ফাইভজি নিয়ে আমাদের অপারেটররা দ্বিধান্বিত, এখনো আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠেনি

ছবি : বণিক বার্তা

সম্প্রতি সেলফোন অপারেটরদের একীভূত লাইসেন্স প্রদান করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এর মাধ্যমে নতুন ফাইভজি সেবা ও সম্ভাব্য প্রযুক্তির দ্বার খুলেছে টেলিযোগাযোগ খাতে। টেলিযোগাযোগ খাতে একীভূত লাইসেন্সিংয়ের প্রভাব, ব্যবসায়িক সম্ভাবনা, প্রতিবন্ধকতাসহ নানা বিষয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে আলাপচারিতায় অংশ নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক (আইআইটি) অধ্যাপক ড. বিএম মইনুল হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরফিন শরিয়ত

সম্প্রতি বিটিআরসি একীভূত লাইসেন্সিং সেবা গাইডলাইন প্রণয়ন করেছে। এ গাইডলাইনের মাধ্যমে পুরনো প্রযুক্তিসহ নতুন সব ধরনের প্রযুক্তি পরিচালিত করতে পারবে টেলিকম অপারেটররা। এর মধ্যে ফাইভজিও রয়েছে। লাইসেন্স পেলেও গ্রাহকরা ফাইভজি সেবা গ্রহণের জন্য কতটুকু প্রস্তুত?

ইন্টারনেট স্পিডের র‍্যাংকিংয়ে ভারত কিছুদিন আগেও অনেক পিছিয়ে ছিল। হুট করে তারা বিশের মধ্যে চলে এসেছে। এমনটি হওয়ার কারণ খুঁজতে গেলে আমরা দেখব, ভারতের বড় টেলিকম অপারেটররা ফাইভজি সেবা নিয়ে এসেছে। যার কারণে তাদের ইন্টারনেট স্পিড অনেক বেড়ে গেছে। আমাদের এখানেও বেশ কিছুদিন ধরে ট্রায়াল পাইলটিংয়ের মতো বিষয়গুলো হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এখনো ফাইভজি সেবা চালু হয়নি। তার কারণ হচ্ছে এটা খুবই ব্যয়বহুল। একটা অবকাঠামো তৈরি করতে হলে টেলিকম অপারেটরদের বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে হয়। সে বিনিয়োগের বিপরীতে তারা লাভ করার চিন্তা করবে। 

আমাদের দেশে বেশির ভাগ কার্যক্রম ফোরজি দিয়ে করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি, কিছুদিনের মধ্যে ফাইভজি ইন্টারনেট আমাদের লাগবে। আমরা উচ্চ গতির ইন্টারনেট সংযোগের কথা বলছি, স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলছি, তার জন্য ফাইভজির কোনো বিকল্প নেই। আমরা ফিক্সড ওয়্যারলেস অ্যাকসেস (এফডব্লিউএ) সেবা দেয়ার কথা বলছি, তার জন্য ফাইভজি লাগবে। ফাইভজি হলে সিমলেস, স্বতঃস্ফূর্ত সেবা প্রদান করা যাবে। 

ফাইভজি সেবায় অপারেটররা কেমন বিনিয়োগ করবে বলে মনে করছেন? 

আমার কাছে মনে হয়, আমাদের অপারেটররা এখন পর্যন্ত দ্বিধান্বিত, তাদের মধ্যে এখনো আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠেনি। এত বড় বিনিয়োগের বিপরীতে লভ্যাংশ নিয়ে আসা সম্ভব হবে কিনা। এ আত্মবিশ্বাস অপারেটরদের দিতে হবে এবং সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ সেবা নিয়ে আসতে হবে। 

কিছুদিন অপেক্ষা করেছি, চিন্তাভাবনার ব্যাপার ছিল। এখনই আনব, নাকি আরো কিছুদিন পর আনলেই হবে। সেগুলো নিয়ে নিশ্চয়ই চিন্তাভাবনা করেছে, বাজার বিশ্লেষণ করে দেখেছে তারা। এরিকসনসহ মোবাইল ইন্ডাস্ট্রি খাতসংশ্লিষ্টরা অনেকগুলো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে অনেক দেশে ইন্টারনেট সংযোগের বড় অংশ ফাইভজির অধীনে চলে যাবে। তার মানে, পরিষ্কারভাবেই পৃথিবী সেদিকে মোড় নিচ্ছে, আমাদেরও যেতে হবে। 

আমাদের অপারেটরদের ফাইভজি চালু করতে হবে। বিটিআরসি বা যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদেরকেও অপারেটরদের চাপ প্রয়োগ করতে হবে। কোম্পানি চাইবে নতুন বিনিয়োগ না করতে, ফোরজি দিয়েই যদি কার্যক্রম চালানো যায়, তাহলে তারা ফোরজিতে থাকতেই বেশি পছন্দ করবে। কিন্তু ফোরজি দিয়ে সব সেবা দেয়া সম্ভব হবে না। এর জন্য ফাইভজি লাগবে, যত টাকাই লাগুক না কেন ফাইভজি নিয়ে আসতে হবে। আমার ধারণা, বিনিয়োগ তুলে আনা যাবে। ফাইভজির অনেক নতুন নতুন অ্যাপ্লিকেশন আছে, সেটা দিয়ে তাদের বিনিয়োগ তুলে আনতে পারবেন। 

নতুন ইউনিফায়েড লাইসেন্সিংয়ে ফিক্সড ওয়্যারলেস অ্যাকসেস (এফডব্লিউএ) সেবা প্রদানের অনুমতি দেয়া হয়েছে টেলিকম অপারেটরদের। এর আগে ২০০৮ সালে বাংলালায়ন, ব্র্যাকনেট, কিউবিকে ব্রডব্যান্ড ওয়্যারলেস অ্যাকসেস (বিডব্লিউএ) সেবা প্রদানের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তার বিপরীতে তরঙ্গও বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এক দশক পর দেখা গেল এসব কোম্পানিকে লোকসান দিয়ে মার্কেট ছেড়ে দিতে হয়েছে। বিডব্লিউএর মতো একই গঠনের এফডব্লিউএ সেবা কতটুকু কার্যকর হবে বলে আপনি মনে করছেন?

ফোরজি, ফাইভজি, ওয়াইম্যাক্স এগুলো প্রযুক্তি। নানা সময়ে নানা প্রযুক্তি ছিল। প্রযুক্তি এক জিনিস, কিন্তু সফল হওয়ার জন্য শুধু প্রযুক্তি থাকলে হয় না, প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে এটাকে ম্যানেজ করা, গ্রাহককে পর্যাপ্ত সেবা প্রদান করা, মার্কেটিংয়ের মতো বিষয়গুলো জড়িত। প্রযুক্তি খাতে বহু কোম্পানি আসে, বহু কোম্পানি হারিয়ে যায়, নতুন প্রযুক্তি আসে, প্রযুক্তি হারিয়ে যায়। এর সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। টেকনোলজির সঙ্গে সরকারের পলিসি সাপোর্ট, দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট ব্যয়, ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। বিভিন্ন দেশে এফডব্লিউএ সেবা প্রচলিত। আমাদের এখানে অনেক দূরবর্তী এলাকা রয়েছে, যেখানে ব্রডব্যান্ড কেবল সেবা প্রদান সম্ভব নয়, সেখানে এফডব্লিউএ সেবা প্রদান করা সম্ভব। যারা কানেক্টেড না, তাদের কানেক্ট করতে হবে। 

আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে নাগরিকদের কানেক্টিভিটির আওতায় নিয়ে আসা। তার জন্য নিত্যনতুন সুযোগ এলে তা আমি গ্রহণ করব না কেন? যেখানে আমি কেবলের মাধ্যমে কাভারেজ দিতে পারছি না, সেখানে আমি এফডব্লিউএর মাধ্যমে কাভারেজ দেব। সেখানে এটির প্রয়োজন আছে। 

এতে আইএসপি অপারেটররা ব্যবসায়িক বাধার মুখে পড়ার সম্ভাবনা কতটুকু এবং সে বাধা মোকাবেলা করবে কীভাবে?

বাংলাদেশে এখন প্রায় তিন হাজার আইএসপি অপারেটর আছে। আইএসপির মাধ্যমে কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। তাদের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। এটা প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার। গ্রাহকদের সেবা দিয়ে এবং গ্রাহক সন্তুষ্টি অর্জন করে তাদের টিকে থাকতে হবে। এখানে কোনোভাবে শুধু একটি সার্ভিস দিয়ে বসে থাকলাম, এটা চিন্তা করলে হবে না। মোবাইল অপারেটররা যে সার্ভিস দেয়ার কথা বলছেন, তা যে তারা পারবে তা নয়। কিছু জায়গায় আইএসপি সেরা সমাধান। 

আইএসপিদের কিছু ইনোভেশনও নিয়ে আসতে হবে। আইএসপির মাধ্যমে কি আমি শুধু ইন্টারনেট সেবা দেব নাকি কনটেন্ট ডেলিভারির মতো সেবা প্রদান করব। এ জিনিসগুলো খুঁজে বের করতে হবে। যেটা এফডব্লিউএর মাধ্যমে প্রদান করা সম্ভব হবে না। অথবা লাইসেন্সিংয়ের ক্ষেত্রে রেগুলেটরি জায়গা থেকে কিছু বিষয় নিশ্চিত করতে হবে—তারা এটা করতে পারবে, তারা এটা করতে পারবে না। একটা ইকোসিস্টেম তৈরি করতে হবে, যাতে সবাই মানসম্মত সেবা দিয়ে নিজেদের মতো ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে। একটি সুস্থ ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি করা বিটিআরসির দায়িত্ব। 

আবার সঙ্গে সঙ্গে যারা সার্ভিস প্রোভাইডার তাদেরও কিছু দায়বদ্ধতা আছে। আমি এফডব্লিউএ দিলাম, তার মানে এই নয় যে আমি সব দখল করে ফেলতে পারব। এ রকম বহু টেকনোলজি নিয়ে এসে বহু কোম্পানি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বহু কোম্পানি, বহু বিজনেস সার্ভিস দিতে এসে শূন্য হয়ে চলে গেছে। ভয়েস সার্ভিসে কেউ সফল তার মানে এই নয়—তাকে ইন্টারনেট ডাটা সার্ভিসে সফল হতে হবে বা এফডব্লিউএতে সফল হতে হবে। এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। সামনের দিনে কাস্টমার সার্ভিস ও কোয়ালিটি সার্ভিস দিয়ে সবাইকে টিকে থাকতে হবে। আমি মনে করি, বাজারে প্রতিযোগিতা থাকার প্রয়োজন আছে। এতে গ্রাহকই সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়। সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনাকারীদেরও সুরক্ষা দেয়ার প্রয়োজন আছে। বিভিন্নভাবে পরিকল্পনা করে, পলিসি করে সেটা করতে হবে। 

আমাদের টেলিকম অপারেটররা কোয়ালিটি অব সার্ভিস (কিউওএস) কতটুকু দিতে পারছে? 

কোয়ালিটি অব সার্ভিস বিবেচনা করবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তারা আইটি অডিট করাবে, সার্ভিস অডিট করাবে। সে অনুযায়ী তারা ফিডব্যাক দেবে। আমরা রাষ্ট্রের নাগরিক, আমাদের কাজ হচ্ছে সেবা গ্রহণ, অভিযোগ প্রদান এবং সেবার মান সম্পর্কে ফিডব্যাক দেয়া। তার ওপর ভিত্তি করে সেবার মান নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ। অতি দ্রুতই তা করা উচিত। কারণ কোয়ালিটি অব সার্ভিস নিয়ে প্রচুর অভিযোগ আছে। সেটি ঠিক না থাকলে বাকি সব অর্থহীন। সেক্ষেত্রে বাজারে প্রতিযোগিতা থাকলে তা ভালো কাজে দেয়। প্রতিযোগিতা থাকলে তারাও মার্কেটে টিকে থাকার জন্য প্রতিযোগিতা করে ভালো সেবাটা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে তারাও আবার সিন্ডিকেট করে ফেলে। সেক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার গুরুত্ব অনেক বেশি এখানে। 

অপারেটররা ব্যবসায়িক প্রতিবন্ধকতার ‍মুখে পড়ছে। সেখানে তারা অনেক নতুন নতুন সেবার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। টাকা থাকলে চাইলে আপনি ব্যাংক খুলে বসে থাকতে পারেন না বা মহাজন সেজে টাকা ধার দেয়া শুরু করতে পারেন না। রাষ্ট্রের নিয়মকানুন আছে। আপনি চাইলে সব ব্যবসা শুরু করতে পারেন না। ব্যবসায়িক স্বার্থের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে এক ব্যবসা যাতে অন্য ব্যবসার ক্ষতি না করে সে স্বার্থটাও সুরক্ষিত রাখতে হবে। 

তাদের ওই লাইসেন্স আছে কিনা জানি না, থাকলে তারা সে ব্যবসা করবে; না থাকলে সে ব্যবসা করবে না। এটাও ঠিক, বিশ্বব্যাপী মিডিয়া একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ডিজিটাল টেকনোলজি আসার কারণে সবকিছু পরিবর্তন হচ্ছে। এ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিষয়গুলো নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে। টেলিকম অপারেটররা সেটা করতে পারবে নাকি পারবে না, সে বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিইনি। সিদ্ধান্ত নিলেও এ বিষয়ে আরো কথা বলা দরকার। হুট করে পারবেন না, বলাও ঠিক নয়, আমার বলাটা কতটুকু যৌক্তিক সেটাও বিবেচনা করতে হবে। বিষয়গুলো নিয়ে আরো বিস্তারিত বিশ্লেষণ প্রয়োজন আছে। তার ব্যবসার কারণে অন্য ব্যবসা যদি মাঠে বসে যায় সে পারমিশনও হুট করে দিয়ে দেয়া উচিত না। ব্যবসাকে ধীরে ধীরে বিবর্তনের সুযোগ দিতে হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাকে খাপ খাওয়ানোর জন্য সময় দিতে হবে, তা না করতে পারলে তারা তো ব্যবসায় টিকে থাকতে পারবে না। এটা রাষ্ট্র ও ব্যবসা কারো জন্য সুখকর না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন