আসন্ন বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

ইউনেস্কোর পরামর্শ, একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত অথচ বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ১৮৯টি সদস্যদেশের মধ্যে যে ১০টি দেশ অর্থনীতির আকারের তুলনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়, বাংলাদেশ তার একটি। পুরো বিশ্ব চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশের শেষ পাঁচ বছরের বাজেট বরাদ্দ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তার সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র।

ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তথ্য ও প্রযুক্তির বৈপ্লবিক উন্নয়নে যেখানে পুরো বিশ্ব তার তরুণদের উন্নয়নে সর্বোচ্চ ব্যয় করছে। সেখানে কোনোভাবেই শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দে সংকীর্ণতার সুযোগ নেই। দেশের সামগ্রিক মানবসম্পদের উন্নয়নে শিক্ষার কোনো ব্যতিক্রম নেই। সেখানে শিক্ষায় বিনিয়োগে উদাসীনতা জাতীয় উন্নয়নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

শিক্ষার প্রভাব ও ব্যাপকতা অত্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা ইঙ্গিত করে বাংলাদেশের তরুণ ও কর্মক্ষম মানুষের আধিক্য। বাংলাদেশে ইউএনএফপিএর তথ্য অনুসারে দেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৭ দশমিক ৯৬ শতাংশই তরুণদের উপস্থিতি। ‘রূপকল্প ২০৪১’ অর্জন ও ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজি বাস্তবায়নেও শিক্ষায় বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। সেখানে যথাযথ ও প্রত্যাশিত বাজেটের বরাদ্দে ঘাটতি বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নে ব্যত্যয় ঘটাবে। গত এক দশক ধরে টানা এ দাবি শিক্ষকদের মহল থেকে উঠে আসছে, কিন্তু তার যথাযথ বাস্তবায়নে রয়েছে যথেষ্ট উদাসীনতা। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কম দেয়া হয়েছে, শুধু তা-ই নয়। যেটুকু বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল, সেটাও যথাযথভাবে ব্যয় করা হয়নি। এর পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে অপব্যয় করা হয়েছে, বিভিন্ন মহল থেকে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেয়া, এমনকি সরকারি পরিকল্পনায়ও শিক্ষা খাতে কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলা হয়েছিল, তা সত্ত্বেও কোনো রকম প্রত্যাশা পূরণ করেনি শিক্ষা খাতে জাতীয় বিনিয়োগ। এমন সব স্থানে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাই ছিল মূল কারণ।

যেখানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জিডিপির অনুপাতে শিক্ষায় বরাদ্দ অন্তত ৬ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন। সেখানে শিক্ষা খাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভুটানের বিনিয়োগ ৬ দশমিক ৬ শতাংশ, আফগানিস্তানের ৪ দশমিক ১ এবং ভারত ও পাকিস্তান বরাদ্দ দেয় ২ দশমিক ৯ শতাংশ। শিক্ষা খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এদের সবার চেয়ে নিচে। গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) ছিল ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরে (২০২৩-২৪) তা ১ দশমিক ৭৬ শতাংশে নেমে এসেছে। বাজেটের এ ভয়াবহ চিত্র একটি জাতিকে গলা টিপে হত্যা করার শামিল।

শিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ না হলে সমাজে বেকারত্ব ও অপরাধপ্রবণতা বাড়বে এবং তা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, নীতি-নৈতিকতা, আইন, সামাজিক মূল্যবোধ বিকাশে, যা জাতিকে চরম মাত্রায় ভোগাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে। তাই শিক্ষা খাতে যথাযথ বিনিয়োগ, অন্তত জিডিপির ৮ শতাংশ নির্ধারণ করতে হবে। গুণগত ও প্রয়োজনীয় শিক্ষাদানের পাশাপাশি জাতীয় শিক্ষানীতির পুনর্মূল্যায়ন এবং সঠিক পরিকল্পনার সঙ্গে তাকে বাস্তবায়নের ভূমিকায় রাষ্ট্রকে তৎপর থাকার বিকল্প নেই।

বাংলাদেশে শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষক পেশাজীবীদের অবস্থান, মর্যাদা ও বেতনের করুণ দশা। শিক্ষকদের এ করুণ অবস্থা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। একটা সময় শিক্ষক বলতে বোঝাত জীর্ণশীর্ণ চেহারা, মলিন জামা, পায়ে ছেঁড়া জুতা, হাতে তালি দেয়া ছাতা। ঠিক আজও শিক্ষকদের সেই একই দশা, রাজপথে তাদের বেতনের দাবিতে করুণ চিত্র দেখতে হয় জাতিকে।

শিক্ষকদের উন্নয়নে এবং তাদের মর্যাদা বৃদ্ধিতে বিশেষ অনীহা দেখা যায়। রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক মর্যাদার বিচারে শিক্ষকদের রাখা হয় পেছনে। আমলাতান্ত্রিক অযাচিত হস্তক্ষেপ ও শিক্ষকদের অবস্থান, মর্যাদা, শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। শিক্ষকদের বিশেষ সমাদর করা হয় না। কিন্তু এ পেশায় আশা করা হয়, শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের অবস্থান। তৃণমূল পর্যায়ে লক্ষ করলে দেখা যায়, প্রথম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা তাদের স্বপ্নকে বেঁধে রাখে সিভিল সার্ভিস, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা এ রকম কোনো পেশায়। যেখানে প্রচুর টাকার পাশাপাশি রয়েছে সামাজিক শক্ত অবস্থান। তাছাড়া শিক্ষকদের উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বিনিয়োগে রয়েছে যথেষ্ট ঘাটতি। যা জন্ম দেয় শিক্ষক ঘাটতির মতো সমস্যা। শিক্ষা খাতে সঠিক ও পরিকল্পিত বিনিয়োগ ছাড়া শিক্ষক ঘাটতির সমস্যার নিরসন ও শিক্ষক পেশায় মেধাবীদের অবস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। শিক্ষক পেশায় শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের অবস্থান ছাড়া নতুন প্রজন্মকে সম্পদে পরিণত করার কথা ভাবা যায় না। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষা খাতে সঠিক বিনিয়োগ ছাড়া বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন