সারের আমদানি ব্যয় কমেছে ৫১ শতাংশ, কৃষক সুফল পাবেন কি

রাশেদ এইচ চৌধুরী ও শাহাদাত বিপ্লব

ছবি : বণিক বার্তা

আন্তর্জাতিক বাজারে কমছে সব ধরনের সারের দাম। ফলে আগের চেয়ে কম মূল্যে পণ্যটি আমদানি করতে পারছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসের (জুলাই-জানুয়ারি) তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে সারের আমদানি ব্যয় কমেছে ৫১ শতাংশের বেশি। যদিও গুরুত্বপূর্ণ কৃষি উপকরণটি আগের দামেই কিনতে হচ্ছে কৃষকদের। 

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার আগের চেয়ে অর্ধেক দামে সার আমদানি করলেও এতে কৃষক লাভভান হচ্ছেন না। কেননা দেশের বাজারে আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে পণ্যটি। এতে করে কৃষি খাতে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। কমে যাচ্ছে কৃষকের মুনাফার মার্জিন। একই সঙ্গে তা খাদ্যের উৎপাদন এবং বাজার পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। প্রভাব ফেলছে সার্বিক মূল্যস্ফীতিতেও। 

দেশে ইউরিয়া, ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি), ডাইঅ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) ও মিউরেট অব পটাশ (এমওপি)—এ চার ধরনের সারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। রাসায়নিক এসব সারের চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম ওঠে রেকর্ড সর্বোচ্চে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সে বছরের আগস্টে কৃষক পর্যায়ে ইউরিয়ার দাম কেজিতে ৬ টাকা বাড়ায় সরকার। গত বছরের এপ্রিলে আরেক দফায় কেজিতে ৫ টাকা করে বাড়ানো হয় সব ধরনের সারের দাম। বর্তমানে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়ার দাম ২৭ টাকা, ডিএপি ২১, টিএসপি ২৭ ও এমওপির দাম ২০ টাকা।

কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কৃষির প্রায় সব উপকরণের দামই গত দুই বছরে বেড়েছে। এর মধ্যে সারের উচ্চমূল্যের কারণে বিপাকে রয়েছেন কৃষক। সেই সঙ্গে কয়েক বছর ধরে বীজ, সেচ ও সার্বিক উৎপাদন খরচ বাড়তি। এতে কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে সারের মূল্যহ্রাসের সঙ্গে দেশের বাজারেও কমালে কৃষকরা এর সুফল পাবেন। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য উপকরণের দামও কমে আসবে বলে তাদের মত। 

এ বিষয়ে সাবেক খাদ্য সচিব আব্দুল লতিফ মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কৃষিপণ্য উৎপাদনে মূল খরচ সারে। আরেকটি অংশ খরচ হয় সেচে। কৃষক পর্যায়ে সরকার যদি সারের দাম কমিয়ে আনে, তাহলে অবশ্যই উৎপাদন খরচ কমে আসবে। এতে কৃষকের পাশাপাশি ভোক্তাও উপকৃত হবে। যদিও ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই দফায় সারের দাম বাড়ানো হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে। এখন তা কমে এলেও দেশে সমন্বয় করা হচ্ছে না। ফলে উৎপাদন ব্যয় কমাতে না পারায় বিভিন্ন পণ্যের দাম নির্ধারণ করেও কিন্তু সরকার বাস্তবায়ন করতে পারেনি।’

আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে ইউরিয়া ও এমওপি সারের দাম অর্ধেকের বেশি বা কাছাকাছি নেমে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের চলতি মাসে হালনাগাদকৃত পিংক শিটের (আন্তর্জাতিক বাজারসংক্রান্ত নিয়মিত প্রতিবেদন) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন ইউরিয়ার দাম ছিল ৮২১ ডলার। এছাড়া প্রতি টন ডিএপি ৭৯৪ ডলার ৯০ সেন্ট, টিএসপির গড় দাম ছিল ৭১৫ ডলার ৬০ সেন্ট এবং প্রতি টন এমওপির মূল্য ছিল ৮৫১ ডলার ৭০ সেন্ট। যদিও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে টনপ্রতি ইউরিয়ার দাম কমে দাঁড়ায় ৩৫১ ডলার ৩০ সেন্ট, ডিএপি ৫৮৩ ডলার ৮০ সেন্ট, টিএসপি ৪৫৪ ডলার ৪০ সেন্ট এবং এমওপি ২৮৯ ডলার ৪ সেন্ট। অর্থাৎ ২০২২ সালের তুলনায় বর্তমানে ইউরিয়ার দাম ৫৭ শতাংশ, ডিএপি ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ, টিএসপি ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং এমওপির দাম কমেছে ৬৬ শতাংশ। 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে ইউরিয়ার চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৭ লাখ টন। এছাড়া টিএসপি সাড়ে সাত লাখ টন, ডিএপি ১৬ লাখ টন এবং এমওপি সারের চাহিদা রয়েছে নয় লাখ টন। এর মধ্যে ১০ লাখ টন ইউরিয়া, এক লাখ টন টিএসপি ও এক লাখ টন ডিএপি দেশেই উৎপাদন করে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)। এছাড়া চলতি অর্থবছরে গত ১৫ মার্চ পর্যন্ত মোট সার আমদানি হয়েছে ৪৫ লাখ ৯৬ হাজার টন। এর মধ্যে ইউরিয়া ১৫ লাখ ৮৫ হাজার টন, টিএসপি ৬ লাখ ৭২ হাজার, ডিএপি ১৩ লাখ ৫ হাজার এবং এমওপি ১০ লাখ ৩৪ হাজার টন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী অবশ্য তার চেয়েও বেশি সার আমদানি হয়েছে চলতি অর্থবছরের নয় মাসে (জুলাই-মার্চ)। ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি ও ডিএপি মিলিয়ে এ সময়ে মোট সার আনা হয়েছে ৫৪ লাখ ৪০ হাজার টন। এ পরিমাণ সারের কাস্টমস শুল্কায়িত মূল্য ২৭ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮ হাজার ২২৩ কোটি টাকায় আমদানি হয়েছে ১৯ লাখ ১৯ হাজার টন ইউরিয়া। এছাড়া ৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকার ৭ লাখ ৫৮ হাজার টন টিএসপি, ৫ হাজার ৮০৪ কোটি টাকার ১৩ লাখ ৫৪ হাজার টন এমওপি ও ৯ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকার ১৪ লাখ ৮ হাজার টন ডিএপি আমদানি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সার আমদানি হয়েছিল ৫৪ লাখ ৯ হাজার টন। এর মধ্যে প্রথম সাত মাস অর্থাৎ জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সার আমদানিতে মোট ব্যয় হয় ৩৮৮ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে একই সময়ে সার আনতে ১৮৮ কোটি ৮৬ লাখ ডলার খরচ হয়েছে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে সারের আমদানি ব্যয় কমেছে ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ। 

দেশে সার আমদানি হয় সরকারি ও বেসরকারিভাবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। ইউরিয়া সারের পুরোটাই আমদানি করে বিসিআইসি। সরকারি এ প্রতিষ্ঠান দুটি বছরের যেকোনো সময় চাইলে সার আমদানি করতে পারে। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের কেবল মে মাসে দরপত্রে অংশ নেয়ার মাধ্যমে সার আমদানি করতে পারে। 

বেসরকারি সার আমদানিকারকরা অবশ্য বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও এখনো তার সুফল পাওয়া যায়নি। কারণ প্রতি বছরের মে মাসে তারা দরপত্রে অংশ নিয়ে সার আমদানি করতে পারেন। এ বিষয়ে বেসরকারি খাতের সার আমদানিকারক ও উৎপাদনকারীদের সংগঠক বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) নির্বাহী সচিব রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত বছরের মে মাসে দরপত্র হয়েছিল। দরপত্রের সাতদিনের মধ্যে এলসি খুলতে হয়। কিন্তু তখন দাম বেশি ছিল। আবার ডলার সংকট ও টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেসরকারিভাবে সার আমদানি অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। সার্বিকভাবে খরচ অনেক বেশি পড়েছে। এখন যেহেতু সারের দাম কমেছে তাই আগামী মে মাসে হয়তো আমদানি করলে সুফল পাওয়া যাবে।’ 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সারে বড় অংকের ভর্তুকি দেয় সরকার। ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া মিলিয়ে ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩—এ ছয় অর্থবছরে সার খাতে মোট ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ৫৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে ১৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) সূত্রে জানা গেছে, গত ১৪ মার্চ পর্যন্ত দেশে ইউরিয়া সারের মজুদ রয়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৫২৩ টন। এছাড়া টিএসপি ৪০ হাজার ১২০ টন, ডিএপি ৮৪ হাজার ১০২ ও এমওপির মজুদ রয়েছে ৪৩ হাজার ৮৮১ টন। গত বছরের একই সময়ে ইউরিয়া ১ লাখ ৫৫ হাজার ৯৮৫ টন, টিএসপি ৪২ হাজার ৫১২, ডিএপি ৮১ হাজার ৫০৫ ও এমওপি ৩২ হাজার ৪৪৪ টন মজুদ ছিল।

দেশের বাজারে সারের দাম কমানোর বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. শাহ্‌ মো. হেলাল উদ্দীন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এটা সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়। এ বিষয়ে আমরা এখনো কোনো নির্দেশনা পাইনি।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন