ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

ঋণনির্ভর অবকাঠামো দিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর এফডিসিতে গতকাল ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত অর্থনৈতিক সুরক্ষায় আগামী বাজেটের কৌশল নিয়ে ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, শুধু ঋণনির্ভর অবকাঠামো প্রকল্প দিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। বৈদেশিক ঋণের বোঝা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এখনো আশঙ্কাজনক নয় বলা হলেও এ বোঝা কিন্তু আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। কাজেই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

গতকাল রাজধানীর এফডিসিতে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত অর্থনৈতিক সুরক্ষায় আগামী বাজেটের কৌশল নিয়ে ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।

অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, ‘বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দেউলিয়া হওয়ার অবস্থায় নেই। এ ধরনের একটা বিষয়ে আমরা আশ্বস্ত হওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু বাজেটও যে ঋণের ফাঁদে পড়তে পারে, সে আলোচনা আমরা করছি না। কারণ, ক্রমাগতভাবে ঋণ নিতে থাকলে, সুদ-আসল পরিশোধ করতে গেলে, আর তো কিছু বাকি থাকে না। এটা একটি দুষ্টচক্র। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে গেলে মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে, বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্য আনতে হবে। দুর্বল রাজস্ব সংগ্রহের ব্যবস্থা দিয়ে আমরা উচ্চ মধ্যম বা উন্নত দেশে রূপান্তরিত হতে পারব না। কোনো দেশ সেটা পারেনি।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘যেকোনো সরকারি সেবা নিতে গেলে বাংলাদেশের মানুষকে দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার হতে হয়। সরকারি অর্থের অপচয় হলে, অর্থের মান কমে গেলে কিংবা সেবা নিতে গেলে যদি দুর্নীতি হয়, তাহলে জনগণের কাছ থেকে বেশি কর আদায়ের নৈতিকতা বা গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। এটা একটা বড় নৈতিকতার প্রশ্ন।’

এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘কর ব্যবস্থায় আয়করসহ অন্যান্য করের ফাঁকি যদি আমরা কমাতে না পারি এবং আস্তে আস্তে পরোক্ষ করের প্রতি নির্ভরশীল হয়েই কেবল রাজস্ব বাড়াতে চেষ্টা করি, তাহলে কর ব্যবস্থায় বৈষম্য আরো বেড়ে যাবে। এমনিতেই আমাদের দেশে এখন আয়ের বৈষম্য বাড়ছে। তার ওপর যদি এমন কর ব্যবস্থা আরো জোরদার করা হয়, যেটা কর বৈষম্য আরো বাড়িয়ে দেবে, সেটা তো গ্রহণযোগ্য নয়। একটা কথা আছে, দুর্বল হরিণকেই বাঘ শিকার করে। এ ধরনের করনীতিতে সেটাই হয়ে যাচ্ছে।’

আয়কর ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে ভ্যাটের মতো পরোক্ষ করের ওপর বেশি নির্ভর করতে হয় জানিয়ে এ অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘পরোক্ষ করের বোঝা তো অবশ্যই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ওপর পড়ে। সেখানেও ব্যবসায়ীদের মধ্যে বড় অংশই ঠিকমতো ভ্যাট দেন না। অথচ ভ্যাট আরোপের ফলে দ্রব্যমূল্য ঠিকই একই হারে বাড়ে, কিন্তু সরকার রাজস্ব পায় না। কারণ, অধিকাংশ ব্যবসায়ীই ভ্যাট দেয় না।’

অধ্যাপক ওয়াহিদ বলেন, ‘আয়কর ফাঁকির কারণে রাজস্ব সংগ্রহের সহজ উপায় হিসেবে উৎসে কর কাটা হয়। এবার উৎসে করের ব্যাপ্তি আরো সম্প্রসারণ করার প্রস্তাব এরই মধ্যে শোনা যাচ্ছে সরকারের কাছ থেকে। উৎসে করের মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহ একটি সহজ উপায়। কিন্তু এ করের বোঝা শেষ পর্যন্ত কার ওপর গিয়ে পড়ে, সেটা বিশ্লেষণ করা কঠিন। এ ধরনের উৎসে করের ওপর নির্ভরতা ভালো করনীতি নয়। এটাতে অসংগতি তৈরি হয়।’

ভ্যাটের সঙ্গে সম্পূরক কর আদায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ করনীতি শুধু ভোগ্যপণ্যের ওপর হওয়া উচিত। এটাই হলো করের মূলনীতি। অথচ আমরা আবারো সহজ কর সংগ্রহের উপায় হিসেবে উৎপাদন উপকরণের ওপর ভ্যাট বসিয়ে দেই। যেমন জ্বালানির মতো একটা সর্বজনীন উৎপাদন উপকরণের ওপর বড়হারে কর বা সম্পূরক কর বসিয়ে দেই। এগুলো বিভিন্ন পণ্য এবং সেবা খাতের ওপর অপরিকল্পিতভাবে গিয়ে পড়ে। এটাও ভালো করনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’

দেশীয় অনেক শিল্পে উল্লেখযোগ্য প্রণোদনা দেয় সরকার। এ বিষয়ে এ অধ্যাপক বলেন, ‘এটা ঠিক যে দেশীয় অনেক শিল্পের সংরক্ষণ সুবিধা দরকার। কিন্তু এ সংরক্ষণ সুবিধার যে বিন্যাস, এটা বিশ্লেষণ করার সক্ষমতা আমাদের নেই বা ইচ্ছে করেই আমরা করি না। কারণ, শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে যাদের শক্তি আছে, তারা এর সুবিধা নিয়ে নেয়। এর ফলে কিছু অসংগতি দেখা দেয়। এক বছর কিছু অসংগতি ঠিক করা হলে পরের বছর অন্য অসংগতি দেখা দেয়। কারণ এগুলো চাপের ফলে তৈরি করা হয়, পরিকল্পিতভাবে হয় না। সবচেয়ে বড় কথা হলো ২০২৬ সালের পর আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে যাব। তখন একতরফা শিল্প সুবিধা পাওয়ার দাবি আমরা করতে পারব না। তখন আমাদের বিশ্ববাজারে আরো প্রতিযোগিতামূলকভাবে পণ্য উৎপাদন করতে হবে। সেখানে শিল্প সংরক্ষণ সুবিধাকে আরো যৌক্তিক করতে হবে। শিল্পকে আরো দক্ষতা অর্জন করতে হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন