অভিমত

গবেষণার ছদ্মাবরণে প্রচলিত একাডেমিক ক্রাইম

ড. মো. এরশাদ হালিম

ছবি : বণিক বার্তা

গবেষণা শব্দের সন্ধিবিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায় গো+এষণা যা নিপাতনে সিদ্ধ স্বর সন্ধি। কিন্তু প্রচলিত গবেষণার নামে চলমান প্রহসন দেখলে রম্য রসাত্মকভাবে বলতে হয়, গবেষণা শব্দটি যদি মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস হয় তবে এর ব্যাসবাক্য হওয়া উচিত গবু তুমি এসোনা, যেখানে গ আদ্যক্ষরটি গবুকে প্রতিনিধিত্ব করে যার ব্যুৎপত্তি গব কৃৎ প্রত্যয় থেকে। অন্যদিকে এসোনা শব্দটি বিশ্লেষণ করলে হয়তো ব্যাখ্যা করতে হবে যে বাংলা অভিধানে ষ এবং স-এর মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই এবং আ-কার, ‌এ-কার অনেক ক্ষেত্রেই উঠে গেছে।

মূলত কোনো একটি বিষয়ের ওপর গভীর পড়াশোনা এবং হাতে-কলমে নিবিড় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পরীক্ষালব্ধ ফলাফলকে বই আকারে রিপোর্ট করার নামই গবেষণা এবং রিপোর্টটিকে যখন একাডেমিক ডিগ্রির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয় তখন তার নাম হয় থিসিস বা অভিসন্দর্ভ। এক্ষেত্রে রেফারেন্স হিসেবে পুরনো কাজকে অনুসরণ করার যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও কপি করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। কোনো ল্যাবে পুরনো থিসিস বা প্রজেক্ট রিপোর্ট থাকে শুধু কনসেপ্ট ডেভেলপমেন্টের সুবিধার্থে। এর ব্যতিক্রম কিছু ঘটলে তা হবে সম্পূর্ণরূপে গবেষণার পরিপন্থী একটি চর্চা, যা আজকাল সাধারণ একটি প্রথায় বা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এ পরিস্থিতি ছাত্র ও শিক্ষক কিংবা তত্ত্বাবধায়ক উভয় পক্ষের সৃষ্টি, যা একদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিষয়টি আসলেই চরমভাবে হতাশাজনক। তাই গবেষণা করা কিংবা করানোর আগে গবেষণার তাৎপর্য অনুধাবন করা অতীব জরুরি। তা না হলে তথাকথিত গবেষণা কিংবা গবেষণা নামের প্রহসন ফলপ্রসূ কিছু বয়ে আনবে না। দিনের পর দিন এভাবে গবেষণা অভিসন্দর্ভ কপি করার মতো ভয়ানক একটি অপরাধ পদে পদে ধ্বংস করে দিতে পারে সৃজনশীলতা ও নতুন কিছু উদ্ভাবন করার সহজাত প্রবণতাকে। পাশাপাশি এ ধরনের চৌর্যবৃত্তি নতুন প্রজন্মের সামনে ভুলভাবে উপস্থাপন করছে গবেষণার মূল দর্শনকে এবং অনৈতিকতার পথে ঠেলে দিচ্ছে লাখ লাখ তরুণ গবেষককে, যা আসলেই অপ্রত্যাশিত ও হতাশাজনক। 

দেখা যায়, শত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ভালো এবং কোনো মৌলিক গবেষণা করতে পারলে ELSEVIER, ACS কিংবা SPRINGER-এর মতো High Impact Factor-ওয়ালা কিছু জার্নালে দু-চারটি পেপার হয়তো করা যায়। গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ হাতে চলে আসে বেশকিছু সাইটেশন, যা মনের আত্মতৃপ্তির দুয়ার খুলে দেয়। গবেষণা বুঝে এ রকম হাতে গোনা কিছু সত্যিকারের পণ্ডিতের কাছ থেকে পাওয়া যায় সাময়িক বাহবা। তবে এসব বাদ দিয়ে প্রহসনমূলক গবেষণা নামক কিছু রুটিন অ্যানালাইসিস থেকে প্রাপ্ত ডাটা বা উপাত্ত ভারী করে দিতে পারে প্রকাশিত রিপোর্ট কিংবা গবেষণা প্রবন্ধের পাল্লা। উপরন্তু সেগুলোকে দেশ-বিদেশ ভ্রমণের মাধ্যমে বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম বা সভায় শো অফ করার প্রক্রিয়া সুগম করে দিতে পারে পরবর্তী গবেষণা প্রজেক্টের জন্য নতুন ফান্ড উত্তোলন করার পথ। এসব আবর্জনাকে আবার প্রকাশও করা হয় ব্যাঙের ছাতার ন্যায় গজানো কিছু নামসর্বস্ব অনলাইন এবং মৌখিকভাবে স্বীকৃত তথাকথিত আন্তর্জাতিক জার্নালে। জার্নাল সাবস্ক্রিপশন ফির ছদ্মনামে ডোনেশনের মাধ্যমে অকৃপণ হস্তে ব্যয় করা হয় বিভিন্ন প্রজেক্ট থেকে সংগৃহীত লাখ লাখ টাকার অনুদান ফান্ডের বড় একটা অংশ। এসব প্রকাশনা আবার সাবমিট করা হয় বিভিন্ন ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে। আর সেখানে যদি থাকে নিজস্ব ঘরানার তথাকথিত বিশেষজ্ঞরা তবে তো কথাই নেই। একেবারে সোনায় সোহাগা। চাকরি, পদোন্নতি তো বটেই উপরন্তু, তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায় গরম গরম প্রশংসাপত্র আর কর্মদক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মহামূল্যবান সনদ। তবে পাশাপাশি অনেক নিবেদিতপ্রাণ গবেষকও রয়েছেন যারা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেই নিজেদের পেশাগত দায়িত্ববোধ কিংবা মনের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে গবেষণাকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। মূলত এদের কারণেই গবেষণার সত্যিকারের স্বাদ সাধারণ ছাত্রছাত্রী কিংবা শিক্ষানবিশরা কিছুটা হলেও এখন পর্যন্ত আস্বাদন করতে পারছে। এরাই মূলত গবেষণার জ্ঞান সাগরে সদা বহমান মূল স্রোতটির প্রতিনিধিত্ব করে। 

পাশাপাশি বিনা শ্রমেই যদি এভাবে যত্রতত্র গবেষণা রিপোর্ট বা থিসিস তৈরি করা যায় এবং এর পর্যাপ্ত স্বীকৃতিও মিলে তবে তত্ত্বাবধায়ক কিংবা শিক্ষানবিশরা কেনইবা করবে কষ্ট করে এতটা উদ্ভাবনী কাজ, যেমনটা হয় মূলধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে। দেখা যায়, আমদানি করা ‘‌শোলে’র আদলে নির্মিত কাট-পিস চলচ্চিত্রের কাছে মার খেয়ে যায় ‘‌সূর্য দীঘল বাড়ী’ বা ‘‌ধীরে বহে মেঘনা’র মতো মূল ধারার ছায়াছবি। আবার দেখা যায় এ ধরনের শো অফ গবেষকরাই বড় বড় গবেষণা, উদ্ভাবন কিংবা সৃজনশীলতার প্রবক্তা ও অগ্রদূত। বিভিন্ন কনফারেন্স, সেমিনার কিংবা শো অফ প্রোগ্রামের মধ্যমণি। এ রকম সারবত্তাহীন গবেষণার সংস্কৃতি চলতে থাকলে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো একসময় মুখ থুবড়ে পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে গবেষণার মতো একটি উদ্ভাবনী ধারা ও সৃজনশীলতা। আন্তর্জাতিক বাজারে দেশমাতৃকা পিছিয়ে পড়বে উন্নয়নের মূল স্রোত থেকে। 

দেখা যায়, এ ধরনের গবেষকরাই আবার কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের সরল বিশ্বাস ও গবেষণাকর্মের প্রতি অপরিপক্ব ধারণা ও অন্ধ ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গঠনের এক অপার সম্ভাবনার উন্মুক্ত দ্বারের পরোক্ষ প্রলোভন দেখিয়ে খুব সহজেই নিজেদের দিকে সুকৌশলে টেনে নিতে পারে। হয়তোবা টিকে থাকার বাজারে এটাও এক ধরনের যোগ্যতা। তথাকথিত গবেষণার নামে তাদের দিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পাদন করানো হয় নিজেদের ব্যবসায়িক রুটিন ওয়ার্কগুলো কিংবা বিভিন্ন সংস্থা থেকে দেন-দরবারের মাধ্যমে উপযাচক হয়ে চেয়ে চেয়ে আনা অ্যানালাইটিক্যাল স্যাম্পল বা নমুনাগুলোর রুটিন অ্যানালাইসিস, যেগুলো মূলত নগদ অর্থের বিনিময়ে করে দেয়া হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে রসায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখায় নিরীক্ষার এ নমুনাগুলো হতে পারে কোনো ব্র্যান্ডের সুগন্ধি সাবান, বাসক পাতার সিরাপ কিংবা উকুন দূরীকরণ হারবাল প্রসাধনীর মতো মহামূল্যবান কোনো সামগ্রী। এ উপাত্তগুলো প্রদর্শন করে আবার বিভিন্ন সংস্থা থেকে নিয়ে আসা হয় লাখ লাখ টাকার অনুদান যার বড় একটা অংশ ব্যয় করা হয় কনফারেন্স, সেমিনার বা বিভিন্ন শো অফ প্রোগ্রামের ব্যবস্থাপনার খরচ বাবদ। এক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় খাওয়া-দাওয়া, ফটো সেশন কিংবা পদস্থ কর্তৃপক্ষ এবং বিদেশী বিভিন্ন পশ্চিমা গবেষকদের সঙ্গে মোলাকাতের উপলক্ষ তৈরি। আর হতভাগা সহজ-সরল গবেষণা পিপাসুরা সামগ্রিক চিত্র দেখে সহজেই ভড়কে যায়। 

অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে শো অফ করা হয় ল্যাবের কিছু যন্ত্রপাতি, যেগুলোর অধিকাংশই অকার্যকর। অন্যান্য প্রয়োজনীয় কিন্তু অলীক কিছু মনগড়া সুযোগ-সুবিধা, যেমন অতি সহজেই পাবলিকেশন করা, পরিচিত বিদেশী অধ্যাপকদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে অতিসহজেই বিদেশ গমন ইত্যাদিও প্রদর্শন করা হয় এই প্রজেক্টের সাপ্লিমেন্টারি পার্ট হিসেবে। গবেষণার ছদ্মাবরণে দিনের পর দিন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এ ধরনের প্রহসনমূলক এক বাণিজ্য। বেচারা ছাত্রছাত্রীরাও কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাতারাতি চলে যায় বোকার স্বর্গে। রসায়নের মতো একটি মৌলিক বিষয়ে এটাই গবেষণা প্রহসনের জলজ্যান্ত উদাহরণ। এটাই এখানকার বাস্তবতা যেখানে যোগ্যতা কিংবা যাচাই-বাছাইয়ের মানদণ্ডের বাজারে স্বর্ণের চেয়ে রুপার দাম বেশি। তথাকথিত শো অফ সায়েন্টিস্ট বনে যাওয়ার নিমিত্ত এমন নিকৃষ্ট এক গবেষণা প্রহসন একসময় ধ্বংস করবে তরুণ প্রজন্মের মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও উদ্ভাবনী ধারাকে। দেশ ও জাতি বঞ্চিত হবে প্রকৃত উন্নয়ন থেকে। তাই এর বিরুদ্ধে এখন থেকেই সোচ্চার না হলে অদূর ভবিষ্যতে গবেষণার মতো সৃষ্টিশীল একটি ধারার পতন অনিবার্য।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হচ্ছে বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে নতুন গবেষকদের জন্য উপযুক্ত কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা, যাতে তারা গবেষণার মূল দর্শনকে উপলব্ধি করতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্লেজিয়ারিজম আইন এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। তবে কোনো আইনই কার্যকর হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত মন-মানসিকতায় স্বচ্ছতা না আসে অথবা চিন্তা-ভাবনায় শুভবুদ্ধির উদয় না হবে।

ড. মো. এরশাদ হালিম: অধ্যাপক, সিনথেটিক অর্গানিক কেমিস্ট্রি ও কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালস, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন