আলোকপাত

বাংলাদেশের অর্থনীতির অসুখ এবং উপশমের উপায়

আব্দুল বায়েস

ছবি : বণিক বার্তা

সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর একেএন আহমেদ স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে। এতে ‘মুদ্রানীতির সাথে রাজস্ব এবং বাণিজ্য নীতির সমন্বয়’ বিষয়ক মূল বক্তা ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। আমরা মনে করি তার ক্ষুরধার পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা ও সুপারিশ বর্তমান সংকট সমাধানে অনেকটা সাহায্য করবে। 

সূচনা বক্তব্যে তিনি মুদ্রার পরিমাণগত তত্ত্বের ওপর আলোকপাত করেন। তবে মনে ধরার মতো কথা ছিল, ‘অর্থনীতির বলয়ে অর্থ কেন এত শক্তিশালী?’ এর প্রধান কারণ হিসেবে বলা যায়, অর্থ হচ্ছে বিনিময়ের মাধ্যম এবং কথায় বলে, পরিমাণমতো অর্থ ঢালতে পারলে বাঘের চোখও মেলে। অবশ্য অর্থের অ-অর্থনৈতিক পরিণতি নিয়ে উল্টো বলেছিলেন লেখক মীর মশাররফ হোসেন—‘অর্থই সকল অনর্থের মূল’। ফরাসউদ্দিন আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন যে অর্থ হতে পারে অনর্থ অন্য এক অর্থেও। আর সেটা হলো দ্রুত মূল্যবৃদ্ধি বা ইনফ্লেশনের সময় অর্থের স্বল্পতা বা নিবদ্ধতা দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য দুর্ভোগ ডেকে আনতে পারে। যাই হোক নোবেলজয়ী মুদ্রাতত্ত্ববিষয়ক অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যন মনে করতেন ‘অর্থ খুব গুরুত্বপূর্ণ’ (মানি মেটারস)।

দুই

তার সহজাত প্রাঞ্জল ভাষায় দু-এক কথা বললেন উন্নয়নশীল দেশে মুদ্রানীতির গুরুত্ব সম্পর্কে। পৃথিবীর প্রত্যেক দেশেই, হোক উন্নত কিংবা অনুন্নত, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দায়িত্ব দেয়া হয় স্থানীয় মুদ্রার মান রক্ষা করার জন্য। নিচু  মূল্যস্ফীতি (বা একেবারেই নয়), একটা স্থিতিশীল বিনিময় হার এবং ওঠানামা নেই এমন সুদের হার যৌথভাবে স্থানীয় মুদ্রার মান ধরে রাখে এবং এই তিন উপাদান একটা স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনীতিক অবস্থানের জন্য উপযোগী হিসেবে মনে করা হয়। 

কভিড আসার আগ পর্যন্ত বছরগুলোয় বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি প্রশংসা কুড়িয়েছিল। যেমন বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাংলাদেশের অর্জনকে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য প্রেরণাদায়ক বলে মনে করতেন। এমনকি ২০২০-২১ সালে কভিডের প্রথম বছরে, ৩ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ ছিল প্রবৃদ্ধির ধারায় থাকা গুটিকয়েক দেশের একটি। কিন্তু ২০২২ সালের মধ্য থেকে শুরু হওয়া ১৫ মাসের মধ্যে হঠাৎ টাকার মানে ব্যাপক অবমূল্যায়ন (২৫ শতাংশের বেশি) সর্পিল গতিতে মূল্যস্ফীতিকে আগের বছরের তুলনায় দুই অংকের ঘরে ঠেলে দেয়। তারপরের ইতিহাস আমাদের জানা মাত্র এক বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ৭ দশমিক ৯২ শতাংশ থেকে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৫৯ শতাংশে পৌঁছে। যদিও ফরাসউদ্দিন বলছেন, বাস্তব অবস্থা অবজ্ঞা করে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড়পড়তা মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে। 

অন্যদিকে সুদের হারের ছয়-নয় নীতিও আদর্শ বা বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা ছিল না। এ নীতি ঋণাত্মক সুদের হারের কারণে একদিকে সঞ্চয় নিরুৎসাহিত করল, অন্যদিকে ব্যক্তি বিনিয়োগে তেমন জ্বালানি জোগাতে ব্যর্থ হলো। না ঘরকা, না ঘাটকা, ছয়-নয় হয়ে গেল নয়-ছয়।

তিন

কেন ছয়-নয় নীতি ব্যক্তি খাতে নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধিকল্পে ব্যর্থ হলো এবং ব্যাংক ডিপোজিট নিরুৎসাহিত করল তার একটা ব্যাখ্যা দিলেন সেদিনের সান্ধ্য রাতের বক্তা মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকার এ ব্যাপারে একমত যে সস্তা ঋণ যায় অকাজের প্রকল্পে, যার ফলে ঋণখেলাপি বেড়ে যায়। কেউ এমন মত দেন যে ধারের হার যদি বেশি থাকে তখন একমাত্র দায়িত্বশীল ঋণগ্রহীতারা ঋণ নিয়ে সবচেয়ে উৎপাদনশীল প্রকল্পে খাটান, যাতে আয় বৃদ্ধি করে সময়মতো সুদসহ আসল ফেরত দেয়া সম্ভব হয়। যদি ধরে নেয়া যায় যে মোট খরচের অর্ধেক ব্যাংক ঋণ, তাহলে ৩-৫ শতাংশ বেশি ধারের হার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা নাও হতে পারে— যখন অন্যান্য ব্যয় যেমন প্রকল্প পাসে প্রলম্বিত সময়, টাকার অতিমূল্যায়নে বহুল ব্যয় বৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। দেখা গেছে যে টাকার অতিমূল্যায়ন ক্ষতিপূরণমূলক তহবিলের অনুপস্থিতিতে প্রকল্পের ব্যয় বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। 

সস্তা ঋণের অন্য এক অবস্থা হচ্ছে ঋণ অন্য উদ্দেশ্যে প্রবাহিত করে অর্থ পাচার এবং দৃষ্টি-আকর্ষক ভোগে ব্যয় করে ঋণখেলাপি লেবাস ধারণ করা। যেখানে খুব কম সুদের বিনিময়ে পুনঃপুনঃ ঋণ রিশিডিউল করার অবকাশ দেয়া হয়, আবেদনকারী ঋণখেলাপিকে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ঋণ রিশিডিউলের ব্যবস্থা অথচ নিয়মিত আইন মান্যকারী ঋণগ্রহীতা দেয় আগাম ১০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট—তার চেয়ে বড় ব্যত্যয় মুদ্রানীতিতে থাকতে পারে কিনা এমন প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক।

বেটার লেট দ্যান নেভার। মূল মাথাব্যথা যখন অব্যাহত মূল্যস্ফীতি তখন ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছয়-নয় নীতি পরিত্যাগ করে একটা সংকুচিত মুদ্রানীতির পক্ষে অবস্থান নেয় এবং তা করতে গিয়ে নীতি-হার (পলিসি রেট) ২৫ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি করে ৮ শতাংশের ঘরে আটকে দেয়। এ পদক্ষেপ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তথা মূল্যস্তর হ্রাসে কতটুকু কার্যকর হবে তা জানা যাবে পরে কিন্তু শবেবরাত এবং রোজার আগমনে বাজারে তাপ বৃদ্ধি বৈ কমেনি বলে ধারণা করা হয়। 

ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড়পড়তা হার (স্মার্ট রেট) প্রায় ৯ শতাংশ ছুঁইছুঁই। তবে পর্যালোচনকারীরা অবশ্যই স্বীকার করেন যে এর ফলে মূল্যস্তরে একটা মৃদু প্রভাব লক্ষণীয়। অন্যদিকে আইএমএফ অভিক্ষেপণ করে দেখাচ্ছে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ক্রমহ্রাসমান এবং ২০২৪ সালে তা ৪ শতাংশের প্রান্তিক বেশি হতে পারে। উদ্বেগের বিষয় এই যে নিট আমদানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নিম্নগামী বৈশ্বিক মূল্যস্তরের ফায়দা নিতে পারেনি। 

চার

বাংলাদেশে যারা বাজার পর্যবেক্ষণ করেন—এমনকি বিবিএস—তারা নিকট ভবিষ্যতে বাজার ঠাণ্ডা হওয়ার সম্ভাব্য কারণ দেখছেন না। অবশ্য পরিপক্ব প্রেক্ষাপট ও যথাযথভাবে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য বিবিএস যেন নির্ভরশীল তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করে সে তাগিদও আসছে অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক থেকে। বাংলাদেশের বাজার যেখানে সিন্ডিকেট, মজুদদার এবং অন্যান্য সরবরাহজনিত সমস্যার প্রভাবে আক্রান্ত, সেখানে শুধু সুদের হার দিয়ে চাহিদা ব্যবস্থাপনা কার্যকর নাও হতে পারে। এটা এও নিশ্চিত করে যে যেমনটি সাধারণ ধারণায় গেঁথে আছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হতে মুদ্রানীতি কখনো এককভাবে সক্ষম নয়। তাছাড়া বাংলাদেশের মতো যে দেশে আন্ডার এমপ্লয়মেন্টের হার প্রায় ৪০ শতাংশ (বেকারত্ব বেশ বেশি), সেখানে চাহিদা সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি পরিস্থিতিকে অধিকতর নাজুক করে তুলতে পারে। 

পাঁচ

এক-দেড় দশক আগে স্থাপিত সমন্বয় পরিষদে (কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল) যারা আছেন তারা হলেন অর্থমন্ত্রী (সভাপতি), বাণিজ্যমন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রী (সহসভাপতি) এবং সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ সচিব, রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বহিঃসম্পদ বিভাগের সচিব, সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য, পরিকল্পনা কমিশন। এ পরিষদের গঠন পরিষ্কার বলে দেয় জিডিপি বৃদ্ধি, রাজস্ব আয়, বহিঃস্থ বাণিজ্য এবং আর্থিক নির্দেশক এসব সাধারণ মূল্যস্তর অভিক্ষেপণে একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যাই হোক সরকারি সদিচ্ছার ছাতার তলে যদি এ পরিষদ ক্ষমতা/কর্তৃত্ব প্রকাশ করতে পারত তাহলে সারা বছর বাজার দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখতে পেত এবং এর সুফল চুইয়ে পড়ত ভোক্তার ওপর।

সুতরাং সুপারিশ হলো সমন্বয় পরিষদ কর্তৃক কর্মপরিকল্পনা পেশ করা যেখানে কারণ, প্রভাব ও উপায় বলা থাকবে এই কথা মনে রেখে যে—ক. বিশ্বব্যাংকের হিসাবকৃত প্রবৃদ্ধির হার যেন ৫ দশমিক ৮ শতাংশের নিচে না নামে; খ. কেন মূল্যস্ফীতি বশীকরণে সুদের হার প্রক্রিয়া আট-নয় দেশে কার্যকর হলেও বাংলাদেশে হয়নি; গ. কেন যতটুকু রাখার তার চেয়ে বেশি বেশি রফতানি আয় বিদেশে আটকে আছে (এখন ১২ শতাংশ); ঘ. পৃথিবীর সবখানে যখন বহুধা বিনিময় হার অবলুপ্ত, সেখানে বাংলাদেশে এখনো চালু থাকার কারণ কী; ঙ. রফতানি বহুমুখীকরণে বিফলতা শনাক্ত করা ও চ. কত ভালোভাবে মুদ্রা, বাণিজ্য ও রাজস্ব নীতির মধ্যে সমন্বয় সাধন করা যায়। 

ছয়

তিনি আরো কিছু সুপারিশ রেখেছেন যেমন প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হারের ভিত্তিতে একটা মাত্র বিনিময় হার কাম্য; রেমিট্যান্সের জন্য প্রদেয় উৎসাহ মধ্যস্বত্বভোগীরা অপব্যবহার করে বিধায় তা বিনিময় হারের সঙ্গে সাযুজ্য করে কার্ব মার্কেটের হারের কাছাকাছি ৩ শতাংশের ওপর পার্থক্য যেন না হয়; অর্থ পাচার রোধকল্পে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট নেতৃত্ব দিতে পারলে অর্থ পাচার অনেক কমবে; যে দেশে ২৫ মিলিয়ন ব্যক্তির মাথাপিছু আয় ৫ হাজার ডলারের বেশি এবং তারা আয়করের আওতায় সেখানে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধিকল্পে গণসচেতনতা সৃষ্টিতে আগ্রাসী পদক্ষেপ নেয়া, যাতে করযোগ্য মানুষ যথাযথ কর প্রদান করে। 

সাত

ফরাসউদ্দিনের মতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুনাফাখোরদের বা আর্থিক খাজনাখোরদের প্রতি মুখের ধমকের চেয়ে প্রকৃত পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি যেমন চাল, গম, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ ইত্যাকার দ্রব্যের তিন-চার মাসের বাফারস্টক, চলমান মুক্তবাজার বিক্রি ১০ গুণ বৃদ্ধি, লাইসেন্সধারীদের সংখ্যা ১০ গুণ বৃদ্ধি করা, যাতে করে কার্টেল গড়া না যায়। উৎপাদক পর্যায়ে পণ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য ঋণ সুবিধা, খেলাপি ঋণ কঠোরহস্তে দমন, প্রাইস কমিশন গঠন, আর্থিক খাতের এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সংস্কার আশু করণীয় বলে মনে করছেন এ বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ। 

আমরা মনে করি বাংলাদেশের অর্থনীতির চলমান ক্রান্তিকাল অতিক্রান্তে ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের পর্যবেক্ষণ এবং সুপারিশমালা থেকে নীতিনির্ধারক মহল অনেক কিছু গ্রহণ করতে পারেন। শুধু মনে রাখা দরকার, সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়। অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে।

আব্দুল বায়েস: সাবেক ভিসি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন