জ্বালানি, সংঘাতপূর্ণ নীতিমালা ও উৎসে কর কর্তন পাট শিল্পের অন্যতম প্রধান সমস্যা

ছবি : বণিক বার্তা

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উন্নয়নের প্রথম সোপান হিসেবে কাজ করছে শিল্প খাত। বাংলাদেশের শিল্পায়নে পথিকৃৎ পাট শিল্প। এ প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন শিল্পের মধ্যে বাংলাদেশের পাট শিল্পের ইতিহাস অতি প্রাচীন ও এর গুরুত্ব অপরিসীম। গোড়াপত্তন হয় ১৯৫০-এর দশকে। এ শিল্পের সঙ্গে দেশের আপামর জনগোষ্ঠী অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এবং প্রযুক্তিগত বিবেচনায় পাট শিল্প শ্রমনিবিড়। শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা সমাধানসহ জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অতীতের সব জৌলুশ হারিয়ে টিকে থাকার লড়াই করছে দেশের সোনালি আঁশ পাট শিল্প। লোকসানের বোঝা টানতে না পেরে রাষ্ট্রায়ত্ত সব পাটকল বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। এ অবস্থার মধ্যেও পাটপণ্যের বৈশ্বিক বাজারে শক্ত অবস্থান করে নিয়েছে বেসরকারি খাতের গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া পাট চাষের উপযোগী। তাই বিশ্বের সেরা মানের পাট এ দেশেই উৎপন্ন হয়। পাট অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাট ও পাট শিল্পের সঙ্গে জড়িত। বিশ্ববাজারের চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ কাঁচা পাট এবং ৪০-৫০ শতাংশ পাটজাত পণ্য বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয়। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পাট রফতানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পরিচিতি পেয়েছে।

পাট খাতে বিনিয়োগ রয়েছে আকিজ বশির গ্রুপের। নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনার প্রাক্কালে এ খাতের বর্তমান চ্যালেঞ্জ, জ্বালানি সমস্যা, বিনিময় হারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ বশির উদ্দিন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বদরুল আলম

এক্সচেঞ্জ রেট নিয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে আসা দিকনির্দেশনার বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

সামষ্টিক অর্থনীতির দিক থেকে দেখলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বিনিময় ভারসাম্য (বিওপি) জরুরি। যখন ডলারের সঙ্গে বিনিময় হার ৮৬ টাকা থেকে ১০০ টাকা, ৯৫ টাকা, ১০৫ টাকা এবং ১১০ টাকায় গেল, আমাদের যাদের বৃহৎ বৈদেশিক ঋণ আছে হয় ডেলিবারেটলি পছন্দের সঙ্গে হোক অথবা ব্যাংকের ডেফার্ড পেমেন্টের আগ্রহের কারণে হোক, দিন দিন ঋণের আকার বেড়ে গেছে। যতবার ডলার ডিভ্যালুড হয়েছে, আমাদের দায়ের পরিমাণও বেড়ে গেছে। যখন ১ ডলার সমান ৮৬ টাকা ছিল তখন আমাদের যে মূলধনি বিনিয়োগ ছিল, সেগুলোর দায় আমাদের ব্যাপক পরিমাণে বেড়ে গেছে। সহজ কথায়, এ সাত টাকার ডিভ্যালুয়েশনে আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানের ওপর ক্ষতিটা ছিল প্রায় ৬০ কোটি টাকার মতো। কিন্তু তার পরও আমি বলব এটা অতটা খারাপ না। কারণ বিওপিকে স্থিতিশীল করতে না পারলে দীর্ঘমেয়াদে আমরা আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হব। আমি মনে করি যে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনে। আপনি যদি কৃত্রিমভাবে ধরে রাখেন, আজকে ৬০ কোটি টাকা নিয়ে হয়তো আমি আফসোস করছি, এটা হয়তো একসময় ৬০০ কোটি টাকা দিয়েও পোষাতে পারব না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার নির্ধারিত হলে ভোগ ব্যয়ে মানুষের কৃচ্ছ্রতা আসবে ও ভোগ করার ক্ষেত্রে আরো বেশি সতর্ক হবে। শিল্প উৎপাদনে হয়তো স্বল্পমেয়াদি ক্ষতিসাধন হলেও দীর্ঘমেয়াদে যেহেতু অর্থনৈতিক একটা প্রবৃদ্ধির ব্যাপার আছে, স্বল্প বিরতি দিয়ে হলেও এটা একটা সময়ে গিয়ে হয়তো কাটিয়ে যাবে। যদি রাজস্ব নীতি ও আর্থিক নীতির মতো নীতিগুলোকে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী করা হয়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হওয়া সম্ভব। আমি স্বল্পমেয়াদের সমস্যা নিতে রাজি আছি। তবে বাস্তবতাবিবর্জিত হলে এসব কোনো উপকারে আসবে না। কারণ ব্যক্তিগত পর্যায়ে যেমন দায় বাড়ছে, আমার ধারণা দেশের দায়ও বাড়ছে। সেটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমার ওপর এসেই পড়বে। তাই আমি মনে করি যে কিছু সাহসী পদক্ষেপ নেয়া উচিত। সেটা মুদ্রানীতির ক্ষেত্রে হতে পারে, সেটা এক্সচেঞ্জ রেটের ক্ষেত্রেও হতে পারে। কারণ সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক অনুঘটক দুটি। একটি সুদহার, অন্যটি বিনিময় হার। আপনি যখন মুক্তবাজার অর্থনীতিতে থাকবেন তখন এ দুটো জিনিস যদি বাজারমুখী না করেন, তাহলে মার্কেট নিজেকে শোধরানোর কোনো সুযোগ পায় না। ফলে অনেক অসাধু কর্মকাণ্ডের উৎপত্তি হয়। অতএব এ দুটো জিনিসকে আমার মনে হয় বাজারমুখী করাই শ্রেয়।

এ মুহূর্তে ইন্ডাস্ট্রিতে আর কী চ্যালেঞ্জ বড় হিসেবে দেখেন?

চ্যালেঞ্জের আসলে কোনো সীমা নেই। আমরা যারা বিনিয়োগমুখী প্রতিষ্ঠান বা উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকি, আমাদের চ্যালেঞ্জ আসলে বহুমুখী।

এখন জ্বালানি বিপর্যয় আছে?

জ্বালানি বিপর্যয়ে তো আমরা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। যেভাবে জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে, তাতে আমাদের ক্ষতি তো হচ্ছেই। হয়তোবা সেটাও আন্তর্জাতিক মূল্য সমন্বয়ের কারণেই হয়েছে, কিন্তু প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে আমরা মারাত্মক সংকটে আছি। আমাদের উৎপাদনশীলতায় ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটছে। ফলে আমাদের উৎপাদন মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। যেহেতু আমাদের স্থায়ী ব্যয় নির্ধারিত সেহেতু আমাদের যে সুদ দিতে হচ্ছে, শ্রমমূল্য প্রদান করতে হচ্ছে, সে অনুযায়ী আমরা উৎপাদন করতে পারছি না বিদ্যুতের অপ্রতুলতার জন্য। স্থায়ী খরচ তো আমি কমাতে পারছি না। শ্রমের মূল্য কমাতে পারছি না। ব্যাংকের দায় আমি কমাতে পারছি না। যে কারণে খুব জটিল একটা সমস্যায় আমরা পড়ে যাচ্ছি।

ইন্ডাস্ট্রি সচল রাখতেই হচ্ছে, সেক্ষেত্রে জ্বালানি সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কোনো বিকল্প পদক্ষেপ কি নেয়া হচ্ছে?

আমরা প্রাথমিকভাবে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা হলো আমরা নতুন করে আর কোনো বিনিয়োগে উদ্যোগী হচ্ছি না। নতুন বিনিয়োগের দুটি নিয়ামক, একটি অর্জিত আয় যেটা প্রতিষ্ঠানের থাকে, আরেকটি হলো ব্যাংক থেকে নেয়া নতুন দায়। দুটো ক্ষেত্রেই আমরা সংকটের মধ্যে আছি। আমাদের মনে হয়, এ দুটোর সমন্বয় এ মুহূর্তে যথেষ্ট জটিল। তাই আমরা বরং আমাদের আয়কে পুনর্বিনিয়োগ করছি স্থায়ী খরচ কমাতে। অর্থাৎ জ্বালানির যে সংকটটা আছে সেটাকে আমরা বিকল্প জ্বালানিতে বিনিয়োগ করছি। যেমন সোলার এনার্জিতে আমরা ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করছি। বাংলাদেশে হয়তো এ মুহূর্তে আমরাই সোলার এনার্জিতে সর্ববৃহৎ বিনিয়োগটা করছি এবং সেটা নিজেদের স্বার্থেই। কারণ আমরা এটা গ্রিডে বিক্রি না করে নিজেরাই ব্যয় করি। চলতি বছরে এরই মধ্যে আমরা প্রায় ৫২ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যু উৎপাদনে বিনিয়োগ করেছি। আমরা আশা করি যে এটা আমাদের স্থায়ী ব্যয় (ফিক্সড কস্ট) কমাবে। যদিও জ্বালানি স্থায়ী ব্যয়ের অংশ নয়, এটা মূলত পরিবর্তনশীল ব্যয়ের (ভেরিয়েবল কস্ট) অন্তর্ভুক্ত। সেই সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় আমরা বিভিন্ন রকমের অটোমেশনের চেষ্টা করছি। সত্যি কথা বলতে, আমরা এটা করছি শ্রমমূল্য কমানোর জন্য। এভাবেই আমরা প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। আরেকটি হচ্ছে, ইউনিফর্ম ইমপ্লিমেনশন অ দ্য পলিসিস। দেখা যায় বিভিন্ন জিনিসের অপব্যবহারের ফলে আমাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমতে থাকে।

বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের বিদ্যমান পরিস্থিতি কেমন?

এটা নিয়ে আমি আগে বহুবার বলেছি যে বন্ডের অপব্যবহারের জন্য আমরা মারাত্মকভাবে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাচ্ছি। একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে আমরা যখন বাংলাদেশে পলিপ্রপাইলিন বা পলিয়েস্টার ফিল্মের প্রতিষ্ঠানটা গড়ি, মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। কারণ আমরা এ বন্ডের সঙ্গে পারছিলাম না। এমনকি রফতানিকারকরাও যে আমাদের কাছ থেকেই নেবে, সে বাজারও বড় হচ্ছে না। এ রকমভাবে ভ্যাট, ট্যাক্স আইনের ক্ষেত্রেও ইউনিফর্ম ইমপ্লিমেন্টেশনের ক্ষেত্রে আমাদের আরো উন্নয়নের সুযোগ আছে। যাতে যারা সঠিকভাবে ব্যবসা করার চেষ্টা করে তারা যেন সুরক্ষা পায়। আমরা অনেক সময় এটা থেকে বঞ্চিত হই বলে আমার মনে হয়। বন্ড সুবিধার আওতায় যে ম্যাটেরিয়ালগুলো হয়, চাইলে যে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এর একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে কাগজ। বাংলাদেশে কাগজ শিল্পে ভালোই অগ্রগতি হয়েছে হচ্ছে। কারণ এ খাতে বন্ডের অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। না হলে বাংলাদেশের কাগজ শিল্প ধ্বংস হয়ে যেত। মূলত কাগজের ব্যবসা যারা করেন তারা বন্ড কর্তৃপক্ষের সাহায্য ও সহযোগিতা পেয়েছেন এবং এটাকে মেটানো গেছে। খাদ্যপণ্য প্যাকেজিংয়ের এ ইন্ডাস্ট্রিতেও চাইলেই সমস্যাটি সমাধান করা যায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে বেশ কয়েকবার বিভিন্ন রেগুলেটরি স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে দেখা করেছি, ওনাদের বিষয়টা বুঝিয়ে বলেছি। তারা আমাদের সাহায্যও করেছেন। ওনারা চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ওনাদের অনেক ধরনের অগ্রাধিকার থাকে। ওনারা যখন সাহায্য করেছেন তখন ক্ষণিকের জন্য মার্কেটে আমাদের চাহিদাও দেখতে পেয়েছি। কিন্তু যখনই আবার একটু শিথিলতা চলে আসে তখনই আবার যে তিমিরে ছিলাম সে তিমিরেই চলে যাই। আপনি যদি নম্বর নিয়ে কাজ করেন তাহলে দেখবেন, আমরা ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার মতো ফিল্ম প্রতি বছর আমদানি করি। যদি বন্ডকে কন্ট্রোল করা যায় তাহলে বিপুল পরিমাণ এ টাকা সাশ্রয়ের সম্ভাবনা আছে। এখানে পুরোটা নয়, কারণ ম্যাটেরিয়াল আমদানির বিষয়টা বাদ দিতে হবে। তাহলে আপনি ৭০০ থেকে হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারবেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানতে পেরেছি যে ইপিবি ও ব্যাংকিং চ্যানেলে আসা রফতানির অর্থপ্রবাহে পার্থক্য প্রায় ৮৫৮ কোটি ডলার। এর উল্লেখযোগ্য অংশ বন্ডের অপব্যবহারের কারণেই অপ্রাপ্ত রয়ে গেছে বলে আমি ধারণা করি।

সম্প্রতি একটা ঘোষণা শুনেছি যে ক্যাশ ইনসেনটিভ কমানোর, পাটের ক্ষেত্রে এটা ব্যবসায় কেমন প্রভাব ফেলছে? সেটা নিয়ে বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা আছে কিনা

এটা হলে তো আমরা অবশ্যই ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হব। আমাদের বেশকিছু দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি থাকে এবং এ চুক্তির মধ্যে আমরা মূল্যনির্ধারণ করার সময় ইনসেনটিভটা যেটা ৫-১৫ শতাংশ বা ২০ শতাংশ, এটা আসলে বিশাল পরিমা টাকা। যেকোনো একটা ব্যবসায় এ পরিমা মুনাফা করাটা বেশ জটিল। আমরা আসলে এটাকেও মুনাফা ধরি না, এখান থেকেও ছেড়ে দি বাংলাদেশের পাট শিল্পে সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি নেই। বাংলাদেশে পাটের উৎপাদন হয় ১০ বা ১১ লাখ টন। অথচ এখানে প্রায় ২৬০টি মিল পরিচালনা করা হয়। সক্ষমতা বিবেচনায় এ মিলগুলোর পাটের যে চাহিদা, তাতে উৎপাদিত মোট পাটের ৫০ শতাংশ ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। দেশ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ কাঁচা পাট প্রতি বছর রফতানিও হয়। তার মানে সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই। সরবরাহে যখন ঘাটতি না থাকে তখন মূল্যের ক্ষেত্রে একটা অতি প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। কারণ সবাই টিকে থাকার চেষ্টা করে। ফলে প্রতিযোগিতাপূর্ণ একটা মূল্য বাজারে থাকে। যে কারণে প্রতিটা প্রতিষ্ঠানই এ ভর্তুকিকে বা তার অংশকে মুনাফা হিসেবে দেখে। যখন এটা কমে যায় তখন স্বল্পমেয়াদে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এ ভর্তুকি থাকা উচিত বলে আমি মনে করি না। কারণ এ ‘স্পুন ফিডিংটা’ একটা পর্যায়ে গিয়ে বন্ধ হওয়া উচিত। তবে আরো বেশি জটিল হলো ভর্তুকির ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের যে প্রজ্ঞাপ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের যে নির্দেশনাবলি দুইটা সংঘাতপূর্ণ। এ সংঘাতের কারণে আমাদের শিল্পে যারা নিয়োজিত এরা ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

সংঘাতের ব্যাপারটা যদি আরেকটু ব্যাখ্যা করতেন

পাটের ২৮২টা বৈচিত্র্য পণ্যের রফতানির ক্ষেত্রে ক্যাশ ইনসেনটিভ নিয়ে সরকারের একটা নির্দেশনা ছিল। যেটা আগে ৭-২০ শতাংশ ছিল, পরিবর্ত হয়ে এখন সেটা ৫-১৫ শতাংশ হয়েছে। এটা বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন অডিট ফার্মকে যে নির্দেশনা দিয়েছে, এখানে বৈচিত্র্য ণ্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের কনফিউশন তৈরি হচ্ছে। ভ্যালু অ্যাডেড বা ডাইভার্সিটি প্রডাক্টটা কী বা কত শতাং ভ্যালু অ্যাডেড হলে আমি এটাকে ডাইভার্সিটি প্রডাক্ট বলব এসব। একটা নির্দেশনা দেয়া আছে যে ৩০ শতাংশ পাটের সম্পৃক্ততা থাকলে একটি পণ্যকে ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য বা বৈচিত্র্য পণ্য বলা যাবে। বেশকিছু পণ্যকে আবার নির্দিষ্ট করেই বলা আছে নাম ধরে ধরে। আসলে এখানে দ্বিধা তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিমাণ অর্থছাড় হচ্ছে না। এমনকি যেগুলো অডিটেড, ভেরিফায়েড সেগুলোই ছাড় করতে দেরি হচ্ছে, আরেকটা শত শত কোটি টাকার বড় অংশ অডিট ফার্মেই আটকে আছে। যে কারণে আমরা একটা অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে গেছি। পাটের ক্ষেত্রে ৭৫-৮০ শতাংশ থাকে কাঁচামালের দাম, বাকিটা রূপান্তর খরচ (কনভারশন কস্ট) মুনাফা (প্রফিট)। তাই যথেষ্ট পুঁজি লাগে এ ব্যবসা করতে। সেটা ছোট ব্যবসাই হোক বা বড়। দেখা যাচ্ছে, অর্থছাড়টা না হওয়া সবাই ধীরে ধীরে একটা পুঁজির সংকটের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। আরেকটা সমস্যা হলো পাট কেনার ক্ষেত্রে ট্যাক্স রিডাকশন অ্যাট সোর্স। পাট একটা কৃষিপণ্য হওয়ার পরও সরকার এতে প্রণোদনা দিচ্ছে। প্রণোদনার হার ইমপ্লিমেন্টেশনটাও ইউনিফর্মলি কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য এটাও একটু বিবেচনার বিষয়। সেটা কৃষক পর্যায়ে বলেন বা সাধারণ ব্যাপারে, যিনি ৫০ ম পাট নিয়ে এসেছে তার সঙ্গে আপনি কীভাবে জিনিসটা করবেন, এটা আমার কাছে একটু জটিল মনে হয়। দ্বিতীয়ত, পাট দেশের একটা মূল অর্থকরী ফসল। সব কৃষিপণ্যে যেখানে করছাড় দেয়া হয়, সেখানে পাটের ক্ষেত্রে ট্যাক্স ইমপ্লিমেন্টেশন করাটায় একটা সমস্যা তৈরি করছে। তো আমার কাছে মনে হয় জ্বালানি সমস্যা, সংঘাতপূর্ণ নীতিমালা এবং এ ট্যাক্স রিডাকশন অ্যাট সোর্সএ শিল্পের অন্যতম প্রধান সমস্যা। এ তিন জিনিস সমাধান করতে পারলে আমার ধারণা শ্রমিক, প্রতিষ্ঠান দেশ সবাই উপকৃত হবে।

সিরামিক শিল্পের বর্তমান অবস্থা কেমন?

অর্থনৈতিকভাবে দুটো মৌলিক ঘটনার পরিবর্তন হয়েছে, সুদের উল্লম্ফন ঘটেছে খুবই দ্রুত। বাজারে থাকা মূল্যস্ফীতির চাপ, যার কারণেই হয়তো সুদহারটা বেড়েছেএ দুটোর কারণে নির্মাণসামগ্রীর ওপর একটা চাপ এসেছে। তার পরও ইন্ডাস্ট্রি খুব খারাপ চলছে, সেটা বলব না। বরং আমি আবার বলব ইউনিফর্ম ইমপ্লিমেন্টেশন অথবা রেগুলেশন যদি হয়, তাহলে এ শিল্প থেকে সরকারের রাজস্ব আহরণে বড় সম্ভাবনা আছে। দ্বিতীয়ত, এখানে উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট অর্থাৎ মূল্য সংযোজন কর আর ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক যেটা সাধারত বিলাসদ্রব্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ ৩০ শতাংশের একটা কর দায় থাকে। এখানে প্রথম কথা হচ্ছে সিরামিক এ মুহূর্তে বিলাসপণ্য কিনা সেটা একটা প্রশ্ন। আমার পক্ষ থেকে আমি বহুবার আবেদন করেছি যে সম্পূরক শুল্কটা তুলে দিয়ে শুধু মূল্য সংযোজন করটা রাখা হোক। এছাড়া আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে সম্পূরক কর তুলে দিয়ে যদি ইউনিফর্মলি মূল্য সংযোজন করকে বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে বর্তমান যে পরিমা কর এখান থেকে আহরণ করা হয় এর বেশি পাওয়া সম্ভব।

প্রায়ই শিল্প খাতের বিভিন্ন সমস্যার কথা উত্থাপন করা হয় বাজেট এলে। কিন্তু তার কোনো প্রতিফলন বাজেটে দেখা যায় না। সে জায়গা থেকে কীভাবে বাজেটটাকে আরো ফলপ্রসূ করা যায়?

আপনার প্রশ্নটা অতি প্রাসঙ্গিক। আমি নিজেও অনুরোধ করেছিলাম, যেটা করলেন না সেটা না হয় করলেন না। কিন্তু যেটা করেছেন এটাও কেন আমরা বাজেট-পরবর্তী একটা আলোচনা করতে পারি না? আমি যখন একটা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসলাম যে আমাকে ‘এই’ জিনিসটা দিন, এর বিনিময়ে আপনার ‘এই’ জিনিসটার উন্নতি হবে। বাজেটের আগে এটা তো একটা প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনা করা হয়। কেন বাজেটের তিন মাস পর আলোচনা করে, যারা প্রতিশ্রুতি রাখতে পেরেছে তাদের পুরস্কৃত করে আর যারা রাখতে পারেনি তাদের তিরস্কৃত করতে পারি না? এটা করলে একটা দায়িত্বশীলতা দায়িত্ববোধ তৈরি হবে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন ট্রেডবডির কাছ থেকে আপনি দায়িত্বশীল আচরণ আশা করতে পারবেন।

কেন দায়বদ্ধ করা হবে না? এটা করা কিন্তু সহজ। কারণ ওনাদের কাছে তো স ডাটাই আছে যে ওটা ইমপ্লিমেন্ট করার ফলে আমার আউটকামটা আসছে কিনা। যদি না আসে তাহলে রিভার্স করে দেন। তাহলেই তো শিক্ষা হয়ে যাবে। পরবর্তী সময়ে যেকোনো অনুরোধ করার আগে তখন সবাই ভাববে, সতর্ক হবে সংযত আচরণ করবে।

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন