আলোকপাত

কর্মসংস্থান, শিক্ষার মান ও উন্নয়ন কৌশল: আগামী বাজেট ঘিরে প্রত্যাশা

ড. রুশিদান ইসলাম রহমান

ছবি : বণিক বার্তা

কী ধরনের উন্নয়ন কৌশল মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে পারে সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে উল্লেখ করা দরকার কর্মসংস্থান বৃদ্ধি কেন বর্তমান বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশের গত কয়েক দশকের সাফল্যের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দারিদ্র্য হ্রাসের হার কমেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে আয় ও সম্পদবৈষম্য। আয়বৈষম্যের পেছনে বহু কারণ ও প্রক্রিয়া কাজ করছে। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ মজুরি ও বেতন থেকে প্রকৃত আয় হ্রাস পাচ্ছে। সরকারি পরিসংখ্যানের একাধিক উৎস থেকে দেখা যায় যে গত ১০ বছরে মজুরি ও বেতন থেকে প্রকৃত আয় এমনকি অনেক পেশায় নামিক আয় কমেছে। বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ থেকে দেখা যায়, বিগত পাঁচ বছরে শিল্প খাতে কর্মসংস্থান তেমন বাড়েনি, বেড়েছে কৃষিতে এবং সেখানে নিয়োজিত ব্যক্তিপ্রতি উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেয়েছে।

কভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তার আগের বছরগুলোর তুলনায় কম। কাজেই প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য উন্নয়ন কৌশলে পরিবর্তন জরুরি। স্বস্তির বিষয় বর্তমান সরকার কর্মসংস্থান বৃদ্ধির গুরুত্ব অনুধাবন করছে এবং আগামী বাজেটে এ বিষয়টিতে বিশেষ জোর দেয়া হবে—এমন সম্ভাবনা ব্যক্ত করা হয়েছে।

কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য কী ধরনের নীতিমালা কার্যকর হতে পারে তার প্রধান কয়েকটি দিক এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরা হচ্ছে।

১) শ্রমঘন শিল্প ও আধুনিক সেবা খাত প্রসারের জন্য উপযোগী সামষ্টিক নীতি গ্রহণ জরুরি। এসব পরিবর্তনের ফলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুফল পেতে অবশ্য অপেক্ষা করতে হবে। মধ্য মেয়াদে মানসম্পন্ন কাজের সুযোগ বাড়বে তাতে। সাম্প্রতিক কালে শিল্পে কর্মসংস্থান না বাড়ার কারণের মধ্যে রয়েছে বৃহৎ উদ্যোক্তাদের পুঁজি ঘনত্ব বৃদ্ধি এবং এসএমই উদ্যোগ প্রসারের শ্লথ ধারা। যেখানে শ্রম সুলভ, তা সত্ত্বেও পুঁজিঘনত্ব বাড়ে, সেটা ঘটে কৃত্রিমভাবে পুঁজি সুলভ করার নীতির কারণে। এই প্রবণতা না পাল্টালে ভালো মানের চাকরির সংস্থান দুরাশা।

এসব নীতির সুফল পেতে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে তা ঠিক, কিন্তু সেজন্যই এসব নীতি গ্রহণের প্রক্রিয়া এখন থেকে শুরু করার বিকল্প নেই।  

২) সে সঙ্গে উৎপাদনশীলতা ও উপার্জন বাড়াতে ভবিষ্যৎ নিয়োগপ্রার্থীদের যোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। সেখানে শিক্ষার মানোন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। স্কুল শিক্ষাক্রমে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে সে বিষয়ে নিয়োগকারীদের মতামত নেয়া জরুরি। উন্নয়ন বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ অংশ বৃদ্ধি করে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষা সহায়ক উপকরণ ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করতে হবে। নিম্ন আয়ের পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্কুলে বিশেষ সহায়ক কার্যক্রম গ্রহণ করে তাদের অর্জন বাড়াতে হবে। বর্তমানে শিক্ষার যে পারিবারিক ব্যয় তা নিম্ন আয়ের পরিবারে এক বিশাল বোঝা।

সাধারণ স্নাতক শিক্ষিতদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্ব হার বিরাজ করছে, তার একটি বড় কারণ হচ্ছে যে তারা যে ধরনের শিক্ষা অর্জন করেছে আর যে ধরনের যোগ্যতার জন্য চাকরি বাজারে চাহিদা আছে তার মধ্যে বিস্তর ফারাক। আমি নিজে যখন শিল্প মালিকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি, তাদের অনেকে এমন মত ব্যক্ত করেছেন যে সাধারণ বিষয়ে স্নাতক উত্তীর্ণ তরুণদের মধ্যে বেতনের যে প্রত্যাশা থাকে, সেটা তাদের কাছ থেকে যে কাজ পাওয়া যাবে তার তুলনায় অনেক বেশি। অন্যদিকে অনেক ব্যবসায়ী কিছু কিছু দক্ষতাসম্পন্ন চাকরিপ্রার্থীর অভাব রয়েছে বলে জানান। যেমন হিসাবরক্ষণে দক্ষ ও আন্তরিকভাবে সততার সঙ্গে কাজ করবে এমন মানুষ নাকি সহজে পাওয়া যায়  না। এই ধরনের দক্ষ ব্যক্তিদের এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠান উচ্চতর বেতন দিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। 

বাজার চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনবল গড়ে তোলার এবং সে রকম সাযুজ্যপূর্ণ প্রশিক্ষণ সুযোগ তৈরি করার আলোচনা বেশ অনেক বছর ধরে চলছে। কেন সেই পথে কার্যকরভাবে অগ্রসর হওয়া যাচ্ছে না সেটা আরো খতিয়ে দেখে সুষ্ঠু পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব বিষয়ে মধ্যমেয়াদি কার্যক্রমের সঙ্গে আশু এবং দ্রুত কার্যকর কিছু পদক্ষেপ বিবেচনা করা যেতে পারে। এখানে দরকার নিয়োগকারীদের সঙ্গে পর্যালোচনা করে শিক্ষানবিশির জন্য নীতিমালা গ্রহণ। সেই লক্ষ্যে বিনিয়োগ থাকতে হবে। 

৩) স্বল্পমেয়াদে মানসম্পন্ন কাজের সুযোগ বাড়বে যদি ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র শিল্প প্রসার লাভ করে। সরকারের এসএমই নীতিমালায় এই বিষয়ের সব প্রয়োজনীয় কৌশল তালিকাবদ্ধ রয়েছে। এখন প্রয়োজন সেগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। 

৪) কর্মসংস্থানের মূল লক্ষ্য হতে হবে সদ্য শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে যে তরুণ জনগোষ্ঠী তাদের উপযোগী কাজের সুযোগ তৈরি করা। যারা কলেজে ঢোকার আগেই দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ে তারা না চায় কৃষি মজুরির কাজ করতে, না আছে তাদের পুঁজি বা অন্য দক্ষতা। তাদের সহায়তা দেয়া দরকার যেন চাকরি অনুসন্ধান পথ সুগম হয়। কীভাবে আবেদন করতে হয় বা নতুন উদ্যোগ স্থাপনে কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করতে হয় সে বিষয়ে স্কুল শিক্ষা থেকে জ্ঞান অর্জিত হয় না। এগুলোর জন্য জেলা পর্যায়ে কিছু প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে সহায়ক ভূমিকা রাখার। এনজিও বা ব্যক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করলে সুফল পাওয়া যেতে পারে এসব ক্ষেত্রে। 

৫. সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে আগের তুলনায় উচ্চতর মজুরি দিলে সেটা সার্বিক মজুরিস্তর বাড়াতে অবদান রাখতে পারে। যেসব খাতে সরকার ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করার দায়িত্ব নিয়েছে, সেখানে শ্রমজীবীদের প্রকৃত আয়কে বাড়িয়ে একটি গ্রহণযোগ্য জীবনমানের দিকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যমান সদিচ্ছা নিয়ে এখন অগ্রসর হতে হবে।

একই সঙ্গে স্বল্পমেয়াদের জন্য কিছু বিশেষ দিকে মনোযোগ দরকার। 

১. কভিড সময়ে যারা স্কুল ছেড়েছে বা কোনোমতে এসএসসি/এইচএসসি পাস করেছে তারা যেন চাকরি বাজারে ঢুকতে পারে সেই উদ্দেশ্যে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান প্রয়োজন। 

২. দরিদ্রতম গ্রামীণ জনশক্তি, যারা কর্মক্ষম, কিন্তু যাদের স্বনিয়োজনের সম্পদ নেই, তাদের জন্য মজুরি কাজের ব্যবস্থা করতে হবে সামাজিক সুরক্ষার অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পে। সেগুলোর মাধ্যমে গ্রামীণ অবকাঠামো তৈরির লক্ষ্য নিয়ে প্রকল্প বাঁচাতে হবে এবং কৃষির শ্লথ মৌসুমে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রতিবেশী দেশগুলোয় এ ধরনের কিছু কার্যক্রম সার্বিকভাবে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধিতে প্রভাব রাখতে পেরেছে। এ ধরনের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প যেগুলো বর্তমানে এদেশে চলমান তাতে কর্মসংস্থান বা উপার্জন বৃদ্ধির খুব নিশ্চয়তা থাকে না।  যারা কায়িক পরিশ্রম করে উপার্জন করতে আগ্রহী, তারা যেন অভাবী সময়ে একটি ন্যূনতম মজুরিতে যথেষ্ট কাজ পায় সেটুকু নিশ্চয়তা দিতে হবে। 

৩. নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য নতুন করে ভাবনা-চিন্তা করতে হবে। বিবিএসের সবশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী নারীর কর্মসংস্থান বেড়েছে এবং তাদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার প্রায় ৪২ শতাংশ। সেই কর্মসংস্থানের মান কিন্তু তেমন উজ্জ্বল নয়। ২০১৭-২২ সালের মধ্যে নারীর কর্মসংস্থান বেড়েছে কৃষিতে স্বনিয়োজনের মাধ্যমে। আর শিল্প খাতে নিয়োজিত নারীর সংখ্যা কমেছে। কৃষিতে বিপুলসংখ্যক নারী যোগ দিলেও সেখানে পরিবারপ্রতি কৃষিজমি বা উৎপাদনশীল অন্য সম্পদ বাড়েনি। ফলে জনপ্রতি উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেয়ে খাদে নেমেছে। বেতন ও মজুরিতে নিয়োজিত নারীর সংখ্যা কমেছে। আধুনিক খাতগুলোয় নিয়োজন না বাড়ার ফলে মজুরি হয়েছে নিম্নমুখী। শিল্পে নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য বৃহৎ শিল্পমালিকদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে স্বল্পমেয়াদে যে দক্ষতার চাহিদা রয়েছে তেমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে যৌথ উদ্যোগে। কৃষিতে নিয়োজিত নারীকে নতুন পণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করতে হবে, তার উপকরণ জোগান দিয়ে, বাজারজাতে সহায়তা ও তথ্য সেবা দিয়ে। 

বিগত বছরগুলোয় শহরাঞ্চলে নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি থমকে গিয়েছে, যে ধারা পাল্টাতে হবে। নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিষয়টিতে পৃথকভাবে গুরুত্বের সঙ্গে মনোযোগ দিয়ে নতুন কৌশল ও কার্যক্রম নিতে হবে, যেটা এই লেখাতে আলোচনা করার পরিসর নেই। 

সবশেষে অবশ্য মনে রাখতে হবে যে সার্বিকভাবে শ্রমঘন আধুনিক খাত বিকাশের নীতি-কৌশল গ্রহণ এবং শিক্ষার মান উন্নয়ন ব্যতীত উন্নতমানের কর্মসংস্থান বাড়ানোর পথ নেই। পুঁজিঘন বিশাল প্রকল্প গ্রহণ করে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি দ্রুততর করার ক্ষেত্রে সাফল্য কিছুটা আসতে পারে। কিন্তু তাতে শ্রম আয়ের ওপর নির্ভরশীল স্বল্প দক্ষ জনগণের মানসম্মত কর্মসংস্থানে উত্তরণের স্বপ্নপূরণ হবে না। সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধি চলতে থাকবে অব্যাহতভাবে। একসময় এ দেশের বাজেটের সামষ্টিক অংশে প্রাক্কলন দেয়া হতো যে পরবর্তী এক বছরে কতসংখ্যক কর্মসংস্থান হতে পারে। সাম্প্রতিক কালে যৌক্তিকভাবেই সেটা থেকে বিরত থাকা হয়, কারণ অধিকাংশ কর্মসংস্থান হয় ব্যক্তি খাতে, তার প্রাক্কলন দুরূহ। তবে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিসংক্রান্ত যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে সেগুলোর ফলে নতুন কত কর্মসংস্থান হতে পারে তার হিসাব দেখানো দরকার।

ড. রুশিদান ইসলাম রহমান: অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের প্রাক্তন সদস্য

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন