আরাকান আর্মি ভারতের প্রতি বিরোধপূর্ণ মনোভাব পোষণ করছে ২৬ বছর ধরে

বণিক বার্তা ডেস্ক

ছবি : বণিক বার্তা

১৯৯৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্ত থেকে সমুদ্র পথে যাত্রা করেছে অস্ত্রবাহী একটি নৌযান। গন্তব্য আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। সেখান থেকে এ নৌকা যাবে বাংলাদেশের কক্সবাজারে। সেখানে খালাস হয়ে পাচারকৃত এসব অস্ত্র চলে যাওয়ার কথা মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী বিদ্রোহীদের হাতে। নৌকায় অস্ত্র পাহারা দিয়ে আনছে রাখাইনের একদল জান্তাবিরোধী বিদ্রোহী। এর নেতৃত্বে আছেন রাখাইনের বিদ্রোহী সংগঠন ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি অব আরাকানের (এনইউপিএ) সামরিক শাখার (আজকের আরাকান আর্মি) প্রধান খাইং রাজা। 

পরদিন আন্দামানের নারকোনদাম আইল্যান্ডে বিরতি নেয় অস্ত্র ও বিদ্রোহীদের বহনকারী নৌযানটি। ১০ ফেব্রুয়ারি আবার যাত্রা করে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ২২০ কিলোমিটার উত্তরের ল্যান্ডফল আইল্যান্ডের দিকে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম কুইন্টের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, অস্ত্র পাচারকারী বিদ্রোহীরা জানতেন, স তুন নামে এনইউপিএর এক নেতা ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। আর ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের ধারণা, প্রকৃতপক্ষে এসব অস্ত্র পাচার করা হচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের দুর্গম সব রাজ্যের বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর উদ্দেশ্যে। ১১ ফেব্রুয়ারি ল্যান্ডফল আইল্যান্ডে পৌঁছায় নৌযানটি। সেখানে ভারতীয় এক নেতার সঙ্গে আলোচনার জন্য মিয়ানমারের বিদ্রোহী দলটির নেতাদের নিয়ে যাওয়া হয় জঙ্গলে। 

ভারতীয় ও বর্মি সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ‘সেদিন ‌অপারেশন লিচ’ শিরোনামে এনইউপিএ বিদ্রোহী ও অস্ত্রের চালানটির বিরুদ্ধে এক অভিযান চালায় ভারতীয় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী। আউটলুক ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, সেদিনকার চালানে একে সিরিজের (কালাশনিকভ) ১৪০টি অ্যাসল্ট রাইফেল ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ আটক করা হয়।  

এতে মৃত্যু হয় খাইং রাজাসহ ছয় বিদ্রোহী নেতার। আটক হয় ৭৩ জন। তাদের সবার বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র পাচারের অভিযোগ আনা হয়। পরে তদন্ত চালিয়ে জানা যায়, তাদের মধ্যে ৩৫ জন আসলে সাধারণ জেলে। আটকের এক বছর পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। ছেড়ে দেয়া হয় নৌযানের দুই থাই মাঝিকেও। পালানোর চেষ্টা করে নিখোঁজ হন আরো দুজন। প্রায় ১৩ বছর আটক থাকার পর বাকি ৩৪ জন মুক্তি পান ২০১১ সালে। আটক অবস্থায় তারা বছরের পর বছর দাবি করেছে, তারা কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন ও এনইউপিএর গণতন্ত্রপন্থী সদস্য।  

মিয়ানমারে দায়িত্ব পালন করে আসা সাবেক ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা ডিবি নন্দী ২০০৭ সালে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানকে বলেছিলেন, ‘‌গোটা পরিকল্পনা সাজানো হয়েছিল আরাকানিদের বিদ্রোহ গুঁড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য থেকে। ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না।’

বর্মি সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সেদিনের ঘটনাটিকে আরাকানি বিদ্রোহীরা বর্ণনা করে ‘‌বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে। আরাকান আর্মির বর্তমান সংস্করণটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৯ সালে চীন-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী কাচিন প্রদেশে। সংগঠনটি খাইং রাজাকে বর্ণনা করে ‘‌আরাকানি জাতিগোষ্ঠীগুলোর সম্প্রীতির স্বপ্নদ্রষ্টা’ হিসেবে। 

১৯৯৮ সালের ওই ঘটনার পর থেকেই ভারতের প্রতি বিরোধপূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করে এসেছে আরাকান আর্মি ও এর পূর্বসূরি সংগঠনগুলো। ভারতও সংগঠনটির উপস্থিতিকে বিবেচনা করছে নিরাপত্তা-ঝুঁকি হিসেবে। দেশটির অভিযোগ, আরাকান আর্মিকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করছে চীন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ওয়াইয়নে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ২৩ জুন থাই সেনাবাহিনী চীনের তৈরি অস্ত্রের একটি চালান আটক করে। ১ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ওই অস্ত্র রাখাইনের বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর সদস্যদের মধ্যে বিতরণের জন্য পাচার করা হচ্ছিল, যার অন্যতম ছিল আরাকান আর্মি। 

ইন্ডিয়ান ডিফেন্স রিভিউতে ২০১৯ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত তাতমাদোর (মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী) সঙ্গে এক যৌথ অভিযান পরিচালনা করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। ‘‌অপারেশন সানরাইজ’ নামে ওই অভিযানে ভারতের পক্ষ থেকে বিশেষ সামরিক ইউনিট (স্পেশাল ফোর্সেস), আসাম রাইফেলস ও অন্যান্য পদাতিক ইউনিট অংশ নেয়। এতে ড্রোন, হেলিকপ্টার ও অন্যান্য নজরদারি চালানোর উপযোগী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়। এ অভিযানের লক্ষ্য ছিল, মিয়ানমারে সক্রিয় ‘‌আরাকান আর্মি’ নামে সশস্ত্র সংগঠন। এছাড়া যৌথ অভিযানের পরের ধাপের লক্ষ্য ছিল ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড-খাপলাং (এএসসিএমএন-কে) নামে আরেকটি সংগঠন। 

ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ভারতীয় সেনাবাহিনী ও তাতমাদোর ওই যৌথ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রান্সশিপমেন্ট প্রকল্পের জন্য হুমকিগুলো দূর করা। কলকাতা বন্দরের সঙ্গে মিয়ানমারের সিত্তে বন্দরকে সংযুক্ত করার উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে কলকাতা ও মিজোরামের মধ্যে দূরত্ব কমবে প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি রুপিতে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির লক্ষ্য হলো মিয়ানমারের সিত্তে বন্দরকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করা। একই সঙ্গে কলকাতার সঙ্গে ভারতের মিজোরামের দূরত্বও অনেক কমিয়ে আনবে প্রকল্পটি। 

পর্যবেক্ষকদের ভাষ্যমতে, ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট (পুবে চলো) নীতিমালায় পালেতওয়া ও সিত্তের অবস্থান কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূলত এ দুই শহরকে কেন্দ্র করে ভারতের অর্থায়নে বাস্তবায়ন হচ্ছে উচ্চাভিলাষী কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট। ব্লুপ্রিন্ট অনুযায়ী, এটি বাস্তবায়ন হলে কলকাতা থেকে রাখাইনের সিত্তে বন্দরে পাঠানো পণ্য কালাদান নদী হয়ে খালাস হবে মিয়ানমারের চিন প্রদেশের পালেতওয়া বন্দরে। এরপর সেখান থেকে তা সড়কপথে পরিবাহিত হবে ভারতের মিজোরামে। সেক্ষেত্রে শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেনস নেকের ওপর ভারতের নির্ভরতাও অনেকখানি কমে আসবে।

রাখাইনে আরাকান আর্মির সাম্প্রতিক সাফল্যে প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ নিয়ে মারাত্মক অনিশ্চয়তা দেখতে পাচ্ছে ভারত। বিশেষ করে আরাকান আর্মির পালেতওয়া ও বন্দরনগরী সিত্তের নিকটবর্তী পাউকতাও দখলের খবর দেশটির নীতিনির্ধারকদের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। গত মাসে বাংলাদেশ সীমান্তের ২০ কিলোমিটার দূরে চিন প্রদেশের পালেতওয়া পূর্ণরূপে দখল করে নেয়ার কথা জানায় আরাকান আর্মি। কিছুদিন আগে রাখাইনের রাজধানী সিত্তের নিকটবর্তী পাউকতাওয়ে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার খবর প্রকাশ হয়। 

ইরাওয়াদ্দি জানিয়েছে, রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে তাতমাদোর তুমুল লড়াই অব্যাহত আছে। বর্তমানে সেখানে একের পর এক শহর দখল করে রাখাইন প্রদেশের রাজধানী সিত্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আরাকান আর্মি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন