দেশের মেধাসম্পদের সুরক্ষা প্রদানে সরকার, সাধারণ জনগণ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর সচেতনতার অভাব রয়েছে। সচেতনতা তৈরির জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে এবং মেধাসম্পদ সুরক্ষায় সক্রিয় হতে হবে। না হলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণের পর অর্থনৈতিক ও আইনি জটিলতায় পড়তে হবে। উদ্যোগ না নিলে গ্রাম বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক প্রাণসম্পদ আমাদের আর থাকবে না।
শুক্রবার (৩ মে) রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজিত
এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। মেধাসম্পদ সুরক্ষা মঞ্চ (মেধাসুম) এ আলোচনা সভার
আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল
বলেন, মেধাসম্পদকে সুরক্ষা দিলে উদ্ভাবনকে স্বীকৃতি দেয়া হয়, উদ্ভাবন নির্ভর অর্থনীতি,
শিল্প গড়ে ওঠে এবং ব্যাপক কর্মসংস্থান হয়। এর সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বড়
সম্পর্ক রয়েছে। মেধাসম্পদের অধিকার সুরক্ষিত থাকলে শুধুমাত্র তখন ডিরেক্ট ফরেইন ইনভেস্টমেন্ট
(এফডিআই), বৈদেশিক বাজারে রফতানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। কারণ বিনিয়োগকারীরা স্বচ্ছ
এবং আইনি কাঠামোতে কাজ করতে পছন্দ করে। পৃথিবীতে আমরা নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় সম্পদের
মধ্যে মেধাসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানবসম্পদের কথা বলি। যেসব দেশ পৃথিবীতে সবচেয়ে
বেশি উন্নত তারা মেধাসম্পদ সুরক্ষায় সবচেয়ে সচেতন।
তিনি বলেন, যে দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে আছে তাদের অধিকাংশেরই
আইনি কাঠামো প্রচণ্ড দুর্বল। অর্থনীতিতে তাদের মেধা সম্পদের অবদান কিছুই নেই। আমাদের
গার্মেন্টস, কৃষি, বৈদেশিক শ্রম থেকে প্রাপ্ত আয় মানবসম্পদের মাধ্যমে আসে, এখানে মেধাসম্পদ
নেই। এরকম পরিস্থিতিতে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে হলে মেধাসম্পদের ওপর নির্ভর
করতে হবে।
আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের কপিরাইট কনসেপ্ট নামে মাত্র
আছে, কিন্তু এটি দেদারসে নকল হচ্ছে। এটাকে সুরক্ষা দেয়ার কোনো সিস্টেম নেই। আমাদের
আইন আছে, প্রতিষ্ঠান আছে, ডিপিডিটি আছে, কিন্তু কার্যক্রম নেই। জিআই পণ্যের জন্য পণ্য,
উৎপাদক এবং ভৌগোলিক অবস্থানকে সুনির্দিষ্ট করতে হয়। আমরা যে প্রক্রিয়ায় করছি তাতে
শুধু পণ্য সুনির্দিষ্ট করা হচ্ছে, কারা উৎপাদন করবে, তা সুনির্দিষ্ট করা হচ্ছে না।
সবচেয়ে বড় সমস্যা, কোনো ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছে না। ব্র্যান্ডিংয়ের দায়িত্ব সরকারের।
আমরা আইন দেখছি, প্রতিষ্ঠান দেখছি, কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছি।
ভারতের টাঙাইল শাড়ির জিআই আবেদনের পর তিন বছর সময় লেগেছে। এ তিন বছরে
আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যখনই গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ
মাধ্যমে এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলো তখন দুই, তিন দিনের মধ্যে এটাকে জিআই পণ্য হিসেবে
ঘোষণা দেয়া হলো।
মূল প্রবন্ধে প্রাণবৈচিত্র্য গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, দীর্ঘকাল বাংলাদেশের
জনমানুষের সৃজনশীলতা, মেধা, বুদ্ধির বাণিজ্যিক মালিকানার দাবি ওঠেনি। সহস্র জাতের ধান,
নদীর মালিকানা, গ্রামের নাম, গীত বা আখ্যান, শীলপাটা, কাসুন্দি, শীতলপাটি, গাজীর গানসহ
অন্যান্য সম্পদের মেধাস্বত্ব নিয়ে কেউ মালিকানা দাবি করেনি। বিশ্বায়নের এ যুগে গ্রাম
বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক প্রাণসম্পদ আমাদের থাকছে না। বহু শিল্পচর্চা,
সাংস্কৃতিক উপাদান বা প্রাণসম্পদ আন্তঃরাষ্ট্রিক হতে পারে। কিন্তু জিআই পণ্য নির্দিষ্ট
ভৌগোলিক অঞ্চলের বাইরে করা সম্ভব নয়। নদীয়া বা ফুলিয়াতে যে শাড়ি উৎপাদন হচ্ছে সেটা
সে অঞ্চলের ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য। আমরা টাঙাইলকে কেটে নদীয়া বা ফুলিয়াতে নিয়ে যেতে
পারি না।
তিনি বলেন, এসডিজির ১৭টি লক্ষ্য অর্জনে পাবলিক মেধাসম্পদের অধিকার
সুরক্ষিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। গ্রামীণ জনপদে প্রাকৃতিক সাংস্কৃতিক সম্পদের মেধাসম্পদ
সুরক্ষা জরুরি। আমাদের সংবিধানের ১৮ এর ক ধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যত
নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য,
জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার বিধান জড়িত।’ বাংলাদেশের বন, নদী,
প্রাকৃতিক সম্পদ, বাস্তুতন্ত্র নির্মম যন্ত্রণার ক্ষত বহন করছে। এসব ভূগোলের জটিল মিথস্ক্রিয়ায়
জন্ম নিয়েছে আমাদের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য।
মানবাধিকার কর্মী শামসুল হুদা বলেন, জাতীয় মেধাসম্পদ সুরক্ষা জরুরি
কিন্তু এটা অনেক জটিল বিষয়। আমাদের মধ্যে এ বিষয়ে অজ্ঞতা রয়েছে, অসচেতনতা রয়েছে। আমাদের
নাগরিক সমাজ, সরকারের মধ্যে অসচেতনতা, অনীহা, অদক্ষতা এবং অসততা রয়েছে। নিজের দায়িত্ব
পালনে সচেতনতা ঐতিহাসিকভাবে আমাদের সরকারি প্রশাসনে অনুপস্থিত। এ দুর্ভাগ্য নিয়ে আমরা
স্বাধীনতার ৫২ বছর পার করেছি।
মেধাসুমের আহ্বায়ক আবু সাঈদ খানের সভাপতিত্বে এ সময় আরো বক্তব্য রাখেন
জিনবিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী, প্যাটেন্ট অধিদপ্তরের সাবেক রেজিস্ট্রার মো. আবদুর রউফ, অ্যাডভোকেট
তাসুনভা শেলী।