কর কমালে ব্যাংক খাত অর্থনীতিতে আরো জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবে

ছবি : বণিক বার্তা

যেকোনো দেশের অর্থনীতির ‘হৃৎপিণ্ড’ হলো ব্যাংক খাত। এ খাতের সুস্থতার ওপর নির্ভর করে সে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধি। পুঁজিবাজার ম্রিয়মাণ হওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতির ৯০ শতাংশের বেশি ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ৬১টি তফসিলি ব্যাংক। এর মধ্যে ৪৩টি ব্যাংকই বেসরকারি খাতের। নয়টি ব্যাংক সরকারি বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত এবং বাকি নয়টি বিদেশী। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে দেশের ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ঋণ ও বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২০ লাখ ৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪ লাখ ২৭ হাজার ১৭২ কোটি টাকার ঋণ গেছে সরকারি খাতে। বেসরকারি খাতে গেছে বাকি ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকার ঋণ। ব্যাংকগুলোয় জমা আছে গ্রাহকদের ১৬ লাখ ৬২ হাজার ২৩১ কোটি টাকার আমানত। অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড হিসেবে ভূমিকা রাখলেও দেশের ব্যাংক খাত এখন বহু সমস্যায় জর্জরিত। সুশাসনের তীব্র ঘাটতি ও খেলাপি ঋণের ভারে বেশির ভাগ ব্যাংকই এখন দুর্বল। এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। আস্থার সংকট তৈরি হওয়ায় ব্যাংকে প্রত্যাশা অনুযায়ী আমানতও বাড়ছে না। এ অবস্থায় বাজেটে ব্যাংক খাত সংস্কারে সরকারের কাছ থেকে কার্যকর ঘোষণা প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।


সরকারের কাছে কেমন বাজেট চান?

বর্তমান বিশ্ব প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রপঞ্চ নিয়ে হাজির হচ্ছে। আমরা আজ যেটি ভাবছি, কাল তার বিপরীত কিছু ঘটে যাচ্ছে। কভিড-১৯-এর মতো বৈশ্বিক মহামারী যেমন আমাদের জন্য অপ্রত্যাশিত ছিল, ঠিক তেমনি অপ্রত্যাশিত ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ফিলিস্তিনসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যেও যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জাহাজ চলাচলসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। বৈশ্বিক এসব সংকটের পাশাপাশি আমাদের অভ্যন্তরীণ সংকটও কম নয়। প্রায় দুই বছর ধরে দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য ও ডলার সংকট চলছে। অর্থনীতিতে বিরাজ করছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপও। আশার কথা হলো এ রকম একটি পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির ধারায় আছে। সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রণয়ন করতে যাচ্ছে বলে শুনেছি। আমরা চাই, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল গণমুখী ও শিল্পবান্ধব বাজেট হোক। অর্থনীতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হলে দেশের শিল্পকে বাঁচাতে হবে। কর ব্যবস্থাকে সর্বজনীন করে গড়ে তুলতে হবে।

শিল্পের বিকাশে বাজেটে কোন দিকটিতে বেশি নজর দেয়া দরকার বলে মনে করেন?

একসময় বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল পুরোপুরি কৃষিনির্ভর। শ্রমশক্তির বড় অংশের কর্মসংস্থানও ছিল কৃষিতে। কিন্তু এখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা রাখছে শিল্প খাত। দেশের শ্রমশক্তির উল্লেখযোগ্য অংশ তৈরি পোশাকসহ শিল্প খাতে নিয়োজিত। রফতানি আয়ের প্রায় পুরোটাই শিল্প খাত থেকে আসছে। দেশের কৃষিকে কেন্দ্র করেও এখন দেশে অনেক ধরনের শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। সরকার কয়েক দফায় গ্যাস, জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। প্রয়োজন ও বাস্তবতার নিরিখেই হয়তো বাড়ানোর প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু দাম বাড়ার পরও দেশের শিল্প-কারখানাগুলো নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। এ কারণে দেশের অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। উৎপাদন সচল থাকলেও অনেক কারখানার সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার হচ্ছে না। এ অবস্থায় শিল্পের উৎপাদন নির্বিঘ্ন রাখার জন্য নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ প্রয়োজন। আশা করছি, সরকার বাজেটে এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখবে।

ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার ব্যাংক ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। এখন মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে সুদহার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এতে ঋণের সুদহার প্রায় ১৪ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। এ পরিস্থিতিকে কীভাবে দেখছেন?

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কোনো দেশেই ঋণের সুদহার নির্ধারণ করে দেয়া যায় না। এটি করা ঠিকও নয়। প্রয়োজনের নিরিখে ২০২০ সালের এপ্রিলে সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। সাময়িক সময়ের জন্য সেটি হয়তো ঠিক ছিল। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে একই সুদহারে চলতে পারে না। বাজারে চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে ঋণের সুদহার ঠিক হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন যে নীতি নিয়েছে, সেটিই সঠিক। তবে সুদহার যাতে অস্বাভাবিক বেড়ে না যায়, সেটিও দেখতে হবে। সুদহার, ডলারের দাম, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, শ্রমিকের মজুরি সবকিছুই বেড়ে গেছে। এখন যেকোনো ব্যবসার ব্যয় অনেক বেশি। এ ব্যয় সামলাতে ব্যর্থ হলে ব্যবসায়ীরা ঋণ খেলাপি হয়ে যাবে। উদ্যোক্তারা খেলাপি হয়ে গেলে ব্যাংকও বিপদে পড়বে।

গত আড়াই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ৩৮ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ডলারের মধ্যবর্তী দর নির্ধারণ করে দিয়েছে ১১৭ টাকা। এ বিষয়ে আপনার মূল্যয়ন কী?

সুদহারের মতো ডলারের বিনিময় হারও পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া দরকার। চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতেই ডলারের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ হবে। ২০১২ সাল পরবর্তী সময়ে টাকার শক্তিশালী মান ধরে রাখা হয়েছিল। এতে দেশের রফতানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন বিনিময় হার বাড়ায় রফতানি খাত উপকৃত হবে। দেশের রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে। তবে আমদানিকারকরা যাতে ন্যায্যমূল্যে ডলার সংগ্রহ করতে পারে, সেটিও দেখা দরকার।

আপনারা দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকের করপোরেট করহার কমানোর দাবি জানিয়ে আসছেন। এবারের বাজেটেও কি একই দাবি জানাচ্ছেন?

বাংলাদেশের ব্যাংকের করপোরেট করহার প্রতিবেশী কোনো দেশের সঙ্গেই সংগতিপূর্ণ নয়। বিশ্বে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি কর আর কোনো দেশের ব্যাংক থেকে আদায় করা হয়, সেটি আমার জানা নেই। আমরা বহুদিন থেকেই ব্যাংকের করপোরেট কর কমানোর দাবি জানাচ্ছি। আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার করহার কিছুটা কমিয়েছে। তার পরও এখনো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর করহার ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় এ করহার অনেক বেশি।

২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রায় দ্বিগুণ করেছে। ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় যে পরিমাণ বেড়েছে, তাতে কোনো ব্যাংকের পক্ষেই কাঙ্ক্ষিত মুনাফা করা সম্ভব হচ্ছে না। খেলাপি ঋণের উচ্চহারের কারণে ব্যাংকগুলো এমনিতেই প্রত্যাশা অনুযায়ী মুনাফা করতে পারছে না। পুঁজিবাজারে ব্যাংকের শেয়ারদরই সবচেয়ে বেশি অবমূল্যায়িত। শেয়ারহোল্ডারদের কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ডিভিডেন্ড দিতে না পারায় ব্যাংকের শেয়ারদর বাড়ছে না। করহার বেশি হওয়ায় অনেক ব্যাংক প্রত্যাশা অনুযায়ী নিট মুনাফা করতে পারছে না। এজন্য ব্যাংকের করপোরেট কর কমানোর দাবিটি আরো বেশি জোরালো হয়েছে। এটি মনে রাখতে হবে, ব্যাংক না বাঁচলে অর্থনীতিও বাঁচবে না। করহার কমালে ব্যাংক খাত অর্থনীতিতে আরো জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবে।

তবে শুধু ব্যাংক নয়, এবারের বাজেটে আমরা শিল্পসহ সব খাতের কর কমানোর দাবি করছি। শিল্প-কারখানার মালিকরা বিভিন্নমুখী সংকটের মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায় করছাড় না দিলে অনেকের পক্ষে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাছান আদনান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন