বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় বরাদ্দ

উন্নত দেশ হতে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই

ছবি : বণিক বার্তা

স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের অভিমুখে যাত্রা করছে বাংলাদেশ। সব ঠিক থাকলে ২০২৬ সাল নাগাদ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম থাকবে এ দেশের। এরপর উন্নতির পথে অগ্রগামী হবে। তবে সে পথ যে খুব বেশি মসৃণ হবে না তা প্রতীয়মান হয় শিক্ষার মান ও শিক্ষায় বিনিয়োগের মাত্রা দেখে। শিক্ষার পরিবেশ বিচারে সাক্ষরতার হার আর মান সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। সর্বশেষ জরিপ মতে, বর্তমানে দেশে সাক্ষরতার হার প্রায় ৭৩ শতাংশ। ১৯৭১ সালে যা ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ দেশে সাক্ষরতার হার বেড়েছে। এ তথ্য জানান দেয় শিক্ষায় মানুষের অন্তর্ভুক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে হয়েছে। কিন্তু মানের প্রশ্নে তেমন কোনো নজির নেই বললে চলে। নজির নেই কারণ শিক্ষায় বিনিয়োগ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ থেকে যারা উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে, খেয়াল করলে দেখা যাবে তাদের মধ্যে নানা পার্থক্য বিদ্যমান। রাজনৈতিক আদর্শ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। উদাহরণস্বরূপ আমেরিকার পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও চীন সরকার নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির কথা বলা যায় কিন্তু একটি জায়গায় তারা এবং যেকোনো উন্নত দেশ একই মতাদর্শে বিশ্বাসী—মানসম্মত শিক্ষা। মানসম্মত শিক্ষার সঙ্গে উন্নয়নের একটা সুসম্পর্ক রয়েছে তা তাদের শিক্ষায় বিনিয়োগ ও শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে পরিলক্ষিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের অসংখ্য দেশের পরিকল্পিত শিক্ষা দেশের সার্বিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে। এসব দেশের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অনেক বেশি। ইউনেস্কোর মতে, কোনো দেশের বাজেটের ২০ শতাংশ বা জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা উচিত। বিপরীতে আমাদের দেশের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির ২ শতাংশেরও নিচে। এর ফলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন হচ্ছে না, তেমনি বেহাল দশা কারিকুলামের। একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় তখনই বিশ্বসেরার তালিকায় নাম লেখাতে পারে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও প্রকাশনা শক্তিশালী হয়। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণায় পিছিয়ে, নেই পর্যাপ্ত বরাদ্দ।

দেশকে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ও গবেষণা এগিয়ে নিতে গত কয়েক দশকে পাঁচটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৩টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার। ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২ অনুযায়ী, অন্তত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে—এমন পাঁচ প্রকৌশল এবং আট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে গবেষণা খাতে মোট বরাদ্দ ‍ছিল ৩৪ কোটি ১১ লাখ টাকা। এগুলোর মধ্যে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকিগুলোয় গবেষণা খাতে বরাদ্দ ৫ কোটি টাকারও কম। এর মধ্যে ১০টিরই বরাদ্দ ৩ কোটি টাকারও কম। বিশ্ববিদ্যালয়সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হিসেবে গবেষণার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা পর্যাপ্ত গুরুত্ব পাচ্ছে না। এমনকি অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণা খাতে চাহিদার বিপরীতে অর্ধেক বরাদ্দও দেয়া হচ্ছে না। সম্প্রতি বণিক বার্তার প্রতিবেদনে এ চিত্র ফুটে উঠেছে। 

সোলোর গ্রোথ মডেল অনুযায়ী অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল উপাদান মূলত তিনটি— টাকা, প্রযুক্তি ও জনবল। দেখা যায় আজকের উন্নত দেশগুলো একসময় টাকা ঋণ নিয়েছে। প্রযুক্তি অনুকরণ করে বা আমদানি করে নিজের দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে। এমনকি শুরুর দিকে তারা বিশেষজ্ঞ আনিয়েছে নিজ নিজ দেশে। ধীরে ধীরে তারা নিজের জনগণকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করেছে। এটি সম্ভব করেছে তারা মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে। অর্থাৎ কালক্রমে দক্ষ জনবলের মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রযুক্তি খাত উন্নত করেছে এবং টাকা, প্রযুক্তি ও জনবলে সমৃদ্ধ হয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, শিক্ষায় পরিকল্পিত বিনিয়োগ ও ব্যবস্থাপনা অতীব জরুরি। বাংলাদেশ যদি উন্নত দেশে পরিণত হতে চায়, তাহলে মানসম্মত শিক্ষার বিকল্প নেই। অনতিবিলম্বে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। বাড়াতে হবে বরাদ্দ। শিক্ষকদের জীবন মানের উন্নয়ন, প্রশিক্ষিত শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের জন্য ইতিবাচক প্রণোদনা, সুপাঠ্য পাঠ্যপুস্তক ও উন্নত কারিকুলাম, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও গবেষণায় বিপুল অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। 

তবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়ন অভিমুখী দেশের সক্ষমতাও এক্ষেত্রে বিবেচ্য। কভিড-পরবর্তী দেশ মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকটসহ নানা সংকটে জর্জরিত। ফলে বাজেট খুব বেশি বাড়ানো সম্ভব নয়। কিন্তু বরাদ্দকৃত অর্থ যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে তদারকি আবশ্যক। বিশ্ববিদ্যালয়সহ যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা ও মান বিবেচনা করে পৃথক বরাদ্দ দেয়া উচিত এবং পর্যায়ক্রমে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত।

বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক মানচিত্রে জায়গা করে নিতে প্রয়োজন তাই প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও গবেষণাকর্মের অগ্রগতি। বিজ্ঞান ও গণিতে দক্ষতা বাড়ানো এক্ষেত্রে অতিপ্রয়োজনীয়। নয়তো চতুর্থ বিপ্লবের যুগে হিমশিম খেতে হবে দেশকে। প্রযুক্তিনির্ভর না হলে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্লথগতি দেখা দেবে। আবার অন্যদিকে মানুষ কর্মচ্যুত হবে। প্রথাগত কাজে মানুষের প্রয়োজন ফুরাবে। কিন্তু কর্মচ্যুত মানুষগুলোকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া সম্ভব কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে। কেননা উৎপাদনের সব উপকরণই নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি করে। সে অনুযায়ী জনগণকে দক্ষ করতে পারলে দেশে বেকারত্ব চড়াও হয় না বরং মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ে, যা উন্নত দেশ হওয়ার অন্যতম শর্ত।

শিক্ষার মাধ্যমে একজন শ্রেণীভিত্তিক পেশার বাইরে আসতে পারে। স্বল্প মজুরিপ্রাপ্ত একজন পেশাদারের সন্তান শিক্ষার মাধ্যমে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারে। রাতারাতি তার আয় বহু গুণ বেড়ে যেতে পারে কেবল শিক্ষার মাধ্যমে। সুতরাং সামাজিক গতিশীলতা আনয়নেও শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর একটি দেশ তখনই উন্নত বলে বিবেচিত হয়, যখন দেশটিতে গতিশীলতা থাকে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন