্সিল অধিবেশনগুলোয় সামরিক জোটের বিষয়ে অবস্থান ব্যক্ত করে। এমনকি ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগ সামরিক চুক্তিগুলোকে পার্লামেন্টে তোলার দাবি জানায়। ওই সময় দলটি বলে, পার্লামেন্টে যেসব চুক্তি অনুমোদন পেতে ব্যর্থ হবে, সেগুলো বাতিল হয়ে যাবে। 

এ ইস্যুতে ভিন্ন অবস্থান নেন দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানী। পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সাম্রাজ্যবাদীদের উসকে দেয়া বিরোধে নিজেরা জড়িত হলে তা হবে আত্মহত্যার শামিল।’ পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নে তার অবস্থান পুনরাবৃত্তি করে এশিয়া ও আফ্রিকাকে সাম্রাজ্যবাদী প্রভাবমুক্ত করার জন্য এ অঞ্চলের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে বলিষ্ঠ ও স্বাধীন নীতি গ্রহণের সুপারিশ করেন তিনি। 

পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চরম পর্যায়ে পৌঁছায় ১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারি, কাগমারী সম্মেলনে। এ নিয়ে ওই সময় সোহরাওয়ার্দী ইস্তফা দেয়ার প্রস্তাবও দেন। 

কাগমারী সম্মেলনে পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকাকে কেন্দ্র করে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক ভাঙন এড়ানো সম্ভব হয়েছিল বটে, কিন্তু তা দলের ঐক্যকে দুর্বল করে দেয়। এক পর্যায়ে এ আদর্শিক কারণে বিভক্ত হয়ে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। সভাপতির পদ ত্যাগ করেন মওলানা ভাসানী। 

ওই সময় আওয়ামী লীগের ভাসানী অংশের উদ্যোগে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ২৪-২৫ জুলাই গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সম্পাদক নির্বাচিত হন পশ্চিম পাকিস্তানের মাহমুদুল হক ওসমানী। ওই সময় দলটির উল্লেখযোগ্য নেতা ছিলেন পূর্ববাংলা থেকে হাজী মুহাম্মদ দানেশ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, মহিউদ্দিন আহমদ, মশিউর রহমান (যাদু মিয়া), পীর হাবিবুর রহমান, এসএ আহাদ, আবদুল মতিন, আবদুল হক ও আতাউর রহমান। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের মধ্যে ছিলেন ওয়ালি খান।

আওয়ামী লীগের সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মোনায়েম সরকার এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতির দিকে ঝুঁকেছিল। কিন্তু তা গ্রহণ করেনি। ওই সময় মওলানা ভাসানী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে খুব সরব ছিলেন। স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ভেঙে গিয়ে মওলানা ভাসানী, মোজাফ্ফর আহমেদ এবং পাকিস্তানের অলি খানের মতো নেতাদের নিয়ে ন্যাপের জন্ম হলো।’

মোনায়েম সরকার বলেন, ‘স্বাধীনতার পর জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে বলেছিলেন, “পৃথিবী দুই শ্রেণীতে বিভক্ত—শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।” তার পরও ক্ষমতায় থাকলে কিছুটা ব্যালান্স করতে হয়। আমেরিকাকে কিছুটা পাত্তা দিতে হয়েছে। না হলে আমেরিকা যদি আমাদেরকে বয়কট করে, অর্থনৈতিক সাহায্য না দেয়। এখনো আমেরিকা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে চায় না। কিন্তু ভারত ও চীন পক্ষে থাকায় তারা সেটি পারবে না।’ 

যদিও বর্তমান আওয়ামী লীগে পররাষ্ট্রনীতি কেন্দ্রিক কোনো সংকট নেই বলে মনে করছেন কোনো কোনো নেতা। দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘১৯৫৭ সালের পররাষ্ট্রনীতিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের যে বিভাজন হয়েছিল, তার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে তখনকার বৈশ্বিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন, এ দুই মেরুতে বিভক্ত ছিল বিশ্ব। বিভাজনের আরো একটি বড় কারণ হলো, আওয়ামী লীগের মধ্যেই পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে নিজস্ব মতামত তুলে ধরার মতো জাতীয় নেতা ছিলেন। বর্তমান সময়ে এ দুটি বিষয় অনুপস্থিত। প্রথমত, বলা যায় বর্তমান বৈশ্বিক ব্যবস্থা আগের মতো নয়। বাংলাদেশ সবার সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে। দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার ফলে দীর্ঘদিন রাজনৈতিক শূন্যতা ছিল। সবশেষ ১৯৮১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই শূন্যতা পূরণ করেন। ভাসানীর মতো নিজস্ব দর্শনে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কথা বলার মতো লোক আওয়ামী লীগে এখন নেই।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগ ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাসী। জাতির পিতা নির্দেশিত “সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়”—এ নীতিকে ধারণ করে আওয়ামী লীগ এগিয়ে চলছে। এ পররাষ্ট্রনীতির কারণেই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন