পেট্রোবাংলার হিসাবে বিবিয়ানায় উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ শেষ

ক্ষেত্রটি থেকে জাতীয় গ্রিডে গতকালও গ্যাস সরবরাহ হয়েছে ১ হাজার ২৩ মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সর্বোচ্চ সরবরাহ আসছে হবিগঞ্জের বিবিয়ানা থেকে। ক্ষেত্রটি থেকে গতকালও জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ হয়েছে ১ হাজার ২৩ মিলিয়ন ঘনফুটের (এমএমসিএফ) কিছু বেশি। যদিও পেট্রোবাংলার ২পি রিজার্ভ এস্টিমেশন (উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মোট আবিষ্কৃত ও সম্ভাব্য মজুদ) অনুযায়ী, বিবিয়ানায় গ্যাসের মজুদ ফুরিয়েছে তিন মাস আগেই। সংস্থাটি এখানে গ্যাসের মজুদ হিসাব করেছিল ৫ হাজার ৭৫৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ)। আর জ্বালানি বিভাগের অধীন হাইড্রোকার্বন ইউনিটের পরিসংখ্যান বলছে, গত ডিসেম্বরের মধ্যেই গ্যাস ক্ষেত্রটি থেকে ৫ হাজার ৭৯৫ দশমিক ২ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়ে গেছে। সে অনুযায়ী, ক্ষেত্রটিতে তিন মাস আগেই গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে আরো অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলন করা হয়েছে।

গ্যাস ক্ষেত্রটি পরিচালনা করছে বৈশ্বিক জ্বালানি খাতের মার্কিন জায়ান্ট শেভরন। জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিবিয়ানায় এখনো হয়তো গ্যাসের অনেক মজুদ অনাবিষ্কৃত ও হিসাবের বাইরে রয়ে গেছে। এর প্রকৃত পরিমাণ নির্ণয়ে অনুসন্ধান ও খনন তৎপরতা আরো জোরদার করা প্রয়োজন। অন্যথায় ক্ষেত্রটি থেকে আকস্মিকভাবে সরবরাহ কমলে তা গ্যাস খাতে সাময়িকভাবে হলেও বিপর্যয় তৈরি করতে পারে। 

বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হয় ১৯৯৮ সালে। আর তা প্রথম উৎপাদনে আসে ২০০৭ সালে। বর্তমানে এখানে সম্ভাব্য ও নিশ্চিতকৃত মজুদ নিয়ে করা হিসাবের চেয়েও অনেক বেশি গ্যাসের মজুদ রয়েছে বলে মনে করছেন পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাদের ধারণা, ক্ষেত্রটির নতুন যেসব এলাকায় অনুসন্ধান ও উত্তোলন তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে, সেখানে আরো অন্তত ১ ট্রিলিয়ন ঘনফুটের (টিসিএফ) বেশি গ্যাস রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে তাদের একজন নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে এ তথ্য হালনাগাদ করে মোট মজুদের তথ্য জানানো হবে। শেভরনের ক্ষেত্রগুলোয় গ্যাসের মজুদের বিষয়ে তাদের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে।’

শেভরন এখন দেশে বিবিয়ানাসহ মোট তিনটি গ্যাস ক্ষেত্র পরিচালনা করছে। পেট্রোবাংলার গতকালের গ্যাস সরবরাহ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এ তিন ক্ষেত্র থেকে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে ১ হাজার ১৯৬ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে শুধু বিবিয়ানা থেকেই প্রতিদিন সরবরাহ আসছে ১ হাজার ২৩ মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি, যা মোট দৈনিক গ্যাস সরবরাহের ৩৯ শতাংশ। আর জালালাবাদ থেকে ১৫৭ মিলিয়ন ঘনফুট ও মৌলভীবাজার থেকে ১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে। সব মিলিয়ে জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের মোট সরবরাহের ৪৫ শতাংশেরও বেশি আসছে শেভরন পরিচালিত তিন গ্যাস ক্ষেত্র থেকে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেভরন বাংলাদেশের কমিউনিকেশন ম্যানেজার শেখ জাহিদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শেভরন বাংলাদেশ নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যের প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করতে বাংলাদেশ সরকার ও পেট্রোবাংলার সঙ্গে অংশীদারত্বে কাজ ও বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে বর্তমানে ও ভবিষ্যতেও সহায়তা অব্যাহত রাখবে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদার লক্ষ্যমাত্রা পূরণে শেভরন বিশ্বমানের বিশেষজ্ঞ দিয়ে গ্যাস ক্ষেত্র পরিচালনা করছে। বাংলাদেশে জালালাবাদ, বিবিয়ানা ও মৌলভীবাজার গ্যাস ফিল্ডে সর্বোচ্চ গ্যাস উত্তোলন করে জ্বালানি চাহিদা পূরণে সহায়তা করছে।’

দেশে বর্তমানে ২৯টি গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গ্যাস ক্ষেত্র তিতাস। সবচেয়ে বেশি মজুদ থাকলেও ক্ষেত্রটি এখনো উৎপাদনে পিছিয়ে আছে। আবার আবিষ্কৃত মজুদের দিক থেকে চতুর্থ হলেও উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে বিবিয়ানা।

জাতীয় গ্রিডে সর্বোচ্চ গ্যাস সরবরাহ দিলেও পেট্রোবাংলা ও হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, সামগ্রিকভাবে শেভরনের তিন গ্যাস ক্ষেত্রের মধ্যে দুটিতে গ্যাসের নির্ণয়কৃত মজুদ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। শেভরনের তিনটি গ্যাস ফিল্ডে মোট উত্তোলনযোগ্য মজুদ হিসাব করা হয়েছিল ৭ হাজার ৬১২ বিসিএফ। আর ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন হয়েছে ৭ হাজার ৭৭৩ বিসিএফ। গ্যাস ফিল্ডগুলোর মধ্যে বিবিয়ানা ছাড়া মৌলভীবাজারে মজুদ হিসাব করা হয়েছিল ৪২৮ বিসিএফ। এর মধ্যে ডিসেম্বর পর্যন্ত উত্তোলন হয়েছে ৩৫০ বিসিএফ। আর জালালাবাদ গ্যাস ফিল্ডে মোট সম্ভাব্য ও নিশ্চিতকৃত মজুদ হিসাব করা হয়েছিল ১ হাজার ৪২৯ বিসিএফ। যদিও তিন মাস আগেই এখান থেকে ১ হাজার ৬২৭ বিসিএফ উত্তোলন করা হয়ে গেছে। 

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রে উত্তোলনযোগ্য প্রকৃত মজুদ নির্ণয় ও নতুন করে কূপ খনন কার্যক্রম আরো জোরদার করা প্রয়োজন। গ্যাস ক্ষেত্রটির অনাবিষ্কৃত এলাকায় নতুন করে গ্যাসকূপ খনন করলে সেখানে আরো গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাসের প্রাথমিক মজুদ আবিষ্কারের পর এর হিসাব যে আরো বড় হবে না, তা বলা যাবে না। বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডের মজুদ এখন বাড়ছে। অনুসন্ধানের বাইরে থাকা এলাকাগুলোয় অনুসন্ধান করে নতুন গ্যাস মজুদ পাওয়া যাচ্ছে। বিবিয়ানায় শুরুতে চার টিসিএফ সম্ভাব্য গ্যাসের মজুদ হিসাব করা হয়েছিল, পরে তা আরো বেড়েছে। এটি গ্যাসের যেকোনো ফিল্ডের ক্ষেত্রে হতে পারে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে জ্বালানি বিভাগের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডের নতুন মজুদের বিষয়ে এখনো জ্বালানি বিভাগে লিখিত কোনো তথ্য জানায়নি শেভরন। কী পরিমাণ মজুদ বাড়তে পারে, সে বিষয়টিও এখনো পরিষ্কার নয়।’

তবে বিবিয়ানায় গ্যাসের আবিষ্কৃত মজুদ আরো এক টিসিএফ বাড়তে পারে বলে চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি জানিয়েছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে সেই সময় বলেছিলেন, ‘বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রের নতুন কূপে আরো প্রায় এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ পাওয়া যেতে পারে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন