সহজ গল্পে জরুরি ‘পাঠ’

মাহমুদুর রহমান

সিনেমার দৃশ্য ছবি: আইএমডিবি

শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য বেশকিছু বই আছে। এতে অক্ষর চেনা থেকে শব্দ গঠন ইত্যাদি শেখানো হয়। আরেকটু বড় হলে, প্রাথমিক শিক্ষার দিনগুলোয় আমাদের এখনো পড়ানো হয় দ্রুতপঠন। কোনো কোনো স্কুলে হয়তো থাকে ছোট ছোট দুই-একটা বই। সেখানে ছোট ছোট গল্প থাকে। বেশির ভাগই শিক্ষামূলক। কোনোটায় থাকত মহামানবদের জীবনী, কোনোটায় সাধারণ ছোটগল্প। কিন্তু তারই মধ্যে থাকত একটা ‘মেসেজ’। একটা দীর্ঘ সময় উপমহাদেশের সিনেমা, নাটক ও বিনোদন মাধ্যমেও দেয়া হয়েছে মেসেজ। সময় বদলেছে। সিনেমা তৈরি হচ্ছে ব্যবসায়িক বা আর্ট ফর্ম হিসেবে। কিন্তু এখনো সিনেমায় দেয়া হয় মেসেজ আর দর্শক কোনো কোনো সময় তাতেই মাতে।

কিরণ রাও একটা সিনেমা নির্মাণ করেছেন, যার নাম ‘লাপাতা লেডিস’। ‘লেডি’ শব্দটি সম্মানসূচক হলেও উপমহাদেশে ‘লেডিস’ শব্দটি কমিক। সিনেমার গল্পও একটা পর্যায় পর্যন্ত কমিকই। স্যাটায়ারও বলা চলে। দীপকের বিয়ে করার সময়, ট্রেনে ওঠা, ফুলের সঙ্গে তার কথার ধরন সবই কমিক। কিন্তু লাপাতা কেন? নিখোঁজ। ভারতে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে নারী, তরুণী ও কন্যাশিশু হারায়। তাদের কেউ পাচার হয়ে যায়, কেউ ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা যায় আর কেউ বাড়ির (পিত্রালয় বা শ্বশুরালয়) অত্যাচারে নিজেই পালিয়ে যায়। লাপাতা শব্দটা তাদের সঙ্গে বেশি মানানসই। কিন্তু কিরণের সিনেমা এ ধরনের কোনো গল্প বলে না। দিল্লি ক্রাইম সেখানে খুঁজতে যাওয়ার দরকার নেই। কিরণ একটা পুরনো গল্প নতুন করে বলেছেন।

পুরনো গল্প। কেননা ভারত, এমনকি বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় বিয়ে করতে বর যেতেন বহু দূরে। বরের সঙ্গে সেই প্রথম দেখা হতো কনের। দূর গ্রাম থেকে বউ নিয়ে আসত বর, সঙ্গে হয়তো কয়েকজন বন্ধু। কোনো কোনো সময় কেবল বর-বউই আসত। সেসব মূলত শখানেক বছর আগের কথা। কখনো নৌকায়, কখনো গরুর গাড়িতে যাত্রা। যাত্রার মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ডাকাতের আক্রমণ। স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ হয়তো হতো বিয়ের তিনদিনের মাথায়। এমন দৈব দুর্বিপাক নিয়েই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ’নৌকাডুবি’। কিন্তু সেখানে কেউ মারা যায়নি। একজনের স্ত্রী হারিয়ে গিয়েছিল, পৌঁছেছিল অন্য ঠিকানায়। প্রায় একই রকম গল্প কিরণের লাপাতা লেডিসের। ট্রেন থেকে নামার সময় দীপকের সঙ্গে তার স্ত্রী ফুলকুমারীর বদলে নেমে আসে জয়া।

কিরণের গল্পের সময়কাল ২০০০ সালের শুরুর দিকে। তখনো ভারতের বহু অঞ্চলে দূর-দূরান্ত থেকে বিয়ে করে এভাবেই বৌ আনা হতো। সিনেমার দীপকও তাই করে। আর তার মতো ছিল আরো অনেকে। সে কারণেই ট্রেনের একই কামরায় মুখোমুখি আসনে তিন নবপরিণীতা জুটি। সেখানে কনেদের মুখে লম্বা ঘোমটা। তাই নামার সময় দীপকের ভুল হয়। ফুলের বদলে জয়াকে ডাকে সে। কিন্তু জয়া নামল কেন? তার পেছনেই আসল গল্পটা ছিল। ধীরে ধীরে সেটা বলেছেন কিরণ। আর দর্শক জানতে পারে জয়া পড়াশোনা করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাকে বিয়ে দেয়া হয় জোর করে। সে কারণেই দীপকের ডাকে নেমে আসে। এদিকে ফুল ছিল স্টেশনেই। সেখানে ভাগ্যক্রমে স্টেশনের খাবার বিক্রেতা মঞ্জু মাইয়ের কাছে আশ্রয় পেয়েছিল।

জয়া ও ফুলের দুটি ভিন্ন গল্পের মধ্য দিয়ে নারী স্বাধীনতার পাঠ দিয়েছেন কিরণ। প্রথমত ঘোমটার কারণে দীপকের ভুল থেকে তিনি আঙুল তুলেছেন ঘোমটার প্রতি। কেননা তার আড়ালেই থেকে যেতে হয় নারীকে। এরপর আসে পড়াশোনার ইচ্ছার কথা। ইচ্ছা ও সম্ভাবনা থাকলেও তারা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে না। সে কথা বলার পাশাপাশি জয়ার আসল স্বামীর ইতিহাসটি টেনেছেন কিরণ। তার এক স্ত্রী মৃত। কিন্তু সে মরেছে নাকি সন্তান না হওয়ার কারণে মারা হয়েছে, তা অজানা। এদিকে দীপক বিয়ে করেছেন পণ ছাড়া, কিন্তু জয়ার পরিবারকে গুনতে হয়েছে বড় অংক। যৌতুকবিরোধী কথাটিও তিনি রেখেছেন।

টুয়েলফথ ফেইলের মতো লাপাতা লেডিসও থিয়েটার থেকে নেমে ওটিটিতে আসার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল ইস্যুতে পরিণত। কেননা দুটি সিনেমায়ই আছে কিছু ‘জরুরি পাঠ’ এবং দুটো গল্পই সহজ, পরিচিত। কিন্তু কিরণের লাপাতা লেডিসে এমন কোনো সিনেমাটিক সৌন্দর্য নেই। গল্প বলেছেন তিনি সরলরেখায়। তার সঙ্গে অভিনয় শিল্পীরা ভালো করেছেন, কিন্তু সহজ গল্পে তাদের এমন কোনো চ্যালেঞ্জ ছিল না। ফলে দর্শক ধরেই নিয়েছেন বেশ একটা দুর্দান্ত কাজ হয়েছে। ক্যামেরায় মুনশিয়ানার দরকার হয়নি এ ফ্ল্যাট স্ক্রিনপ্লেতে। কেবল একটু নারীবাদ আর খানিকটা আবেগের জোরে জনপ্রিয় হলো সিনেমাটি। ধোবি ঘাটের কিরণ আবির্ভূত হলেন অত্যন্ত সাধারণ রূপে, কিন্তু জনপ্রিয়তা পেলেন অনেক বেশি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন