৮ লাখ টনের ঘরে নেমেছে চালের সরকারি মজুদ

শাহাদাত বিপ্লব

ছবি : বণিক বার্তা

প্রধান খাদ্যশস্য চালের সরকারি মজুদ আট লাখ টনের ঘরে নেমে এসেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি গুদামগুলোয় খাদ্যশস্যটির মজুদ কমেছে ৫০ শতাংশেরও বেশি। এক্ষেত্রে সরকারিভাবে কৃষিপণ্যটির আমদানি না হওয়া, স্থানীয় বাজার থেকে লক্ষ্য অনুযায়ী সংগ্রহ করতে না পারা ও সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় চালের বিতরণ বেড়ে যাওয়া বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

তথ্য অনুযায়ী, ১৭ এপ্রিল দেশের সরকারি গুদামগুলোয় চালের মোট মজুদ ছিল ৮ লাখ ৭৭ হাজার টন। আর জুলাইয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে তা ছিল ১৭ লাখ ৬০ হাজার টন। এরপর সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় ১৬ লাখ ২০ হাজার টনে। গত ১১ জানুয়ারিতে তা নেমে আসে ১৪ লাখ ২৮ হাজার টনে। 

এর আগে গত অর্থবছরের (২০২২-২৩) ৬ এপ্রিল দেশে চালের সরকারি মজুদ ছিল ১৩ লাখ ৮৫ হাজার টন। সে হিসাবে সরকারি গুদামগুলোয় এক বছরের ব্যবধানে চালের মজুদ কমেছে ৫ লাখ ৮ হাজার টন বা প্রায় ৩৭ শতাংশ। 

সরকারিভাবে দেশে গত কয়েক মৌসুমে রেকর্ড উৎপাদনের দাবি করা হলেও সাম্প্রতিক সময় দফায় দফায় চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠতে দেখা গেছে। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত চাল আমদানি করেনি সরকার। ফলে সরকারি গুদামগুলোকে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের ওপরই পুরোপুরি নির্ভর করতে হচ্ছে। যদিও গত আমন মৌসুমে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি খাদ্য মন্ত্রণালয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় খাদ্যশস্য বিতরণ হয়েছে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। চালের সরকারি মজুদ কমে আসার পেছনে এসব বিষয় বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

তাদের ভাষ্যমতে, সরকারের মজুদ কমার সুযোগে বিভিন্ন সময়ে চালের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। ২০২৪ পঞ্জিকাবর্ষ শুরুর পর এখন পর্যন্ত পণ্যটির বাজারমূল্যে জানুয়ারির শুরুতে ও পরে রমজানে দুই দফায় অস্থির হতে দেখা গেছে। এ ঊর্ধ্বমুখিতা বজায় আছে এখনো। 

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আব্দুল লতিফ মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারি মজুদ কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেন। দাম বাড়িয়ে দেন তারা। বোরো মৌসুমের চাল বাজারে আসতে আরো কিছুদিন লাগবে। চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে আরো আগে থেকেই সরকারিভাবে আমদানি করা প্রয়োজন ছিল। চালের দাম বাড়লে নিম্নবিত্ত মানুষদের আরো বেশি কষ্ট পেতে হবে। এমনিতেই তারা বিপদের মধ্যে রয়েছে। বোরো চাল বাজারে আসার আগে যদি দাম আরো বাড়ে তাহলে তাদের সংকট আরো বেড়ে যাবে।’

দেশে মোটা, মাঝারি ও সরু—মূলত এ তিন ক্যাটাগরির চাল পাওয়া যায়। মোটা চালের মধ্যে রয়েছে স্বর্ণা, চায়না ইরি, হাইব্রিড ও আমদানীকৃত মোটা চাল। মাঝারি চালের জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে পাইজাম, লতা, ব্রি-২৮ ও পারিজা। সরু চালের মধ্যে রয়েছে নাজির, কাটারিভোগ, জিরাশাইল ও মিনিকেট। এর মধ্যে গত এক মাসে এগুলোসহ প্রায় সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। 

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাজারে বর্তমানে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫০-৫২ টাকায়। এক মাস আগে এ দাম ছিল ৪৮-৫০ টাকা। মাঝারি আকারের চালের মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে কেজিপ্রতি ৫৫-৫৮ টাকায়, যা এক মাস আগেও ছিল ৫২-৫৬ টাকা। আর সরু চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬৫-৭৬ টাকায়, যা এক মাস আগে ছিল ৬২-৭৫ টাকা। 

মজুদ বৃদ্ধিতে এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে চালের বাজারমূল্য আরো অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন বাজার পর্যবেক্ষকরা। যদিও বর্তমান মজুদকে পর্যাপ্ত বলে মনে করছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। চলতি বোরো মৌসুমের ধান-চাল সংগ্রহ শুরু হলে মজুদ আরো বাড়বে বলে জানিয়েছেন তারা। 

মিল পর্যায়েও চালের দাম বেড়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় চালের মোকাম নওগাঁ জেলায়। জেলাটির মোকাম ও মিলগেটে এক সপ্তাহে চালের দাম কেজিতে ২-৩ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে এখানে পাইকারি পর্যায়ে মানভেদে প্রতি কেজি স্বর্ণা-৫ জাতের চাল ৫০ টাকা এবং কাটারিভোগ চাল ৬৫-৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও মানভেদে প্রতি কেজি স্বর্ণা-৫ জাতের চাল বিক্রি হয়েছিল ৪৭-৪৮ টাকায়। কাটারিভোগ চাল বিক্রি হয়েছিল ৬২-৬৮ টাকায়। 

এদিকে, নতুন ধানের চাল বাজারে আসায় গত এক সপ্তাহে প্রতি কেজিতে ৩-৪ টাকা দাম কমেছে মিনিকেট ও ব্রি-২৮ জাতের চালের। এক সপ্তাহ আগে নওগাঁ মোকাম ও মিলগেটে মানভেদে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল ৬৪-৬৫ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬২ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে ৫৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া ব্রি-২৮ জাতের চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকা কেজি দরে।

বোরো মৌসুমের ধান কাটা শেষ হলে চালের দাম কমবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। শহরের পার নওগাঁ আড়তদারপট্টির সততা রাইস এজেন্সির পাইকারি চাল ব্যবসায়ী সুকুমার ব্রহ্ম বণিক বার্তাকে জানান, ‘আমন মৌসুম শেষ হওয়ায় দুই মাস যাবৎ বাজারে স্বর্ণা-৫ জাতের ধানের সরবরাহ কমেছে। এ কারণে চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। বোরো মৌসুমের কিছু ধান এরই মধ্যে কাটা-মাড়াই শুরু হয়েছে। নতুন ধানের চাল বাজারেও আসতে শুরু করেছে, যার প্রভাবে দাম কমেছে মিনিকেট ও ব্রি-২৮ জাতের চালের। বোরোর ধান পুরোদমে কাটা-মাড়াই শুরু হলে চালের বাজারদর আবারো কমে আসবে।’ 

নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বণিক বার্তাকে জানান, ‘এরই মধ্যে নতুন ধান কাটা-মাড়াই শুরু হয়েছে। আবহাওয়া এখন পর্যন্ত অনুকূলে। বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না ঘটলে সঠিক সময়ে বোরো ধান বাজারে উঠবে। এসব ধান মিলগেটে পৌঁছানো মাত্রই সব ধরনের চালের দাম কমে আসবে।’

বিভিন্ন সময় চালের দাম বাড়ার পেছনে সরকারের খাদ্যশস্যটি আমদানি না করার সিদ্ধান্তকে দায়ী করছেন অনেকে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট (এফপিএমইউ) সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো চাল আমদানি করা হয়নি। আর গত অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ১০ লাখ ৫৬ হাজার টন। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্য আমদানি করা হয় ৫০ লাখ টন। এর মধ্যে চাল ছিল ৯ লাখ ৮৮ হাজার টন। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে মোট ১৩ লাখ ৫৯ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়। 

চলতি অর্থবছরে খাদ্যশস্যের আমদানি কমলেও বিভিন্ন সরকারি কর্মসূচির আওতায় বিতরণ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে মোট ৩০ লাখ ৯২ হাজার টন খাদ্যশস্য বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে ২৫ লাখ ৩৪ হাজার টন, যার মধ্যে চাল ২০ লাখ ৪৬ হাজার টন। গত অর্থবছরে একই সময় পর্যন্ত সরকারিভাবে চাল বিতরণ হয়েছিল ১৯ লাখ ৭৩ হাজার টন চাল ও ৪ লাখ ১৩ হাজার টন গম। 

সাধারণত আমন ও বোরো—এ দুই মৌসুমে সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত আমন মৌসুমে চাল উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৭৪ লাখ টন, যা বিগত যেকোনো বছরের চেয়ে বেশি। এছাড়া গত বোরো মৌসুমেও রেকর্ড চাল উৎপাদন হয়েছিল বলে সরকারিভাবে দাবি করা হয়।

সর্বশেষ আমন মৌসুমে মোট ছয় লাখ টন সেদ্ধ চাল, এক লাখ টন আতপ চাল ও দুই লাখ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়। ধানকে চালের আকারে হিসাব করে মোট আমন সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৮ লাখ ৩৩ হাজার টন। যদিও এর বিপরীতে সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৬ লাখ ৫৯ হাজার টন। এর মধ্যে ২৩ হাজার টন ধান, ৫ লাখ ৪৯ হাজার টন সেদ্ধ চাল ও ৯৪ হাজার টন আতপ চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। 

আসন্ন বোরো মৌসুমের উত্তোলন শেষ হওয়ার পর বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরবে বলে প্রত্যাশা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের। তারা বলছেন, বোরো মৌসুমের ফলন কাটতে শুরু করেছেন কৃষকরা। কিছুদিনের মধ্যেই বোরো ধান বাজারে আসবে। সরকারিভাবে বোরো মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহ করা হবে। ফলে বাজারে মজুদ বাড়ার পাশাপাশি চালের দাম কমে আসবে। 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বছরের এ সময়ে যা মজুদ থাকার কথা সে হিসেবে মজুদ পর্যাপ্ত রয়েছে। মজুদ কমার কারণে চালের দাম বাড়ছে বিষয়টি ঠিক নয়। নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে চালের বাজার কিছুটা অস্থিতিশীল ছিল। তবে এরপর থেকে চালের বাজার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিছু জাতের চালের দাম সামান্য বেড়েছে। বোরোর চাল বাজারে এলে দাম কমে আসবে। বোরো মৌসুমে প্রয়োজন অনুযায়ী সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহ করা হবে।’

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বণিক বার্তার নওগাঁ প্রতিনিধি আরমান হোসেন রুমন)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন