শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার হার বাড়ছে

জীবনযাপন ব্যয় হ্রাস ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে উদ্যোগ কাম্য

ছবি : বণিক বার্তা

করোনা-পরবর্তী শহরে নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি না হওয়া এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের শহরে বাস কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এ কারণে তাদের শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। একসময় আর্থিক সংকট কাটাতে মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসত। সময়ের পরিক্রমায় পাল্টে যাচ্ছে এ দৃশ্যপট। দেশে উপযুক্ত ও টেকসই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় জীবিকার তাগিদে অনেকেই দেশের বাইরেও যাচ্ছে। এটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য মোটেই সুখকর নয়। আনুষ্ঠানিক খাতে টেকসই কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। 

গত এক দশকে দেশে অর্থনীতির গতি বাড়লেও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ কমেছে। এ সময়ে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি দ্রুত বাড়লেও কর্মসংস্থানে দেখা দিয়েছে নেতিবাচকতা। এক দশক আগে বিভিন্ন খাতে যে হারে নতুন চাকরির সুযোগ ছিল, এখন আর সেই ধারা নেই। বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে তৈরি হয়েছে প্রতিবন্ধকতা।

বাংলাদেশে বেকার আছে কি নেই বা কর্মসংস্থানের বাস্তব অবস্থা কী, সেটা এখন বিতর্কের বিষয় নয়। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)সহ যেকোনো সরকারি কিংবা বেসরকারি চাকরির বিপরীতে আবেদনপত্রের সংখ্যা দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি পদের বিপরীতে অনেক প্রার্থী আবেদন করে থাকেন। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, গত বছরের শেষ তিন মাস অর্থাৎ অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ২৩ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ বেকারের সংখ্যা ১৫ লাখ ৭০ হাজার আর নারী বেকারের সংখ্যা ৭ লাখ ৮০ হাজার। ২০২২ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ১০ হাজার। এক বছরের ব্যবধানে সেই সংখ্যা ৪০ হাজার বেড়ে গেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রায় দুই বছর ধরে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা সংকট চলছে। ডলার সংকট ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে চাপে রয়েছেন উদ্যোক্তারা। এ অবস্থায় নতুন বিনিয়োগ কমে গেছে। বিদেশী বিনিয়োগও খুব বেশি বাড়ছে না। ফলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। কিন্তু তার বিপরীতে প্রতি বছর শেষে কর্মক্ষম বিপুলসংখ্যক মানুষ চাকরির বাজারে যুক্ত হচ্ছে। যাদের একটি বড় অংশই কাজ না পেয়ে বেকার থাকছে। অর্থনীতির সংকট ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে কর্মসংস্থানে। ফলে তাদের অনেকেই শহরে জীবনযাত্রায় ব্যয় নির্বাহ করতে না পেরে গ্রামে যাচ্ছে। 

অর্থনীতির প্রতিটি শাখা একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। একটিকে বাদ দিয়ে বা পেছনে ফেলে অন্যগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিরিখে দেখতে হবে বেকারত্বের বিষয়টি। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, নতুন নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপনে উদ্যোগ নিতে হবে। বেকারের হার কমাতে হলে নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন করতে হবে, যেখানে বেকার তরুণেরা কাজের সন্ধান পাবেন।

বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, বিবিএসের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে প্রতি হাজারে শহর ছেড়ে গ্রামে গেছে ১৩ দশমিক ৮ জন। আগের বছর এ হার ছিল ১০ দশমিক ৯। ২০২১ সালে প্রতি হাজারে শহর ছেড়ে গ্রামে গেছে ৫ দশমিক ৯ জন। ২০২০ সালে এ হার ছিল ৮ দশমিক ৪। ২০১৯ সালে প্রতি হাজারে শহর ছেড়ে গ্রামে গেছে একজনেরও কম বা দশমিক ৭ জন।  

এদিকে গত বছর প্রতি হাজারে বিদেশে গেছে ৮ দশমিক ৭৮ জন। ২০২২ সালে এ হার ছিল ৬ দশমিক ৬১। আগের বছর প্রতি হাজারে বিদেশে গেছে ৩ দশমিক শূন্য ৪ জন। ২০২০ সালে এ হার ছিল ১ দশমিক ৫৯ ও ২০১৯ সালে ছিল ২ দশমিক ৯৪।

দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব মানুষের ওপর পড়ছে। এ কারণে খাদ্যদ্রব্য, পোশাক, বাড়িভাড়া ও নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়ে যায়। আয়ের পরিবর্তন না হলে তখন মানুষ এগুলো প্রয়োজনের চেয়ে কম কিনতে বাধ্য হয়। তাদের সঞ্চয় কমে যায় এবং অন্যান্য খাতের খরচ কমিয়ে ফেলতে হয়। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে সীমিত এবং নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক দ্রব্য তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। তখন তাদের পক্ষে শহরের জীবনযাপন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে তখন তারা গ্রামমুখী হয়। খাদ্যনিরাপত্তাহীন লোকের সংখ্যাও বাড়ছে। অর্থাৎ বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিরূপ প্রভাব সামনে আসছে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, জানুয়ারিতে ভোক্তা মূল্যসূচক বা সহজে বলতে গেলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এটি কমে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে এটি এখনো সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তের একটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমানো। এর অংশ হিসেবে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। 

বাংলাদেশ আর পাকিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশই তাদের মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সক্ষম হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে ভালো উদাহরণ শ্রীলংকা। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের সংকটকালে দেশটির মূল্যস্ফীতি ছিল ৪৯ শতাংশের বেশি। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে এই হার এসে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৪ সাল থেকে ধীরে ধীরে শ্রীলংকার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের তথ্যানুসারে,  ২০২২ সালের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ১ শতাংশ। সেটি কমে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। নেপালে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ১৯ শতাংশ। ২০২৪-এর জানুয়ারিতে তা কমে হয়েছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২৩-এর অক্টোবরে ভুটানের মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। এ বছরের জানুয়ারিতে তা কমে হয়েছে ৪ দশমিক ২ শতাংশ। পাকিস্তানে ২০২৩ সালের মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৩৮ শতাংশ। এ বছরের জানুয়ারিতে কমে হয়েছে ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ। 

কভিড-১৯ মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে সে সময় অনেকেই গ্রামে ফিরে গেছেন। সে সময় নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো কমেনি; বরং দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে এ সংকট আরো প্রকট হয়েছে। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমেছে। তারা গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। তাদের কিছু নীতিগত সহায়তার পাশাপাশি আর্থিক সহায়তার বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। যাতে তারা তাদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে। গ্রামের তুলনায় শহরে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর অভাব ও জীবনযাত্রার বাড়তি খরচ সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছেন অনেকেই। তাই বাধ্য হয়ে অনেকেই গ্রামে যাচ্ছেন। সরকারকে কর্মসংস্থান বাড়াতে ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিতে হবে। শহরে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন